স্নান, খাওয়া, পড়াশোনায় সাহায্য করা ছাড়াও সন্তানের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটাতে হবে ফাইল ছবি।
অফিসের কাজ, সঙ্গে সাংসারিক দায়দায়িত্ব। দুইয়ের চাপ সামলেও পূর্ণার নজরে পড়েছিল যে ক’দিন ধরে মেয়ের মুখ যেন ভার। জলখাবারের টেবিলে এ নিয়ে জানতে চাইলেও মেয়ে ‘কিছু হয়নি তো’, বলে এড়িয়ে যায়। কিন্তু তার সঙ্গে আর আলাদা করে কথাই বলা হয়নি পূর্ণার। দিন চারেক পরে মেয়ের প্রিয় বান্ধবীর মায়ের ফোনে জানা যায়, দুই বন্ধুর মনোমালিন্যই ছিল মনখারাপের কারণ।
সন্তানের কেন মনখারাপ বা তার দৈনন্দিন জীবনে কী হচ্ছে, তা জানার মধ্যে এই ফাঁক থেকে যায় তার সঙ্গে গুণগত সময় (কোয়ালিটি টাইম) কাটানোর অভাবে। নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সন্তানের মানসিক উন্নতি, মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের দৃঢ়তা নির্ভর করে সুন্দর সময় কাটানোর উপরে। তাই, রোজ সন্তানের সঙ্গে একান্ত সময় কাটানো খুবই জরুরি।
কোয়ালিটি টাইম কী?
সারাদিন সন্তানের জন্য অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয় মায়েদের। ছেলে বা মেয়ে একদম ছোট হলে তাদের খাওয়ানো, স্নান করানো থেকে শুরু করে, তারা বড় হলে স্কুলের জন্য তৈরি করা, স্কুলে দিয়ে আসা, পড়ানো বা খাবার তৈরির মতো নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন মায়েরা। তা হলে কোয়ালিটি টাইম বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? সারা দিন সন্তানের সঙ্গে থাকলেও সময়ের গুণগত মান আলাদা কেন?পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের ব্যাখ্যা— কোয়ালিটি সময় হল সেই সময় যখন মায়ের সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকে সন্তানের উপরে। ওই সময়ে সন্তানের সঙ্গে কথোপকথন, তার প্রেক্ষিতে চিন্তা করা, নতুন বিষয় জানানো, তাকে ভাবতে সাহায্য করার মাধ্যমে দৃঢ় হয় মায়ের সঙ্গে সন্তানের বাঁধন। এই সময়টা হবে নির্বিঘ্ন, অর্থাৎ ওই সময়ে অন্য কাজ করা, মোবাইলে কথা বলা বা কিছু দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। পায়েল জানাচ্ছেন, সারা দিনে ২০ মিনিট করে তিন বার, অর্থাৎ মোট এক ঘণ্টা কোয়ালিটি টাইমই সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আর এই সময়টা তাকে দিতে হবে নিয়মিত।
সময় কাটানোর ক্ষেত্রে গুণগত মানের প্রয়োজনীয়তা
পায়েল ঘোষ জানাচ্ছেন, ভাল সময় কাটানোর মাধ্যমে সন্তানের বৃদ্ধির তিনটি দিকের উপরে সরাসরি প্রভাব পড়ে— কগনিটিভ অর্থাৎ চিন্তাশক্তি বা বুদ্ধিমত্তা, লিঙ্গুইস্টিক অর্থাৎ ভাষাগত, সোশ্যাল অ্যান্ড ইমোশনাল অর্থাৎ সামাজিক ও মানসিক বৃদ্ধি। তবে কোনও কঠিন উপায়ে নয়, রোজ কিছুটা সময় সন্তানের সঙ্গে কোনও আলোচনা, প্রশ্ন করা, একসঙ্গে কোনও কাজ করার মাধ্যমে সহজেই লালন করা যাবে এই দিকগুলি। আবার, সন্তানকে জড়িয়ে ধরা বা আদর করার মাধ্যমে তারা পায় নিরাপত্তা ও ভালবাসার বোধ।
শিশুরা মা-বাবার কথা বলার ধরন অনুসরণ ও অনুকরণ করে। তাই নির্বিঘ্ন সময় কাটানোর মাধ্যমে ছোটরা ভাষার ব্যবহার শিখবে, সেই সময়ে সতর্ক থাকতে হবে শব্দচয়ন নিয়ে। শিশুর চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা লালনের জন্য ছোটবেলায় কোনও জিনিস দেখিয়ে সেটি কী, তার রং কী — এমন সাধারণ প্রশ্ন করা যেতে পারে। বয়স অনুযায়ী পাল্টাবে প্রশ্নের ধরন। একটু বড় সন্তানের ক্ষেত্রে কোনও বই, খেলাধুলো, বিজ্ঞানের নানা দিক নিয়ে আলোচনার অভ্যেস গড়ে তোলা যেতে পারে।সম্প্রতি মাদ্রাজ আইআইটি-র এক ছাত্রের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনায় উঠে এসেছিল, তার একাকিত্বের দিকটি। পরিবারের সকলেই ব্যস্ত, কেউ তাকে সময় দিতে পারে না, এই হতাশার কথা লিখেছিল ছাত্রটি। তাই সন্তান বয়ঃসন্ধিতে পা দিলে তাকে জীবনের কঠিন দিকগুলির সঙ্গে আস্তে আস্তে পরিচয় করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন পায়েল। জীবনে ব্যর্থতা ও অন্য প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তার পাঠ দেওয়া যেতে পারে অবিঘ্নিত সময় কাটানোর মাধ্যমেই। এই ভাবেই ছোটখাটো গর্ত মেরামতের মাধ্যমে পরে এড়ানো যাবে বড়সড় ফাটল, সন্তানকে তৈরি করে দেওয়া যাবে ভবিষ্যতের জন্য। বহির্জগতের প্রতিযোগিতামূলক যাবতীয় ধাক্কার কথা সে যেন বাড়িতে বলতে পারে, তৈরি হবে সেই পরিসরও।
কী ভাবে কাটাবেন নির্বিঘ্ন সময়সারা দিন কী ভাবে তার সময় কাটল তা জানতে চাওয়া ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা তো আছেই। এ ছাড়াও সন্তানের সঙ্গে ভাল সময় কাটানো যেতে পারে তার পছন্দের কাজের মাধ্যমে। সেটা হতে পারে বই পড়া, বাগানের যত্ন নেওয়ার মতো কাজ। সন্তানের যদি আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট বা অন্য শখ থাকে, তা হলে সেটা নিয়ে মা-বাবাও উৎসাহ দেখাতে পারেন। সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং কোনও ভাল কাজের জন্য প্রশংসা করাও জরুরি। সন্তানকে পড়তে বসানোর মাধ্যমেও আদানপ্রদান চলতে পারে। এর মাধ্যমে শুধু সময় কাটানোই নয়, সন্তানের বুদ্ধিমত্তা, তার পড়াশোনার অগ্রগতি সম্পর্কেও অভিভাবকের একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠবে।
থাকুক সমতা
চাকুরিরতা হোন বা হোমমেকার, মায়েদের ব্যস্ততা বেশির ভাগ সময়েই তুঙ্গে থাকে। বিশেষত যাঁরা অফিসের দায়িত্ব সামলান, তাঁদের পক্ষে সন্তানকে নির্বিঘ্ন সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। পায়েলের পরামর্শ, অফিস থেকে ফিরে সন্তানকে কিছুটা সময় দিন। তবে কোনও দিন অতিরিক্ত কাজের চাপে সময়ে বাড়ি ফিরতে না পারলে, সন্তানকে সে কথা আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন। সন্তান যেন আপনার অপেক্ষায় বসে থেকে হতাশ না হয়। অফিস থেকে ফোন করেই তাকে বুঝিয়ে বলুন। সন্তানকে নিজের জীবনের সঙ্গী করে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন পায়েল। শুধু কাজের চাপ নয়, মনখারাপ বা অসুস্থতার সময়েও সন্তানকে সে কথা জানান, যাতে বড়দের জীবনের এই দিকগুলি সম্পর্কে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়।
মায়েদের জন্য আরও পরামর্শ, সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকত্বের ধরনে বদল আনতে হবে। তারা বয়ঃসন্ধিতে পা রাখলে নিজের জগৎ তৈরি হয়। এ সময়ে সব কিছু খুঁটিয়ে জানতে চাওয়া, জেরা করার প্রবণতা ছাড়তে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তাদের কথা শোনা উচিত নয়। তাকে সম্মান দিলে সন্তানও ভরসা করে মায়ের কাছেই আসবে।
বাচ্চার জন্য রান্না করা, তাকে খেতে দেওয়া বা তাকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজকে কোয়ান্টিটি টাইম হিসেবে ধরা যেতে পারে। এই কাজ মা-বাবা ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্য বা গৃহসহায়িকারাও করতে পারেন। কিন্তু কোয়ালিটি টাইম এমন একটা জিনিস, যা তাঁদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানকে নিশ্চিন্ত, নির্বিঘ্ন সময় দিতে হবে।
মডেল: সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়, অঙ্কিত রাজপুত সিংহ, রোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃষাণজিত চৌধুরী;
মেকআপ: চয়ন রায়;
ছবি: জয়দীপ দাস;
শুটিংস্পট ও হসপিটালিটি: প্রিন্সটন ক্লাব, আনোয়ার শাহ রোড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy