Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
Christmas in Park Street

‘বিদেশকেও হার মানায় বড়দিনের পার্ক স্ট্রিটের উন্মাদনা!’ কেক-পার্বণ শুরুর মুখে বলছেন শেফ

পার্ক স্ট্রিট হল বাঙালির হাতের কাছের ‘লন্ডন’। সাতসকালে ফ্লুরিজ়ের সাহেবি কেতায় সাজিয়ে দেওয়া প্রাতরাশের থালা সেই সাহেবিয়ানার অঙ্গ। বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটের দোকান থেকে শৌখিন বাক্সে মোড়া কেক-কুকিজ়-পেস্ট্রি কিনেও ‘বাজেট ফ্রেন্ডলি’ সাহেবিয়ানার স্বাদ নেয় বাঙালি।

বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট।

বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট। ছবি : পিটিআই।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০০
Share: Save:

উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে এক তরুণ কলকাতায় এলেন হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়তে। নতুন শহর, বন্ধুরা তাঁকে বড়দিনে বেড়াতে নিয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটে। নিজের রাজ্যে ঘরের কাছে আগ্রা। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের তাজমহল কবেই দেখে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটে এসে তাঁর মনে হল, বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্যটি দেখছেন— বড়দিনে কেক কেনার জন্য এমন পাগলের মতো হুড়োহুড়ি করতে পারে মানুষ! তা-ও আবার এমন এক শহরে, যেখানে ক্রিসমাস মূল উৎসবই নয়! শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যাও নামমাত্র। উত্তরপ্রদেশেও দশেরা, দীপাবলি হয়। কিন্তু সেই সময় লাড্ডু কেনার জন্য ভিন্ন ধর্মের মানুষজনকে এমন লাইন দিতে তো দেখেননি। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধর্মের উৎসবে এ ভাবে মেতে ওঠা যায়!

 ভিন্ন এক ধর্মের উৎসবে এ ভাবে মেতে ওঠা যায়!

ভিন্ন এক ধর্মের উৎসবে এ ভাবে মেতে ওঠা যায়! —নিজস্ব চিত্র।

সে দিন পার্ক স্ট্রিটের সাহেবি রেস্তরাঁর কাচের দেওয়ালের বাইরের যে দৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের তরুণ, আজও তিনি সেই একই দৃশ্য দেখেন ওই কাচের দেওয়ালের ভিতর থেকে। তবে এখন আর বিস্মিত হন না। গত ১৩ বছর ধরে পার্ক স্ট্রিটের বৈগ্রহিক রেস্তরাঁ ফ্লুরিজ়ের রান্নাঘরের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। ফ্লুরিজ়ের এগ্‌জ়িকিউটিভ শেফ বিকাশ কুমার বলছেন, ‘‘কাজের সূত্রে কম দেশে তো ঘুরিনি! এমন দেশেও গিয়েছি, যে দেশের প্রধান উৎসবই ক্রিসমাস। অথচ সেখানেও এমন উন্মাদনা দেখিনি। ফ্লুরিজ়ের ওই কাচের জানলা দিয়ে যে ক্রিসমাসের পার্ক স্ট্রিটটকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, তেমন অভিজ্ঞতা আর কোথাও হয়নি। ওই আবেগও কোথাও দেখিনি।’’

গত ১৩ বছর ধরে পার্ক স্ট্রিটের বৈগ্রহিক রেস্তরাঁ ফ্লুরিজ়ের রান্নাঘরের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। ফ্লুরিজ়ের এগজ়িকিউটিভ শেফ বিকাশ কুমার।

গত ১৩ বছর ধরে পার্ক স্ট্রিটের বৈগ্রহিক রেস্তরাঁ ফ্লুরিজ়ের রান্নাঘরের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। ফ্লুরিজ়ের এগজ়িকিউটিভ শেফ বিকাশ কুমার। —নিজস্ব চিত্র।

পার্ক স্ট্রিট হল বাঙালির হাতের কাছের ‘লন্ডন’। সাতসকালে ফ্লুরিজ়ের সাহেবি কেতায় সাজিয়ে দেওয়া প্রাতরাশের থালা সেই সাহেবিয়ানার অঙ্গ। বড়দিনে পার্ক স্ট্রিটের দোকান থেকে শৌখিন বাক্সে মোড়া কেক-কুকিজ়-পেস্ট্রি কিনেও ‘বাজেট ফ্রেন্ডলি’ সাহেবিয়ানার স্বাদ নেয় বাঙালি। বাঙালির সেই আবেগে গা ভাসায় পার্ক স্ট্রিটের বহু রেস্তরাঁও। বড়দিনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই রেস্তরাঁয় রেস্তরাঁয় চলে ‘কেক মিক্সিং’ পর্ব। কাজুবাদাম, কিশমিশ, চেরি, আখরোট, খেজুর, পেঠা-র পাহাড়ে ধুলোঝড় তোলে দারচিনি আর শুকনো আদার মিহি গুঁড়ো। সঙ্গে কোথাও মেশে ফলের রস, কোথাও ওয়াইন। ছোট-বড়-মাঝারি— সব বয়সের হাত কাগজের দস্তানা পরে ডুব দেয় সেই শুকনো ফলের ‘পাহাড়’কে আগাপাশতলা ঘেঁটে দিতে। শেষে সেই ‘পাহাড়ের’ মণ্ড দিয়ে তৈরি হয় ক্রিসমাস কেক। যে কেক কিনতে বড়দিনের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই লাইনে দাঁড়ান মানুষ। ভুরভুরে কেক-কুকিজ়ের মৌতাতে ভরা তেমনই এক কেকমিক্সিংয়ের সন্ধ্যায় বিকাশকেও দেখা গেল তাঁর সহকর্মী এবং ফ্লুরিজ়ের শেফদের টিমকে সঙ্গে নিয়ে কেক মিক্সিং করতে।

সাতসকালে ফ্লুরিজ়ের সাহেবি কেতায় সাজিয়ে দেওয়া প্রাতরাশের থালা বাঙালির সাহেবিয়ানার অঙ্গ।

সাতসকালে ফ্লুরিজ়ের সাহেবি কেতায় সাজিয়ে দেওয়া প্রাতরাশের থালা বাঙালির সাহেবিয়ানার অঙ্গ। —নিজস্ব চিত্র।

উত্তরপ্রদেশের মানুষ, রান্না করেন খাঁটি বিদেশি সব পদ। বাঙালিদের জন্য কেক বানাতে কেমন লাগে? প্রশ্ন শুনে বিকাশ বললেন, ‘‘বাঙালিদের কেক যে কী আবেগ! তা বুঝেছিলাম সেই প্রথম দিন পার্ক স্ট্রিটে এসে। রেস্তরাঁর বাইরে লাইনের বহর দেখে ভেবেছিলাম, কিছু ‘ফ্রি’তে দেওয়া হচ্ছে বুঝি। ‘ফ্রি’ পাওয়ার আশায় আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। বাংলা জানতাম না। আমার এক বন্ধুই লাইনে দাঁড়ানো একজনকে প্রশ্ন করেছিল, ‘এখানে কী দেওয়া হচ্ছে?' তিনি বললেন, ‘বিনামূল্যে কিছু দেওয়া হচ্ছে না। এটা কেক কেনার লাইন।’ আমি তো বিশ্বাসই করিনি। ভেবেছিলাম, লাইন যাতে না বাড়ে সে জন্য আমাদের কাটানোর চেষ্টা করছে বোধ হয়। আরও এক জনকে জিজ্ঞাসা করতেও তিনি একই কথা বললেন। তার পরে লাইন ছেড়ে বেরিয়ে শুনলাম, সত্যিই মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কেক কিনছে। আর সেই কেকও নেহাত সস্তার কেক নয়। যথেষ্ট দামি! এমন কেকপ্রেমীদের জন্য কেক বানাতে ভাল লাগবে না? জানেন কি, গোটা দেশে বড়দিনে সবচেয়ে বেশি কেক বিক্রি হয় বাংলাতেই!’’

কাজুবাদাম, কিশমিশ, চেরি, আখরোট, খেজুর, পেঠা-র পাহাড়ে ধুলোঝড় তোলে দারচিনি আর শুকনো আদার মিহি গুঁড়ো।

কাজুবাদাম, কিশমিশ, চেরি, আখরোট, খেজুর, পেঠা-র পাহাড়ে ধুলোঝড় তোলে দারচিনি আর শুকনো আদার মিহি গুঁড়ো। —নিজস্ব চিত্র।

একটা সময় বাংলা বলতে না পারা বিকাশ এখন অবশ্য বাংলা বোঝেন। বলতেও পারেন অল্পসল্প। তবে বেশি ভালবাসেন বাঙালি রান্না খেতে। শুক্তোর ভক্ত তিনি। আরও অনেক বাঙালি পদই প্রিয়। কারণ, বিকাশের মতে, ‘‘বাঙালি খাবারের স্বাদে একটা ভারসাম্য থাকে। কোনও কিছুই বেশি নয়। চড়া নয়। একটা আলগা জিভে লেগে থাকা স্বাদ সব কিছুতে। তার একটা বড় কারণ হল, বাঙালিরা গোটা মশলার ব্যবহার করেন বেশি।’’ বাঙালি স্বাদের প্রতি ভাল লাগার প্রকাশ রয়েছে বিকাশের নিজস্ব রেসিপিতেও। বাঙালির তালমিছরি আর গন্ধরাজ লেবুর স্বাদ তিনি মিশিয়েছেন হোয়াইট চকোলেটে। সেই চকোলেট খেয়ে বাহবা দিয়েছেন কলকাতায় ফ্লুরিজ়ে খেতে আসা সাহেবসুবোরা। পছন্দ করেছেন বাঙালিরাও।

বাঙালি স্বাদের প্রতি ভাল লাগার প্রকাশ রয়েছে বিকাশের নিজস্ব রেসিপিতেও।

বাঙালি স্বাদের প্রতি ভাল লাগার প্রকাশ রয়েছে বিকাশের নিজস্ব রেসিপিতেও। —নিজস্ব চিত্র।

উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজের সূত্রে কলকাতায় এসে কি শহরটাকে ভালবেসে ফেললেন বিকাশ? শেফ বলছেন, ‘‘কলকাতায় আমি খুব কাছ থেকে দেখি পার্ক স্ট্রিটকেই। বড়দিনের রাতে ওই পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে আমার ভাল লাগে। বড়দিনের সপ্তাহে বহু বার রাতের কলকাতায় পার্ক স্ট্রিট ধরে হেঁটেছি। ভিড়ে পা মিলিয়েছি। তার পাশাপাশি এখানে আরও একটা বিষয় ভাল লাগে আমার। ক্রিসমাস এ শহরের মূল উৎসব না হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকার ওই উৎসবকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখে না। আলো দিয়ে সাজানো থেকে শুরু করে আলাদা করে ট্র্যাফিক সামলানোর ব্যবস্থা। অ্যালেন পার্কে সঙ্গীতানুষ্ঠান। আর কোথাও এমন দেখিনি। আর এখানেই কলকাতাকে বিশ্বের অন্য সব শহরের থেকে আলাদা লাগে আমার।’’

অন্য বিষয়গুলি:

christmas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy