Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus in India

হাতের পরশ রইবে হাতে

অতিমারি পরিস্থিতিতে কেমন আছেন আমাদের বাড়ির এবং আশপাশের প্রবীণরা? নবীনরা পাশে থাকলে তাঁদের অসহায়তা কাটানো কঠিন নয়নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রবীণদের মাথায়। এর থেকে সুরাহার কোনও পথ আছে কি?

নবনীতা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

যে রেখাপথে জীবন চলার কথা, তার থেকে খানিক চ্যুতি হলেই এখনও আমরা মা-বাবার শরণাপন্ন হই। তাঁদের অশক্ত হাত মাথার উপরে এক অপরিসীম শক্তি জোগায়। কিন্তু গত কয়েক মাসে তাঁদের নিয়ে চিন্তার পাহাড় জমছে মনে। আর তাঁরাও ক্রমশ ডুবে যাচ্ছেন অবসাদে, অসহায়তায়, একাকিত্বে। অতিমারির এই বিশ্বে টিকে থাকার লড়াই সহজ নয়। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ষাট-সত্তর পেরিয়েছে, তাঁদের জন্য। বাড়ির বয়স্কদের অনেকেই এই কয়েক মাস একেবারেই গৃহবন্দি। তার উপরে রয়েছে নিকটাত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর ও তাঁদের অন্তিম পরিণতি। এ সবই তাঁদের ভাবাচ্ছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রবীণদের মাথায়। এর থেকে সুরাহার কোনও পথ আছে কি? তবে আগে বুঝতে হবে তাঁদের অসহায়তাকে।

অসহায়তা কেন?

• জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী বললেন, ‘‘অতিমারি শুরু হওয়ার পরে ফোনে হাউসহোল্ড সার্ভে করায় কারণগুলি স্পষ্ট হয়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে, যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বা আশপাশে, তাঁদের অবস্থা অসহনীয়। আমাদের দেশে সেই সংখ্যা কিন্তু অনেক। করোনার আগে পর্যন্ত অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁদের পাশে দাঁড়াত, নিজেরাও নানা ভাবে রোজগার করতেন। ফলে তাঁরা রোজকার খাবারটুকু অন্তত পেতেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেই সব কাজ খানিকটা থমকে গিয়েছিল। ফলে এঁরা সন্তানের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। রোজকার খাবারটুকুর জন্য এঁরা মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। অভাবের সংসারে একটা মানুষ মানে একটা পেট। এ ছাড়া রয়েছেন এনআরআই সন্তানদের বাবা-মাও। ছেলেমেয়ের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারেননি বা তাঁদের আসার পরিকল্পনাও ভেস্তে গিয়েছে।’’ এঁরাও অসহায় হয়ে পড়েছেন। শরীর খারাপ হলে তাঁদের কে দেখবে, কী হবে? প্রশ্নগুলো মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

• বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন, যাঁদের আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে, কিন্তু ডিজিটালি সক্রিয় নন। অনলাইন পেমেন্ট, শপিং, ভিডিয়ো কলও করতে পারেন না হয়তো অনেকেই। একটা বয়সের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। যে পৃথিবীতে এঁরা অভ্যস্ত ছিলেন, তা হঠাৎ বদলে গিয়েছে। তার জন্য কোনও প্রস্তুতিও ছিল না সে অর্থে। মধ্যবয়স্করা অনলাইনে কেনাকাটা করছেন বা প্রয়োজনে বেরোচ্ছেন। বেশি বয়স্কদের বেরোনো মোটেই নিরাপদ নয়। তাই পাশে কেউ না থাকলে নির্দিষ্ট দোকান থেকে ওষুধের হোম ডেলিভারি কিংবা প্রতিবেশীর উপরে তাঁদের ভরসা করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পাড়ায় অনেক ভলান্টিয়ার স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু সমস্যা আরও আছে।

• ইন্দ্রাণী বললেন, ‘‘এঁদের অনেকেই হাউস-হেল্পের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তেমন নির্ভরযোগ্য মানুষও হয়তো পাচ্ছেন না। আবার শারীরিক ভাবে নিজের কাজ করতেও অক্ষম। বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার জন্য যে ডে কেয়ার সেন্টারগুলি এত দিন কাজ করছিল, তাদের কাজও ব্যাহত হয়েছে এই পরিস্থিতিতে। যেখানে আগে দিনে তিরিশ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকতেন, এখন হয়তো দশ জন রাখতে হচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে অনেককে বাড়ি ফেরত পাঠাতেও হয়েছে। কিন্তু যাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁরা কোথায় যাবেন? কিছু বৃদ্ধাশ্রমে তাই কয়েক জনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।’’

সুরাহার পথ

• প্রথমেই বয়স্কদের ভাবতে হবে তাঁরা এ যুদ্ধে একা নন। তাঁদের বয়সি, তাঁদের চেয়ে বেশি বয়সি বা আরও অসুস্থ অনেকেই এই যুদ্ধে শামিল। মনোবল ভাঙতে দেওয়া চলবে না।

• ডিজিটাল জগতের উপরে একটু হলেও ভরসা করতে হবে। ইন্দ্রাণী বললেন, ‘‘ভিডিয়ো-কল, অনলাইনে অর্ডার করা... কিছু বেসিক বিষয় তাঁদের শেখাতে পারি কি না, তার চেষ্টা করছি। এতে এঁদের অসহায়তা ও একাকিত্ব অনেকটাই ঘুচবে। হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপে অনেকেই কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। এতে যেমন ওঁরা মনের খোরাক পান, তেমনই মনের ভারও লাঘব হয় কথা বলে।’’

• বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বহাল রাখতে হবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গেই দিনে অন্তত দু’তিনবার কথা বলতে পারেন। প্রয়োজনে তাঁদের একবার বলে দেখতে পারেন, আপনার দরকারের ওষুধটা তিনি কিনে দেবেন কি না। আশপাশের মানুষের উপরে একটু ভরসা করতে হবে।

• সন্তান দূরে আছে, চিন্তা করবে বলে অনেক মা-বাবাই শারীরিক অসুস্থতা বা সমস্যার কথা এড়িয়ে যান। মনে রাখবেন, এতে সন্তানের দুশ্চিন্তাও বাড়ে। তিনি যদি জানেন যে, আপনি সমস্যার কথা তাঁকে বলেন না, তা হলে আপনি ভাল থাকলেও তিনি অহেতুক চিন্তা করবেন। হয়তো ভাববেন যে, আপনি সত্যি গোপন করছেন। তাই সন্তানের সঙ্গে সব কথা শেয়ার করুন। কোনও বিষয় নিয়ে উদ্বেগ হলে সন্তানকে বলুন। আপনিও সুরাহার পথ পেয়ে যাবেন।

• শহরে ও রাজ্যে এমন অনেক সংস্থা আছে, যাঁরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহায্যে তৎপর। সন্তানরা বাইরে থেকেও এ রকম সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ধরনের সংস্থার সদস্যরা বয়স্কদের ওষুধ পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে রান্না খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজও করছে। আবার অনেক বিদেশি এ দেশের অনেক বয়স্ক মানুষকে অ্যাডপ্টও করে থাকেন। পেরেন্ট অ্যাডপ্ট করার কনসেপ্ট আমাদের দেশে সে ভাবে না থাকলেও দুঃস্থ বয়স্কদের দায়িত্ব অনেকেই নেন। যাঁরা অর্থসাহায্য পাঠিয়ে দিলে সেই সংস্থার তরফে সেই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার বাড়িতে রেশন ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয়।

• প্রত্যেক পাড়ায় এমন অনেক নবীন আছেন, যাঁরা পাড়ার বয়স্কদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। একে একে এগিয়ে এলেই কিন্তু তাঁদের সমস্যা অনেকটাই দূর করা যায়। পাড়ায়, আবাসনে বয়স্করা থাকলে তাঁদের কিছু লাগবে কি না খোঁজ নিন। ফোন করে দুটো কথা বলুন। প্রয়োজনে আপনাকে ফোন করতে পারেন, এই পাশে থাকার আশ্বাসই তাঁদের কাছে অনেক। মনে বল পাবেন তাঁরা।

সমাজের ছাদ কিন্তু প্রবীণরাই। তাই অসময়ে তাঁদের পাশে স্তম্ভের মতো যদি দেশের যুবারা দাঁড়াতে পারেন, তবেই সেই ছাদ মজবুত হবে। আখেরে মাথার উপরে ছাদ থাকবে গোটা সমাজের।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus in India Senior Citizens
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy