এখনও অনেকেই খুচরোর বদলে টফি দিয়ে দিতে চান। প্রতীকী ছবি।
এ যেন অর্থনীতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা অন্য এক অর্থনীতি। বছর খানেক আগেও মুদি-সদয় থেকে দশকর্ম, নানা দোকানে খুচরো না থাকলে ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত সমমূল্যের টফি কিংবা ক্যান্ডি। ক্রেতা ডায়াবিটিসের রোগী হলেও এই ‘লজেন্স মুদ্রা’ না নিয়ে উপায় ছিল না। কোভিড আসার পর অবশ্য কিছুটা বদলে গিয়েছে ছবি। মাস্কের সঙ্গে আর যে বিষয়টি ছেয়ে গিয়েছে বাজারে, তা হল ‘ইউপিআই’ ব্যবস্থা। লেনদেনের সময়ে স্পর্শ এড়াতে ই-রিকশা থেকে পান-বিড়ির দোকান, সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে সাদা-কালো ‘কিউআর কোড’। আর ডিজিটাল লেনদেন মানেই খুচরোর সমস্যা গায়েব। কারও কারও মতে, ‘গুগল পে’, ‘ফোন পে’ কিংবা ‘পেটিএম’-এর এই বাড়বাড়ন্তে ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে ‘টফি অর্থনীতি’।
একটি অর্থলগ্নিকারী সংস্থার কর্তা অভিষেক পাতিল সম্প্রতি দাবি করেন, গত দশকে চকোলেট ও টফি উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি খুবই লাভের মুখ দেখেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে আচমকাই ধাক্কা খায় সেই বৃদ্ধি। পাতিল এই ঘটনার জন্য দায়ী করেন ইউপিআই ব্যবস্থার বহুল প্রচলনকে। তাঁর দাবি, খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে এই বদল খুব একটা বড় মনে না হলেও সামগ্রিক ভাবে এটি বেশ বড় একটি পরিবর্তন।
খুচরো ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বিষয়টির সঙ্গে সহমত। নিউ মার্কেট চত্বরে একটি ছোট স্টেশনারি দোকান চালান আফতাব আলম। আক্ষেপের সুরে আফতাব জানান, “টফি বিক্রি কমেছে তো বটেই। আগে দিনে অন্তত ৫০-৬০ টাকার টফি বিক্রি হয়ে যেত খুচরোর বদলে। এখন সেটা হয় না।” তবে কোভিডের সময়ে বাজার যতটা বসে গিয়েছিল, সেই তুলনায় এখন অনেকটাই ভাল হয়েছে বাজার, মত তাঁর। দক্ষিণ কলকাতার একটি ওষুধের দোকানের কর্মী পরেশ সাহা জানান, আগে নগদে ওষুধ কিনতে গেলে গলা খুসখুস কমানোর টফি কিংবা হজমি দিয়ে দিতেন তাঁরা। এখন সে সব অনেকটাই কমে গিয়েছে।
তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। চাঁদনি চকে পান-বিড়ির দোকান চালানো রবি সাউ জানান, কোভিডোত্তর কালেও লেনদেনের মাধ্যম বদলাননি তিনি। মোবাইলে টাকা নেন? প্রশ্ন শুনেই তাঁর সাফ কথা, “না না, আমাদের ও সব নেই। যা লেনদেন হবে, সব নগদ।”
রবির দোকান থেকে সিগারেট কিনছিলেন শুভ্রনীল বাগচী। টফি বনাম ইউপিআই-এর যুদ্ধে পক্ষ নিতে নারাজ তিনি। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী শুভ্রনীল বলেন, “সিগারেট কিনতে গেলে খুচরোর সমস্যা খুব বেশি হয়।” এমনিতে বাড়ির জন্য মুদি বাজার করতে গিয়ে যদি খুচরোর বদলে দোকানদার টফি দেন, তবে বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু অফিস থেকে সিগারেট কিনতে বেরিয়ে পকেট ভর্তি করে টফি নিয়ে ফেরা বড়ই বিড়ম্বনার বলে বক্তব্য যুবকের। তবে ইউপিআই আসার পর সব কিছু বদলে গিয়েছে বলে মনে হয় না তাঁর। শুভ্রনীল বলেন, “খুব একটা আলাদা কিছু দেখছি না। এখনও অনেকেই টফি দিয়ে দিতে চান। তা ছাড়া, অনেক জায়গায় কিউআর কোড থাকলেও দোকানদারেরা নগদ টাকাই নেন।”
কলকাতার বাইরে নগদ লেনদেনের প্রবণতা আরও বেশি। কৃষ্ণনগরে কাছে বাড়ির সামনেই একটি মুদি দোকান চালান মমতা বিশ্বাস। দুই কন্যার মা মমতা জানান, তাঁর দুই মেয়েই ‘মোবাইলে টাকা নিতে পারে’। কিন্তু তিনি এখনও বিষয়টিতে সড়গড় নন। তাঁর বক্তব্য, “গ্রামের মানুষ নগদে কেনাকাটা করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।” তাই কোভিডের সময়ে কিছু দিন মোবাইল ব্যবহার করলেও এখন আর সে সব নেই। ফলে খুচরো না থাকলে তার বদলে টফি দিয়ে দেওয়ার চলও রয়েছে।
ইউপিআই-এর ধাক্কায় টফি বিক্রি কমে যাওয়ার যুক্তি মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদদের অপর একটি অংশও। একটি অর্থলগ্নিকারী সংস্থার সিইও দীপক শেনয় সমাজমাধ্যমে এ প্রসঙ্গে শীর্ষস্থানীয় একটি চকোলেট সংস্থার বার্ষিক আয়ের হিসাব প্রকাশ করেছেন। সেই হিসাব বলছে, ২০২০-তে সংস্থার আয় কমলেও ২০২১-২২ অর্থবর্ষে লাফিয়ে বেড়েছে আয়। সে হিসাব দেখলে অনেকেই মনে করবেন, টফি আর ডিজিটাল লেনদেনের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক এখনই থামার নয়। ডিজিটাল লেদদেন সব জায়গায় যথেষ্ট জনপ্রিয় না হওয়া পর্যন্ত অন্তত কলকাতা ও আশপাশে টফি-মুদ্রার বাজার খারাপ হবে বলে মনে করেন না অধিকাংশ ক্রেতা ও বিক্রেতাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy