প্রতীকী ছবি।
স্কুল শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা কতটা শুরু করতে পেরেছে তাদের স্কুলজীবন? এত দিন পরে স্কুলে যাওয়ার উত্তেজনা যেমন আছে, তেমনই দীর্ঘ অনভ্যেসে স্কুলের প্রতি অনেকে আগ্রহও হারিয়ে ফেলছে। খারাপ হচ্ছে হাতের লেখা। গুগল, ইউটিউবের উপরেও এত দিন ছিল নির্ভরতা। সেখানে ক্লাসরুমে বসে আবার পরীক্ষায় দেওয়ার জন্য তারা কি প্রস্তুত?
স্কুলভেদে চিত্র ভিন্ন
শহুরে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যারা এত দিন মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপে স্কুলের সঙ্গে সংযোগ রেখে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে, তাদের পড়াশোনায় তেমন ছেদ পড়েনি। বরং স্কুলে যাওয়ার উত্তেজনা বেড়েছে। যোধপুর বয়েজ়ের প্রধানশিক্ষক অমিত সেন মজুমদার বললেন, ‘‘ওরা স্কুলে আসার ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। উপস্থিতির হারও বেশ ভাল। প্রথম দিকে আমরা রোল নম্বর ধরে অড নম্বর ও ইভেন নাম্বার স্টুডেন্টদের আলাদা দিনে ডেকে ক্লাস করাচ্ছিলাম, যাতে ওদের সমস্যা হলে ছাত্রবিশেষে নজর দেওয়া যায়। কিন্তু দু’-এক দিন পর থেকেই ওরা বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ক্লাস করতে শুরু করেছে। ফলে সকলকে নিয়েই ক্লাস চলছে। তবে গত বার স্কুল খোলার পরে পরীক্ষা নেওয়ার প্রসঙ্গ উঠতে অনেকে রাজি হয়নি।’’ অনলাইনে পরীক্ষা দিতে তারা বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছে।
আর একটি চিত্র তুলে ধরলেন শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া নাগ (সিংহ মহাপাত্র)। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলেমেয়েরা স্কুলে এলেও কেমন যেন ঝিমিয়ে আছে। আগে এসে যেমন দৌড়াদৌড়ি করত, সেটা অনেক কম। লেখার স্পিডও কমে গিয়েছে। এক পাতা লিখতেই যেন হাঁপিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয়, কেমন ব্যবহার করতে হয়, সে সবও যেন ভুলে গিয়েছে। পড়াশোনার দিক দিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। একটা ক্লাসে ছাত্রীরা বিভিন্ন রকম পরিবার থেকে আসে। কোনও পরিবার হয়তো লকডাউনে সন্তানের পড়াশোনার যত্ন নিয়েছে, সে এগিয়ে গিয়েছে। কেউ হয়তো সেই যত্নটা পায়নি, সে পিছিয়ে গিয়েছে। কারও ডিজিটাল আসক্তি বেড়েছে। ফলে তাদের প্রত্যেকের দিকে নজর রেখে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এগোতে হচ্ছে।’’
সমস্যা রয়েছে বাড়িতেও
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘আসলে রোজ স্কুলে যাওয়ার অভ্যেসটা এদের নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম স্কুল খোলার উত্তেজনায় দু’একদিন স্কুলে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার পর দেখছে, স্কুলে গেলেও ব্যাপারটা বেশ কঠিন। একে ক্লাসে টানা বসে থাকা, তার উপরে লেখালিখি। অনেক বাচ্চারা তো সকালে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠতে পারছে না বলে স্কুল কামাই করছে। রাতে একটা-দেড়টা অবধি জেগে থাকার অভ্যেস রয়ে গিয়েছে অনেকের।’’ ফলে ঠিক সময়ে ঘুম না ভাঙার জন্যও কামাই হয়ে যাচ্ছে।
তাদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ নষ্ট করার উপায়ও রয়েছে অনেক। তার মধ্যে অন্যতম ডিজিটাল জগৎ। কেউ রিল বানাচ্ছে, কেউ সিনেমায় আসক্ত। সব মিলে ছাত্রছাত্রীরা চট করে একটু বেশি পরিণত হয়ে গিয়েছে। এ দিকে পড়াশোনায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
অনেকের মা-বাবারও অফিস শুরু হয়েছে। ফলে সন্তানের দিকে হয়তো ততটা নজর দিতে পারছেন না। সেই ফাঁকে সে-ও সুযোগ নিচ্ছে। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে যে সময়টা পড়ার কথা, তখন হয়তো বসে টিভি দেখছে। ফলে পড়াশোনার অভ্যেসও নষ্ট হচ্ছে।
সমাধান কোন পথে?
প্রথমেই ছেলেমেয়েদের রুটিন মানা জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। সকালে ছ’টায় ঘুম থেকে ওঠা। তার পরে দরকার একটু ব্যায়াম, মেডিটেশন। স্কুলের জন্য প্রস্তুত হওয়া, স্কুল থেকে ফিরেই খেয়েদেয়ে নাচ বা গানের কোনও ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলে ভাল। যেটা ওর ভাল লাগবে, এমন কোনও ক্লাসে ভর্তি করতে পারেন। তার পরে ওকে টাস্ক দিয়ে রাখতে হবে। মা-বাবা যদি অফিসে থাকেন, তা হলে বাড়িতে যে থাকবে, তার উপরে দায়িত্ব দিন যে সন্তান টাস্কটা করছে কি না সেটা যেন সে খেয়াল রাখে।
রাতে খেয়েদেয়ে এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়ার অভ্যেসও করতে হবে। ঘুম না এলেও এগারোটা বাজলেই বেডটাইম, সেটা বুঝিয়ে দিন। মোবাইল ফোন যেমন সন্তানও দেখবে না, তেমন মা-বাবাকেও রাতে তাদের সামনে ফোন দেখার অভ্যেসটা ছাড়া জরুরি। কারণ সন্তান যদি সমান সুযোগ পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তা হলে অভ্যেস ছাড়াতে মা-বাবাকেও সেই পথ দেখাতে হবে।
পায়েল আর একটি গুরুত্বপূণ দিকও মনে করালেন, ‘‘পড়াশোনার জন্যও ডিজিটাল আসক্তি কাটাতে হবে। অনেক প্রশ্নের উত্তরের জন্য অনেকেই গুগল বা ইউটিউবে ভরসা রাখেন। এ বার কিন্তু বই পড়ায় মন দিতে হবে। উত্তর খুঁজতে হবে ছাপার অক্ষরে। সে রকম হলে যে উত্তরটা নেটে ভাল পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রিন্টআউট করে নোট করে রাখা যায়। কিন্তু দরকার হলেই গুগল করে দেখে নিচ্ছি, এই অভ্যেস ছাড়তে হবে। তবেই স্কুলে বা পরীক্ষাহলে নিজে থেকে ঠিক উত্তরটা লেখার ভরসা পাবে সে।’’ ডিজিটাল জগতের ভরসায় ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাসও ঠেকছে তলানিতে। যে উত্তরটা সে জানে, তার জন্যও বারেবারে নেট সার্চ করে যায় অনেকে।
তবে স্কুলেও বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য। পাপিয়া নাগ (সিংহ মহাপাত্র) যেমন বললেন, ‘‘প্রত্যেক ক্লাসের শুরুতে ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা হয়। কেউ গান গাইলে তাকে হয়তো একটা গান শোনাতে বলছি। ওদের মানসিক বিকাশ দরকার আগে। ওদের মনের উপরে কিন্তু একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। তাই আগে মনটা ভাল করে তুলতে হবে। তার পরে পড়াশোনা। স্কুলে প্যারেড, শারীরচর্চার ক্লাস শুরু করছি। কারণ ছেলেমেয়েরা বসে থেকে-থেকে ওদের মধ্যে ওবেসিটিও চলে এসেছে। তার সঙ্গে কিছু অ্যাক্টিভিটি করতে হবে। এক দিন যেমন ওরা ডাকাত, পুলিশ... এ রকম নানা চরিত্র সেজে এসেছিল। খুব আনন্দ পেয়েছে সে দিন সকলে।’’ মাঝেমাঝে এ রকম নাচ, গান, নাটকের মতো অ্যাক্টিভিটি করানো হলেও ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছেটা তৈরি হবে। তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে আগের মতো একটা বোঝাপড়ার সম্পর্কও তৈরি হবে।
দু’বছরের ই-স্কুল স্বাভাবিক স্কুলজীবনের অভ্যেস যে খানিক নষ্ট করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে অভিভাবকদেরও উদ্যোগী হতে হবে এ বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy