Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Paranoid Schizophrenia

একা থাকা মহিলাদের খুঁজে বার করে খুন, কালনার সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে কী বলছেন মনোবিদরা?

কোন মানসিক অবস্থান থেকে এক জন এমনটা করতে পারে? তথ্যতালাশ চালাতে গেলে সামনে আসছে কয়েকটি অসুখের কথা।

কালনার সিরিয়াল কিলার কামরুজ্জামান সরকার। —নিজস্ব চিত্র।

কালনার সিরিয়াল কিলার কামরুজ্জামান সরকার। —নিজস্ব চিত্র।

মনীষা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৯ ১৬:৪১
Share: Save:

গুঁজে পরা সাদা চেক শার্ট-প্যান্ট, পালিশ করা কালো জুতো, ঘড়ি, হেলমেট, বাইক, হাতে দামি সিগারেট। এই ভাবেই নিজেকে ধোপদুরস্ত রাখত কালনার সিরিয়াল কিলার কামরুজ্জামান সরকার। খুনের ‘শিকার’ ছিলেন মহিলারা। খুনের আগে যৌন নির্যাতন ও খুনের পর মৃতার সঙ্গে সহবাস করা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বলেও পুলিশের দাবি। ধরা পড়ার পর নিজের কুকীর্তির কথা স্বীকারও করেছে অভিযুক্ত যুবক।

কিন্তু কোন মানসিক অবস্থান থেকে এক জন এমনটা করতে পারে? তথ্যতালাশ চালাতে গেলে সামনে আসছে কয়েকটি অসুখের কথা। তার মধ্যে নেক্রোফিলিয়া ও প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ার কথাই বার বার ঘুরেফিরে আসছে মনোবিদদের কথায়। কামরুজ্জামানের এমন স্বভাব যে স্পষ্টতই সাইকোপ্যাথিক ডিসঅর্ডার তা নিয়ে চিকিৎসকরা একমত।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেন,‘‘এই ধরনের অপরাধীদের ক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল যে সমস্যাই থাক না কেন, তাতে কিন্তু এদের অপরাধপ্রবণতা বা অপরাধমনস্কতাকে মেনে নেওয়া যায় না। অসুখ সেখানে কোনও প্রলেপ হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, নেক্রোফিলিয়া ও প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া— দু’ক্ষেত্রেই আক্রান্তের ‘সুপার ইগো’ নামক বস্তুটি প্রায় থাকেই না। তাই ভাল-মন্দের বিচার এদের লোপ পায়। তবে এক দিনেই এই অসুখ বাসা বাঁধে না। এমন কোনও অসুখের নেপথ্যে থাকে আক্রান্তের বেড়ে ওঠা, শৈশব বা জীবনের কোনও এক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া কোনও বিশেষ ঘটনা। তার জীবনযাত্রা কেমন তা-ও জানতে হবে এই রোগের উৎসে পৌঁছতে চাইলে।’’

আরও পড়ুন: শুধু খুনই নয়, যৌন নির্যাতনও করত কালনার সিরিয়াল কিলার

কামরুজ্জামানের ব্যাগ থেকে পাওয়া অস্ত্র।— নিজস্ব চিত্র।

চিকিৎসকের মতে, সাধারণত প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ার বেলায় উল্টো দিকের সব মানুষকেই শত্রু বলে ভ্রম হয়। কাল্পনিক কিছু শত্রুতায় মজে থাকে মন। সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে সকলকেই। তাই মনে হয়, তাদের খুন না করা অবধি আরাম নেই। মস্তিষ্কে রাসায়নিক ভারসাম্যের তারতম্যের কারণেই এমন সব সাইকোপ্যাথিক ডিসঅর্ডারের শিকার হয় মানুষ।

তবে কামরুজ্জামানের ঘটনা আর একটু তলিয়ে ভাবার দাবি রাখে বলে মত অমিতাভবাবুর। তাঁর সঙ্গেই সহমত পোষণ করেছেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের মতে, এই ধরনের মানুষরা প্রথমে অপরাধী। তার পর মানসিক রোগের শিকার। এমন অসুখে মানুষ ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি ও বিকৃত যৌনসুখ, দুটোই পেতে চান। সাধারণত চিকিৎসা করানোর প্রতিও তাদের খুব একটা সায় থাকে না। কারণ, তারা ভাবে সমস্যাটা তাদের নয়, বাকি পৃথিবীর। এমন ভাবনা কমবেশি সব মানসিক রোগে থাকলেও নেক্রোফিলিয়া ও প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া এই দুই ক্ষেত্রে আরও বেশি করে থাকে।

কামরুজ্জামানের ক্ষেত্রে নেক্রোফিলিয়ার সঙ্গে কিছুটা প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়াও ছিল বলে দাবি মনোবিদদের। প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া সম্পর্কে না হয় কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল। কিন্তু নেক্রোফিলিয়া? সেটা কী?

বিশেষজ্ঞদের মতে, নেক্রোফিলিয়া মূলত গ্রিক শব্দ। ব্যর্থ প্রেম থেকে প্রতিহিংসা ও খুন করার ইচ্ছা জন্ম নেয় এই অসুখে। তবে এটা মোটেই একবারে চরম পর্যায়ে পৌঁছয় না, অর্থাৎ, একটা-দু’টো প্রেম ভাঙলেই সে খুনি হয়ে উঠবে এমন ধারণা ঠিক নয়। বরং প্রেম ভাঙার পর একটু একটু করে মনের নানা বিকার নানা ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। সর্বশেষ স্তরে সে খুন পর্যন্ত এগোয়। ‘নেক্রোস’ কথার অর্থ ‘মৃত’, ‘ফিলিয়া’ অর্থে ‘প্রেম’ বা ‘ভালবাসা’। কোনও প্রেমে বাধা পেলে বা ব্যর্থ হলে সঙ্গীর প্রতি রাগ থেকে ও প্রেমে বিতৃষ্ণা থেকে এমন অসুখ হানা দেয়। তবে এক বারেই বাড়াবাড়ি হয় না। একটু একটু করে বিকৃতি বাড়তে বাড়তে চরম অবস্থায় পৌঁছয় রোগী।

নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর আবার নানা ভাগ আছে। কেউ কেবলই মৃতের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে খুন করে। একে হোমিসাইডাল নেক্রোফিলিস বলে। কেউ বা মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সংসর্গের কল্পনা করে। একে নেক্রোফিলিস ফ্যান্টাসির শিকার বলে ধরা হয়। আবার কেউ বা মৃতদেহ খুঁজে বার করে তার সঙ্গে যৌনাচার করে, একে রেগুলার হোমিসাইড বলে।

আরও পড়ুন: ঘরে-বাইরে সমান চাপ? কর্মরত মহিলাদের এগুলো মানতেই হবে

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কেন হয় এই ধরনের সাইকোপ্যাথিক ডিসঅর্ডার?

মূলত ছেলেবেলায় বারংবার ঘটা কোনও বেদনাদায়ক ঘটনা, তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ, প্রেমের সম্পর্ক, সব কিছুই এই অসুখের নেপথ্য কারণ হিসাবে কাজ করে। তবে এই সব রোগের বহিঃপ্রকাশ নানা ভাবে ঘটতে থাকে। সে সব অবহেলিত হতে হতেই চরম আকার নেয় তা। মস্তিষ্কের রাসায়নিকের তারতম্যের কারণে এমনটা ঘটায় তার প্রকাশ নানা ছোটখাটো হিংসাত্মক আচরণ, বিকৃত মানসিকতার মাধ্যমে দেখা যায়। অবহেলা করলে বড় বিপদ ঘটে।

তবে এ অসুখ জন্মগত নয়। যখন তখন যে কেউ এই অসুখের শিকার হন না। সাধারণত সুস্থ ভাবে বড় হওয়া, সাধারণ উপায়ে ছেলেবেলা কাটানো কারও মধ্যে এ অসুখ দেখা যায় না। সাধারণত রোগীর খারাপ অতীত ও জীবনযাপন এগুলো এই রোগকে বাড়ায়। সঙ্গে যদি আক্রান্তের মাদকাসক্তি থাকে, তা হলে তা আরও সমস্যা তৈরি করে।

প্রতিকার

এই অসুখের ক্ষেত্রে আগে থেকে কোনও প্রতিকার হয় না। বিকৃত আচরণ শুরু হলেই তার উপযুক্ত চিকিৎসা, মনোবিদদের পরামর্শ মেনে চলা এগুলোই মূলত ঠেকানোর উপায়। তবে আধুনিক যুগে বাবা-মায়ের ব্যস্ততা, বদলে যাওয়া সম্পর্কের সমীকরণ, খেলার সময় কমে যাওয়া, অনিচ্ছার ইঁদুরদৌড়, ইগো এগুলোও নানা মানসিক বিকার ডেকে আনে। তাই সন্তানকে বড় করার সময় তার মানসিক বিকাশ ও পরিচর্যায় দিকে নজর দেওয়া দরকার। বিকৃত কিছু আঁচ পেলেই দ্রুত মনোবিদের পরামর্শ নেওয়াও প্রয়োজন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy