•নয়নিকার আট বছরের মেয়ে হিয়া যখন সে দিন মিষ্টি গলায় ‘জামাইকান ফেয়ারওয়েল’ ধরল, দিতির বুকের ভিতরটা কেমন যেন চিনচিন করে উঠল...
•শ্রীতমারা নিউ জার্সি নিবাসী। ছুটিতে কলকাতায় এসে বন্ধুদের আড্ডায় ওঁর ছেলে সাম্য যখন পরপর আবৃত্তি করে গেল বাংলা কবিতা, তখন বাকিদের মনে একটা না-পারা যেন খোঁচা দিয়ে গেল...
•তৃণা মেয়েকে ভর্তি করেছে কলকাতার নামীদামি এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। নার্সারিতে প্রথম দিনেই ছোট্ট মোহর দেখে ক্লাসটিচার শুধু ইংরেজিতেই কথা বলছে। কিন্তু মোহর তো বাড়িতে বাংলায় কথা বলে। ম্যাম কী বলছে, তা ভাল বুঝতে পারছে না ছোট্ট মেয়েটি...
সন্তানকে প্লে স্কুল ছেড়ে বড় স্কুলে ভর্তি করানোর সময়ে ভাষা নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন অনেক মা-বাবাই। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরা যখন ইংরেজি মাধ্যম বড় স্কুলে যায়, সেখানে মানিয়ে নেওয়ার পথে অনেক সময়েই বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষা। তার পর স্কুলের দৌড়ে ইংরেজি ভাষায় স্বচ্ছন্দ হতে হতে একটা সময় আসে, যখন দেখা যায়, যে বাংলা ভাষাটাকে আঁকড়ে তার বড় হওয়া, তার সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব কখন যেন তৈরি হয়ে গিয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে উল্টো সমস্যাও দেখা যায়। সেখানে বাংলার জোর বেশি এবং ইংরেজি কোণঠাসা।
তবে অধিকাংশ বাঙালি বাবা-মা-ই কিন্তু চান, তাঁর সন্তান যতটা ভাল ওয়র্ডসওয়র্থ আবৃত্তি করবে, ততটাই ভাল জীবনানন্দ দাশ। আর সেটা করা খুব সহজ কাজও নয়। কারণ তার জন্য দরকার দুটো ভাষার প্রতি ভালবাসা এবং শেখার নিষ্ঠা। আর সন্তানকে শেখানোর দায়িত্বটা নিতে হবে বাবা-মাকেই।
এখন অনেক বাচ্চাই পড়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। বাবা-মায়েদের ইচ্ছে, ছোট থেকেই সন্তান যেন গড়গড় করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে ফারাক তো চিরকালই। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার থেকে আদ্যন্ত ইংরেজি কালচারে মোড়া স্কুলে যখন একটি শিশু যায়, তখন কিন্তু তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া তিন-চার বছরের সেই বাচ্চাটির পক্ষে খুব একটা সহজ নয়। টিচারের দেওয়া ছোট ছোট নির্দেশ সে বুঝতে পারছে, কিন্তু ইংরেজিতে মনের ভাব প্রকাশ করা, তা সে কী ভাবে করবে? আবার অনেক সময়েই দেখা যায়, ক্লাসে বাকিদের মতো ইংরেজির তালে তাল মেলাতে না পেরে, কোনও কোনও বাচ্চা হয়তো বিদেশি ভাষাটি থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে।
তাই শিশুটির সঙ্গে ভাষার বন্ধুত্ব স্থাপন জরুরি। তার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হল, বাচ্চাকে প্রতিনিয়ত সেই ভাষা শোনানো। বাড়ির সদস্যদের মুখে বাংলা শুনে সে যেমন বলতে শেখে, সে ভাবেই ইংরেজিও শোনাতে হবে। ইউটিউবে বাচ্চাদের যে ছোট ছোট নানা রকম গল্প রয়েছে, তা রোজ নিয়ম করে শোনান। সেই সঙ্গে ওকে সুন্দর ছবি দেওয়া গল্পের বইও কিনে দিন। প্রথমে বাচ্চাকে তা পড়ে শোনান কয়েক দিন। তার পর ওকে পড়তে বলুন। টিভিতে কার্টুন বা ওকে আকৃষ্ট করে এমন নানা ধরনের অনুষ্ঠান ওকে দেখতে দিন, সে সবের ভাষা যেন অবশ্যই হয় ইংরেজি। শুধু গল্প শোনানোই নয়, বাড়িতে ওর সঙ্গে সব সময়ে ইংরেজিতে কথা বলতে চেষ্টা করুন। যদি সেটা সম্ভব না হয়, তা হলে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় রাখুন, যখন আপনারা ওর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবেন এবং ওকেও সব কথা ইংরেজিতে বলতে হবে। একটা বাংলা শব্দও সে তখন ব্যবহার করতে পারবে না। এ ভাবে কথা বলতে বলতে ইংরেজি বলার আড়ষ্টতা কাটবে। তবে প্রথমেই ওর ভুল ধরতে যাবেন না। আগে ওকে বলতে দিন। তার পর শুধরে দিন। গল্প শোনানোর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি রাইমস, গানও শোনান। তবে সন্তান কতক্ষণ ইউটিউব দেখবে বা কার্টুন দেখবে, তার সময় যেন বাঁধা থাকে। কারণ অতিরিক্ত দেখলে নেশা হয়ে যাবে। যত ও ইংরেজি শুনবে, ততই ওর ভাষার সঙ্গে সখ্য তৈরি হবে।
এর পর ধীরে ধীরে একটা সময় আসে, যখন স্কুলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে ইংরেজিটা আর ভিনদেশি মনে হয় না। তখন দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় শৈশবের সেই অবলম্বনটির সঙ্গে। ‘কঠিন’ মনে হতে থাকে বাংলা। কিন্তু সেটাও কি হতে দেওয়া উচিত? এ ক্ষেত্রেও উপায় সেই একই— শোনা। বাচ্চাটি বাংলা গল্প পড়তে না-ও চাইতে পারে। তাই ওকে গল্প পড়ে শোনান। একবার আকর্ষণ তৈরি হলে, ও বাংলা গল্প পড়বেই। কবিতা, গান শোনান মাঝেমাঝে। সন্তান হয়তো খেলছে বা আঁকছে, আপনি গান বা আবৃত্তি চালিয়ে দিলেন। ওর কানে কিন্তু পৌঁছবেই। সেই সঙ্গে বাংলা উচ্চারণ স্পষ্ট করতে ও শব্দভাণ্ডার বাড়াতে আরও একটা উপায় হতে পারে আবৃত্তি। কবিতা বলার মধ্য দিয়ে যেমন ওর সঙ্গে বাংলার যোগসূত্র তৈরি হবে, তেমনই মনে রাখার ক্ষমতাও বাড়বে। অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক থাকলে, ওকে নাটকও শেখাতে পারেন।
তবে বাংলা এবং ইংরেজি দুই ক্ষেত্রেই বাচ্চাকে প্রথমেই ব্যাকরণের জটিলতার মধ্যে নিয়ে যাবেন না। ইংরেজির ক্ষেত্রে ছোটখাটো ব্যাকরণগত ভুল মাফ করে কথা বলায় সড়গড় হতে সাহায্য করুন। ধীরে ধীরে ও ঠিকটা শিখেই যাবে। বাংলার ক্ষেত্রে খুব কঠিন কিছুর মধ্যে সন্তানকে নিয়ে যাবেন না। আগে ভালবাসাটা তৈরি হওয়া জরুরি। এবং সেটা করতে পারেন আপনারাই। দেখা এবং শোনা, এই দুইয়ের মধ্য দিয়েই বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে ভাষার সঙ্গে। আর মনে রাখবেন শেখাটা যত কম বয়সে হবে, তত তাড়াতাড়ি সে তা আয়ত্ত করবে।
মডেল: তিয়াশা পাল, ত্বরিতা চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy