বাচ্চাদের শারীরচর্চার জন্য প্রশিক্ষককে প্রথমেই মানসিক যোগাযোগ তৈরি করতে হবে বাচ্চাটির সঙ্গে। প্রতীকী ছবি।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক কর্মক্ষম মানুষের ওজন বাড়ে তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাপনের অভ্যেসের কারণে। কিন্তু শারীরিক বা মানসিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি কিংবা বাচ্চার ওজন বাড়ে তাঁর অসুস্থতার কারণে। চিকিৎসকেরা প্রায়ই পরামর্শ দিয়ে থাকেন এ ধরনের মানুষদের ওজন কমানোর। কিন্তু একজন স্বাভাবিক কর্মক্ষম মানুষের পক্ষে যে ভাবে ব্যায়াম করে কিংবা খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে ওজন কমানো সম্ভব, বিশেষ ভাবে সক্ষম একজনের পক্ষে সেই পদ্ধতি অবলম্বন করা অসম্ভব। তাঁদের ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারেন বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিটনেস ট্রেনারেরা।
প্রশিক্ষক সৌমেন দাসের কথায়, “কেবল বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ নিলেই এ ধরনের মানুষদের সঙ্গে কাজ করা সহজ হবে না। সঙ্গে প্রয়োজন ধৈর্য ও মানবিকতার।” কোনও মানুষ জন্মগত ভাবে শারীরিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম হতে পারেন। আবার কারও দুর্ঘটনায় ঘটতে পারে অঙ্গহানি। সৌমেন বললেন, “পূর্ণবয়স্ক মানুষ ও বাচ্চার চোখের সমস্যা থাকলে কিংবা মানসিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম হলে, প্রশিক্ষককে গোড়ার দিকে কিছু দিন তাঁকে ধরে বুঝিয়ে দিতে হবে ব্যায়াম। তা ছাড়া এঁদের শরীরের যে অংশে অসুবিধে রয়েছে, সেই অংশ বাদে অন্য অঙ্গের জোর বাড়ানোর ব্যায়াম করাতে হবে।” শরীরের উপরের অংশে সমস্যা থাকলে দাঁড়িয়ে করা যেতে পারে অ্যারোবিক্স কিংবা জ়ুম্বা। নীচের অংশে সমস্যা থাকলে শরীরের উপরের অংশের অর্থাৎ কাঁধ, বাহু, বাইসেপ, ট্রাইসেপ, বুক ইত্যাদি অংশের জোর বাড়াতে হবে।
ট্রাইসেপের জোর বাড়াতে হাত মুঠো করে কনুই থেকে ভাঁজ করে দুই হাতকে একসঙ্গে পিছনের দিকে টেনে ধরে দশ গুনুন। দু’থেকে তিন সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে দু’ সেটে দিনে পনেরো বার একই ব্যায়াম করুন।
কোর মাসলকে শক্তিশালী করতে সোজা হয়ে চেয়ারে বসুন। পেট ভিতরের দিকে টেনে নিয়ে শ্বাস ধরে রেখে এক থেকে ষোলো গুনুন। দিনে অন্তত দশ বার করুন এই ব্যায়াম।
নিতম্ব এবং থাইকে শক্তিশালী করতে দেওয়াল ধরে পা স্ট্রেচ করুন পিছনের দিকে।
শরীরে নমনীয়তা বাড়াতে সাঁতার কাটতে পারেন। পাশাপাশি করতে পারেন শবাসনও।
এ তো গেল কেবল শারীরিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য। কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের, বিশেষত বাচ্চাদের এ ভাবে ব্যায়াম করানো যায় না। হাই ইন্টেনসিটির ঘাম ঝরানো কার্ডিয়ো ওয়ার্কআউট তারা যেমন করতে চাইবে না, তেমনই কিছু ক্ষেত্রে তা করানো বিপজ্জনকও। অথচ ক্রমাগত ওজন বৃদ্ধি এ ধরনের বাচ্চাদের গুরুতর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সৌমেনের কথায়, “নিয়মিত বেশ কিছু ব্যায়ামের অভ্যেস তাদের ওজন যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তেমনই বাড়াতে পারে কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জোরও। ফলে মানসিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম বাচ্চারা যেমন হাসি-খুশি এবং সক্রিয় থাকবে, তেমনই নিজেরাই করতে পারবে ছোটখাটো কিছু দৈনন্দিন কাজ।”
একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক বাচ্চা সারাদিন হাঁটাচলা, খেলার মতো নানা ধরনের কাজ করে। ফলে তাদের বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলা সহজ। কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম বাচ্চার দিন কাটে সাধারণত শুয়ে-বসে। ব্যায়ামের জন্য তাদের রাজি করানোও কঠিন। তাই এই ধরনের বাচ্চাদের শারীরচর্চার জন্য প্রশিক্ষককে প্রথমেই মানসিক যোগাযোগ তৈরি করতে হবে বাচ্চাটির সঙ্গে। সে যদি একবার প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণকে ভালবেসে ফেলে, তা হলে কাজ সহজ হবে। অভিজ্ঞতা থেকে সৌমেন বললেন, “এ ধরনের বাচ্চারা বেশ জেদি হয়। তাই তাদের সঙ্গে চলতে হয় তাদের মতো করেই। তবে এরা একবার ট্রেনিংয়ের পদ্ধতি কিংবা ট্রেনারকে ভালবেসে ফেললে নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয়ে যায় নিজে থেকেই।”
পাশাপাশি জেনে নিতে হবে বাচ্চার পছন্দ-অপছন্দও। সেই অনুযায়ী তাদের ওয়ার্কআউটের পরিকল্পনা করতে হবে। ছোটদের কেউ অ্যারোবিক্স, কেউ জগিং পছন্দ করে, আবার অনেক বাচ্চা নাচতে ভালবাসে। হিন্দি বা ইংরেজি কোনও গান চালিয়ে দিলে অনেক বাচ্চাই মনের আনন্দে শারীরচর্চা করে।
কী করবেন, কী ভাবে করবেন?
প্রথমেই করতে হবে নমনীয়তা বাড়ানোর ব্যায়াম। তবে প্রথম দিকে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম একেবারেই নয়। মানসিক দিক দিয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের শারীরিক ভারসাম্য থাকে না খুব বেশি। ফলে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করতে গেলে পড়ে গিয়ে চোট লাগার ভয় থেকে যায়। তাই হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারে বসে ব্যায়াম করতে হবে।
ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়াতে প্রথমে মাথা, ঘাড় ঘোরানো শেখাতে হবে তাদের। তার পর ধীরে ধীরে চেয়ারে বসেই করাতে হবে সাইড বেন্ডিং, ফ্রন্ট বেন্ডিং, ব্যাক বেন্ডিং এবং লেগ স্ট্রেচিং। চেয়ারের বদলে মাটিতে বসেও করানো যেতে পারে লেগ স্ট্রেচিং ওয়ার্কআউট। মাটিতে বসে প্রথমে দু’পাশে লম্বা করে মেলে দিতে হবে পা দু’টি। এর পর ডান হাত দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ছোঁয়ার চেষ্টা করতে হবে। সঙ্গে থুতনি লাগাতে হবে হাঁটুতে। একই রকম পদ্ধতি করতে হবে বাঁ পায়েও। এই পদ্ধতিতেই স্ট্রেচিং করতে হবে বিপরীত দিকেও। অর্থাৎ ডান হাত দিয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল ও বাঁ হাত দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল ধরার চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়াও পা দু’পাশে না ছড়িয়ে দিয়ে সোজা লম্বা করে রেখেও এই ব্যায়াম একই ভাবে করানো যেতে পারে।
এর পর পালা কার্ডিয়োর। চেয়ারে বসে হাত মুঠো করে করাতে হবে জগিং (এ ক্ষেত্রে শুধু হাতের মুভমেন্ট হবে)। এতে যেমন পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। তেমনই হাত, ঘাড়, কাঁধের ব্যায়ামের সঙ্গে ঝরানো যাবে ঘামও। নিয়মিত অভ্যেসে বাড়বে শরীরের ভারসাম্য ও ফ্লেক্সিবিলিটি, কমবে ওজনও।
কার্ডিয়োর পর আসবে সাইক্লিং। মাটিতে শুইয়ে হাত দু’টিকে রাখতে হবে শরীরের দু’পাশে। তার পর হাঁটু থেকে পা মুড়ে শূন্যে তুলে চালাতে হবে সাইকেল। এতে পা, কোমর, হাঁটু থেকে শুরু করে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরই শক্তি বাড়বে।
রোজ সব ব্যায়ামই ১৬ বার করে দু’সেটে করতে হবে। ১০ থেকে ১৫ দিন পর শরীর কতটা ধকল সইতে পারছে বা বাচ্চা কতটা উৎসাহ পাচ্ছে তাঁর উপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে সময় ও বদলাতে হবে ব্যায়ামের ধরন।
শারীরিক অক্ষমতা মনের জোর কমিয়ে দেয় বেশির ভাগ সময়েই। ফিটনেস ট্রেনিং শুরুর আগেই ব্যক্তি ভাবতে থাকেন তাঁর দ্বারা হবে না। ব্যায়ামের পাশাপাশি অবশ্যই পাশে থাকতে হবে পরিবারের মানুষদেরও। প্রয়োজনে তাঁদেরও শিখে রাখতে হবে প্রাথমিক কিছু ব্যায়াম। ক্রমাগত জোগাতে হবে মানসিক জোর। আত্মবিশ্বাস একবার তৈরি করে দিতে পারলেই কাজ হবে অনেকটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy