প্রতীকী ছবি।
কারও মাথার সামনে, কারও বা পিছনে বিরাট মাংসপিণ্ড। কারও আবার শিরদাঁড়ার উপরে। টিউমারের মতো ওই মাংসপিণ্ডের ভিতরে থাকে মস্তিষ্ক বা শিরদাঁড়া থেকে বেরিয়ে আসা স্নায়ুর অংশ। এ হেন সমস্যা নিয়ে জন্মানো শিশুদের প্রাণের ঝুঁকি এড়াতে তড়িঘড়ি অস্ত্রোপচার করতে হয়। গর্ভাবস্থার ঠিক সময়ে ফলিক অ্যাসিড না খাওয়াই এই ‘নিউরাল টিউব ডিফেক্ট’ (এনটিডি)-এরঅন্যতম কারণ বলে মত চিকিৎসকদের।
এ দেশে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে পাঁচ জন ‘এনটিডি’-তে আক্রান্ত হয়। যাদের ৫০ শতাংশেরই রোগের কারণ ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি। এ ছাড়া, জিনগত ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণেও এই রোগ হয়। শহরের শিশু-স্নায়ু শল্য চিকিৎসক এবং স্ত্রী-রোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘গর্ভবতী হওয়ার পরে নয়, গর্ভধারণের পরিকল্পনার সময় থেকেই ফলিক অ্যাসিড খেতে হবে।’’ আগাম সুরক্ষা হিসেবে খাদ্যদ্রব্যে ফলিক অ্যাসিড মেশানোর সরকারি উদ্যোগের দাবিও জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ফলিক অ্যাসিডকে সুরক্ষা-কবচ হিসেবে বেশি করে ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্বের ১০ জন শিশু-স্নায়ু শল্য চিকিৎসককে জোটবদ্ধ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
ওই চিকিৎসকেরা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে নিজেদের প্রস্তাব তুলে ধরছেন। সেই জোটের সদস্য তথা ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব পেডিয়াট্রিক নিউরো সার্জারি’র সভাপতি, চিকিৎসক সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘খুব সহজেই নুনে ফলিক অ্যাসিড মেশানো যায়। ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছে। এ বার লক্ষ্য, ভারত। তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে কেন্দ্রকে রাজি করানোর চেষ্টা করছি।’’
এ রাজ্যেও ‘এনটিডি’ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, যার প্রমাণ এসএসকেএমের পরিসংখ্যান। গত বছর আক্রান্ত হয়েছিল ৪৬ জন। এ বছর অস্ত্রোপচার হয়েছে ২২ জনের। অস্ত্রোপচারে প্রাণের ঝুঁকি কমলেও বুদ্ধির বিকাশ আটকে যাওয়া, হাঁটাচলায় সমস্যা, প্রস্রাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকা, পিঠ বেঁকে যাওয়ার মতো কিছু শারীরিক সমস্যা থেকে যায়।
পিজির শিশু-স্নায়ু শল্য চিকিৎসক কৌশিক শীল জানাচ্ছেন, গর্ভাবস্থার এক মাসে ভ্রূণের মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়া তৈরি হয়ে যায়। সেই সময়ে কোনও গোলমাল হলে মস্তিষ্ক বা শিরদাঁড়ার কোথাও একটা ফাঁক তৈরি হয়ে স্নায়ুর অংশ বেরিয়ে আসে। সেটাই ‘এনটিডি’। তিনি বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই জানা যাচ্ছে, প্রসূতি তিন মাস বা তার পর থেকে ফলিক অ্যাসিড খেয়েছেন। কারও ক্ষেত্রে সেটাও অনিয়মিত। তাতেই শিশু ‘এনটিডি’ নিয়ে জন্মাচ্ছে।’’ গর্ভসঞ্চার হওয়ার পরে দেশের যে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলে বিনামূল্যে ফলিক অ্যাসিড মেলে। এ রাজ্যে আশাকর্মীরা তা বাড়িতে পৌঁছে দেন। কিন্তু তত দিনে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। সন্দীপ বললেন, ‘‘চার সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণের শিরদাঁড়া তৈরি হয়ে যায়। তাই ছ’সপ্তাহ কিংবা তার পরে ফলিক অ্যাসিড খেয়ে লাভহয় না।’’
স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, মস্তিষ্ক থেকে শিরদাঁড়ার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত অংশকে বলা হয় নিউরাল টিউব। তিন মাসেই গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক গঠন তৈরি হয়ে যায়। এর পরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে। মল্লিনাথের কথায়, ‘‘এনটিডি আটকাতে সন্তানধারণের পরিকল্পনার সময় থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নির্দিষ্ট ডোজ়ের ফলিক অ্যাসিড খাওয়া শুরু করাপ্রয়োজন।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এনটিডি ঠেকাতে আমেরিকা, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডে ধান-গমের মতো শস্যে বা নুনে ফলিক অ্যাসিড মেশানো হচ্ছে। তাতে ওই সমস্ত দেশে এনটিডি-র হার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।
এক সময়ে দেশে থাইরয়েড-জনিত রোগ গলকম্বলের প্রকোপ বেশি ছিল। যার বড় কারণ আয়োডিনের ঘাটতি। মল্লিনাথ বলছেন, ‘‘সেই ঘাটতি মেটাতে নুনে আয়োডিন মেশানো হল। তাতে গলকম্বলের সমস্যা কমতে শুরু করল। একই ভাবে ফলিক অ্যাসিড খাবারে মিশিয়ে এনটিডি অনেকাংশে দূর করা যেতে পারে।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ফলিক অ্যাসিড-মিশ্রিত খাবার খেলে যে কোনও সমস্যা নেই, তা পরীক্ষায় প্রমাণিত। বরং তা সুস্থ শিশুদের জন্মাতে সাহায্য করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy