Advertisement
E-Paper

Single Mother: একা মা-র রানিকাহিনি

তারকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমাজমাধ্যমের কুনাট্যগুলি তো বর্বরতা। কিন্তু বাকি সমাজের একক মায়েদের নিয়ে এত অস্বস্তি, এত মাথাব্যথা কেন?

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:৫৩
Share
Save

বিয়ের বন্ধনের বাইরে গিয়ে পুত্রসন্তানের মা হয়েছেন নুসরত জাহান। সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে তিনি নিশ্চুপ। তাতেই তুফান উঠেছে সমাজে। গোঁড়া চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরা নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে চিৎকার জুড়েছেন। আর যাঁরা নিজেদের তথাকথিত উদার দৃষ্টিভঙ্গির এবং সমাজমনস্ক বলে মনে করেন, তাঁরা একা মায়েদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায়। তারকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সমাজমাধ্যমের কুনাট্যগুলি তো বর্বরতা। কিন্তু বাকি সমাজের একক মায়েদের নিয়ে এত অস্বস্তি, এত মাথাব্যথা কেন?

রাগের উৎস পিতৃতন্ত্রের স্বার্থ

বিয়ের মাধ্যমে পুরুষের সম্পত্তি হোক নারী— এটাই পিতৃতন্ত্র চেয়েছে। তার আদেশ, সন্তানের নামে বাবা ও তার পরিবারের সিলমোহর থাকবে। সেই সন্তানের দ্বারাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার রক্ষিত হবে। নারী সন্তানের বাবার নাম জানাতে অস্বীকার করলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সম্পত্তির অধিকার রক্ষার পদ্ধতিতে গোলযোগ উপস্থিত হয়। তাই নারীর যৌনতার অধিকারকে দমিয়ে রাখতে আয়োজন আর চোখরাঙানির শেষ নেই।

কিন্তু সময় তো আর এই পিতৃতন্ত্রের অন্ধকূপের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে বদ্ধ থাকে না। তাই পুরুষের ভাত-কাপড়ের মুখাপেক্ষী না থেকে নারী যোগ্যতার বলে দারুণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। সমাজ যতই অপছন্দ করুক, শিক্ষা আর দক্ষতার জোরে নারীরা সেই সমাজেরই শীর্ষ স্থানে পৌঁছচ্ছেন। তখন তাঁরা অবলম্বন সন্ধানের জন্য নয়, ভালবেসে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে থাকছেন। বনিবনা না হলে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং নতুন মানুষের মধ্যে আবার প্রেম খুঁজে পেয়ে ভাল থাকছেন। সম্পত্তি রক্ষার দায় থেকে নয়, মাতৃত্বের সুখ আস্বাদনের জন্য প্রেমিকের ঔরসে অথবা বিজ্ঞানের সাহায্যে মা হচ্ছেন। স্বেচ্ছায় একক মায়ের সংখ্যা বাড়ছে। ‘‘পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়েরা মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছেন। পরিবারে ও সমাজে মেয়েদের এই পরিবর্তিত প্রাধান্য মেনে নিতেও আপত্তি,’’ বলছেন সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অমৃতা গুপ্ত।

পরিবারের ধারণাটাও বাঁধাধরা ছক মেনে চলছে না। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে থাকছে মেয়ে, তার ছোট ভাইটির বাবা হয়তো এই মানুষটি। যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রবল অশান্তি, সেখানে কি বাচ্চারা খুব আনন্দে বড় হয়? তার চেয়ে তো মায়ের নতুন পরিবারে যে মেয়েটি যত্নে থাকে, তার শৈশব অনেক সুন্দর! একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে, একক মায়েদের বাচ্চারা নাকি প্রবলেম চাইল্ড। মায়ের সঙ্গে একাধিক পুরুষকে দেখে, ছোট থেকে উচ্ছৃঙ্খলতা, নেশায় অভ্যস্ত... ইত্যাদি। মনোবিদরা বলছেন, যে কোনও ‘অসুস্থ’ পরিবারেই বাচ্চাদের লালনপালনে ত্রুটি থাকতে পারে। একটি শিশুর কুসন্তান হয়ে ওঠার কারণ একক অভিভাবকত্ব নয়, খারাপ অভিভাবকত্ব।

একা মায়েদের জবাব

সুপ্রিম কোর্টের রায়, পাসপোর্ট, আধার কার্ড, ভোটার কার্ডে শুধু মায়ের নাম দিলেই চলবে। আইন স্বীকৃতি দিলেও, সমাজ নানা বাধার সৃষ্টি করে। স্বেচ্ছায় একক মা হয়ে সন্তানকে বড় করতে গেলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ভীষণ জরুরি। চিত্রকর ঈলীনা বণিক এ বিষয়ে বললেন, ২০১২-য় আইভিএফ পদ্ধতিতে যখন মা হয়েছিলেন, তখন তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। সন্তান ছোট থাকতেই তাকে পিতৃপরিচয় জানিয়েছেন। সে সেটাই স্বাভাবিক মনে করে বড় হচ্ছে। তিনি বলেছেন, বিচ্ছেদ এখন জলভাত। অনেক পরিবারেই বাবা থাকেন না। ফলে, বন্ধুবৃত্তে মেয়ে সমস্যায় পড়েনি। স্বামীর নাম নেই কেন— হাসপাতালে ফিসফাস থামাতে পাশে ছিলেন সংবেদনশীল চিকিৎসক। শিক্ষিতমণ্ডলীর সহায়তায় বাচ্চার স্কুলে ভর্তির সময়কার বাধাটুকুও ভেঙেছেন। ঈলীনা বলছেন, ‘‘মানুষের মন বড় জটিল। বিয়ে, শারীরিক সম্পর্ক, মানসিক আকর্ষণ— এক ত্রিভুজে এসে না-ই মিলতে পারে। সন্তান যে ভাবেই আসুক, সে স্বাগত।’’

তবে একা মা-র পক্ষে সন্তান পালনের কাজটা কঠিন। স্কুল, প্লেডেট, পার্কে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের হাজার দায়দায়িত্ব রয়েছে। একাই প্রতি পদে সমাজের বিছিয়ে দেওয়া কাঁটাগুলোও পেরোতে হবে। ইন্টিরিয়র ডিজ়াইনার ও সোশ্যাল ওয়ার্কার শ্রেয়া পাণ্ডে জানালেন, ‘‘পরিবার বা বিয়ের বিরুদ্ধে নই। যখন মা হতে চেয়েছিলাম, তখনও আমার বিয়ে হয়নি। তাই নিজের ডিম্বাণুর সাহায্যে সারোগেসির সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৮-য় মেয়ে আদরের জন্ম। আমি কোথাও চলে গেলাম আর মা-বাবা আদরের দেখভাল করছেন, এমনটা হতে দিইনি। অফিসের কাজে ও সঙ্গে যেত। এখন রাজনীতির কাজেও অনেক জায়গায় ও সঙ্গী হচ্ছে। অনলাইনে স্কুল করে, তাই সর্বত্র ইন্টারনেটের ব্যবস্থা রাখি। সারা জীবন এই সিদ্ধান্তের ভার নিজেকেই নিতে হবে। সেই প্রস্তুতি রাখাও দরকারি।’’

আলোর সন্ধানে

সিঙ্গল মাদার— কথাটায় অনেক সমাজতত্ত্ববিদেরই আপত্তি। কারণ, এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ একা মা স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে সন্তানের ভার একা সামলান। এই শব্দবন্ধে তাঁদের জীবনের ব্যক্তিগত কিছু অধ্যায় প্রকাশিত হয়ে যায়। স্বামীহারা, স্বামী পরিত্যক্তা, বিবাহবিচ্ছিন্না, সমকামী, অবিবাহিতা, দত্তক নিয়েছেন ইত্যাদি। উপায়হীন একা মায়েদের লড়াই কাছ থেকে দেখছেন পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কমিশনের অধ্যক্ষ লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, দারিদ্র্যসীমার নীচে যাঁরা, তাঁরা নারীস্বাধীনতা বোঝেন না। বোঝেন, বাচ্চাকে কিছুতেই ছাড়বেন না। সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থের জোগান ছাড়াই ব্যক্তিদায়িত্বে বাচ্চাকে বড় করতে তাঁদের নিয়ত লড়াই দেখলে সম্ভ্রম জাগে। একা মায়েদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা বহু দেশই করেছে। ঈলীনা চান, এ দেশও বিষয়টায় এগোক। এখানে একা মা হওয়ার সাধটুকু ছুঁতে গেলে সুস্মিতা সেন কিংবা নুসরত জাহানের মতো নক্ষত্রের আলোর অধিকারী হতে হয়। স্বামী পরিত্যক্তা কোনও মা বা অত্যাচারের বলি কোনও কিশোরী মায়ের জোটে লাঞ্ছনার অন্ধকার। যে সাংসদ একা মা হওয়ার সাহস দেখিয়েছেন, তাঁকে ঈলীনার অনুরোধ, আজকের কুন্তীরা যাতে সসম্মান সন্তান বড় করতে পারেন, তার জন্য রাষ্ট্রের কাছে প্রস্তাব রাখেন যেন এই নতুন মা। তা হলেই হয়তো তিনি সমাজের আসল সমস্যায় কষে ঘা দিতে পারবেন। নারীর যৌনতা, একা মায়ের জীবনযাপন নিয়ে হাজার বাক্যি শুনিয়ে মূল সমস্যাটাই চেপে দেয় সমাজ। তা হল, বিপুল অর্থনৈতিক অসাম্য। একা মা ও তাঁর সন্তান অপাঙ্ক্তেয়— এই ‘স্টিরিয়োটাইপ’-এর মূলে অর্থকষ্ট। আদতে পৃথিবীর কোনও মা-ই শক্তিহীনা নন, তাঁর রক্তবিন্দু নিংড়ে গড়া আদরপুতলিও দুর্বল নয়। আশির দশকে বিয়ের স্বীকৃতি ছাড়াই ভিভিয়ান রিচার্ডসের সন্তান ধারণ করেছিলেন নীনা গুপ্ত। বলেছেন, ‘‘ছোট্ট মাসাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ‘টিপু সুলতান’-এর শুটিংয়ের সেটে। সেটের বাইরে গিয়ে ওকে খাওয়াচ্ছিলাম। তখনই আগুন লাগে। ভাগ্যিস জায়গাটায় ছিলাম না। ও-ই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।’’

রামায়ণ-মহাভারতে ত্রিলোকের অপরাজেয় বীরদের হারিয়েছে কারা? রামের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকাচ্ছে লব-কুশ। অর্জুনকে হারাচ্ছে বভ্রুবাহন। যথাক্রমে একা মা সীতা ও চিত্রাঙ্গদার সন্তান। আর এ কালের মহাকাব্যই তো রচেছেন এক একলা মা। সন্তানের বহু প্রয়োজন মেটাতে পারতেন না সেই বিবাহবিচ্ছিন্না। তাই জাদুদুনিয়ার গপ্্পো শুনিয়ে তাকে ঘুম পাড়াতেন। চিনতে পারলেন এই মা-কে? হ্যারি পটার আর তার সিঙ্গল মাদার জে কে রোওলিংয়ের বিশ্বজয়ের কাহিনি!

মডেল: তৃণা বৈদ্য, ঐশিকী বসু

ছবি: অয়ন নন্দী

Single Mother

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।