ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাস বিভিন্ন পথে শরীরে প্রবেশ করে। হার্ট, কিডনি, লাংস... যে কারণে কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, কারও ডায়রিয়া। যদি আগে থেকে কারও হার্টের সমস্যা বা হাইপার টেনশন, ব্লাড সুগার থাকে, তা হলে রোগের লক্ষণ আরও জোরালো হচ্ছে। তবে যে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে তা হল, কোভিড-১৯ সরাসরি আক্রমণ করে শ্বাসনালি ও ফুসফুসে। সম্প্রতি চিনের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, করোনা সেরে যাওয়া রোগীর ফুসফুস বেশ ভাল মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কার্যক্ষমতা কমে গিয়েছে। যে কারণে রোগী এমনিতে সুস্থ হলেও অল্পে হাঁপিয়ে পড়ছেন।
পালমোনালজিস্ট ডা. পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে এ সব নিয়ে তেমন কোনও গবেষণা হয় না। তবে বিদেশে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, করোনা সেরে যাওয়ার পরেও অনেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। কোভিড-১৯ তাঁদের ফুসফুসে একটা ছাপ ফেলে যাচ্ছে। তবে এটা সকলের হচ্ছে, এমন নয়। উপসর্গহীন বা হালকা উপসর্গের রোগীদের অত চিন্তা নেই। যাঁদের রোগের প্রকোপ গুরুতর ছিল, সমস্যাটা তাঁদের ক্ষেত্রেই হচ্ছে।’’
কী ভাবে ফুসফুসে ঢোকে ভাইরাস?
অধিকাংশ করোনা রোগীর স্বাভাবিক লক্ষণ শ্বাসকষ্ট। রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে গলা ব্যথা, খুসখুস করা, শুকনো কাশি শুরু হয়। এর পর ভাইরাস ক্রমশ ব্রঙ্কিয়াল টিউবে ছড়িয়ে পড়ে। তার পর ফুসফুসে ঢুকে এটি অ্যালভিওলাই ও ফুসফুসের থলিগুলির ক্ষতি করে। যে কারণে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করার কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইডকে শরীর থেকে বার করার কাজও ব্যহত হয়। বিদেশি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অনেক কোভিড রোগীর ফুসফুসে একটা প্যাচ বা আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে যখন কোনও রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে যাচ্ছেন, তখন তাঁর একটি সিটি স্ক্যান করানো হচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, লাংসের উপরে সাদা আস্তরণের মতো অংশ। তখনই চিকিৎসকেরা বুঝে যাচ্ছেন, রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সোয়াব টেস্টের জন্য অপেক্ষা না করেই তাঁরা চিকিৎসা শুরু করে দিচ্ছেন।
শুধু ফুসফুসে আঘাত হেনেই এই ভাইরাস থেমে থাকছে না। অস্থিমজ্জা, লিভার, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক সময়েই করোনা ব্রেনে আঘাত করছে। হেমারেজ, ব্লাড ক্লট হচ্ছে। তখন চিকিৎসকরা অ্যান্টিকোয়াগুলান্ট থেরাপি শুরু করছেন।
অযথা আতঙ্ক নয়
চিকিৎসকরা এখন শুধু করোনার সংক্রমণ মেটানোর চেষ্টাই করছেন না, রোগ সেরে গেলেও রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে তাঁকে চিকিৎসার মধ্যে রাখছেন। ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. অরিন্দম কর বলছেন, ‘‘এই ভাইরাসের প্রভাবে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সব রোগীর নয়। যাঁদের মাইল্ড সিম্পটম ছিল তাঁদের চিন্তা করার কোনও কারণ নেই। মিডিয়াম বা সিভিয়ার সার্ভাইভার যাঁরা, তাঁদের ফুসফুসেই বেশি প্রভাব পড়ছে। এর জন্য আমরা এখন স্পেশ্যাল রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম করছি। কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে প্রথম কর্তব্য, প্রাণ বাঁচানো। পরের ধাপে তাঁকে স্টেবল করা। এর পর আসছে কোর রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম, যাতে লাংস ড্যামেজ আটকানো যায়। সেখানে ওষুধ, ফিজ়িয়োথেরাপি, ব্রিদিং এক্সারসাইজ় এগুলো দরকার।’’ এর পাশাপাশি প্রয়োজন রোগীকে মানসিক দিক থেকে সুস্থ রাখা। অযথা আতঙ্ক বাড়তি বিপদ ডেকে আনবে।
সিওপিডি, অ্যাজ়মার রোগীদের ক্ষেত্রে
করোনার প্রধান উপসর্গ যেখানে শ্বাসকষ্ট, সেখানে সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকক্টিভ পালমোনারি ডিজ়িজ়) বা অ্যাজ়মার রোগীরা এই রোগে আক্রান্ত হলে তাঁদের কতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে? ডা. পার্থসারথি ভট্টাচার্যর বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের রোগীদের নিয়ে প্রথম দিকে আমাদের চিন্তা বেশি ছিল। ঘটনাচক্রে দেখা যাচ্ছে, এঁদের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলেও, সে ভাবে ফুসফুসের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। এর আসল কারণ জানতে গেলে গবেষণার প্রয়োজন। তবে বিভিন্ন কেস স্টাডি করে আমার যেটা মনে হচ্ছে, তা হল সিওপিডি বা অ্যাজ়মার রোগীরা যে ওষুধ নিয়ে থাকেন, তা ওরাল হোক কিংবা ইনহেলার ফর্মে, সেগুলো এঁদের ফুসফুসকে রক্ষা করছে কোনও ভাবে।’’ একই কথা বলছেন চিকিৎসক অরিন্দম কর, ‘‘এই অসুখটা আমাদের অজানা ছিল। ডাক্তারদের কাছেও এটা লার্নিং প্রসেস। প্রথমে যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালানো হচ্ছিল, তা এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। মনে করা হয়েছিল, অ্যাজ়মা, সিওপিডির রোগীদের বেশি সমস্যা হবে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তা হচ্ছে না। ওঁরা যে ওষুধগুলো নিয়ে থাকেন, সেগুলো হয়তো এ ক্ষেত্রে ঢালের কাজ করেছে। তেমন ভাবেই আমরা দেখছি, এইচআইভি পেশেন্ট বা ডায়ালিসিসের রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলেও তাঁদের পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে থাকছে। তাঁরা যে ওষুধগুলো নিয়ে থাকেন, সেগুলো কোনও ভাবে এঁদের রক্ষা করছে।’’
ফুসফুস ভাল রাখার উপায়
সে অর্থে ফুসফুস ভাল রাখার কোনও উপায় নেই। বড়জোর ব্যালান্স ডায়েট, ব্রিদিং এক্সারসাইজ়ের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। তবে ধূমপায়ীরা সতর্ক হন। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এবং ধূমপায়ী হলে তাঁদের ফুসফুসের ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই বেশি। মানুষের শ্বাসনালি ও ফুসফুসে এক ধরনের সিলিয়া থাকে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চুলের মতো হয় এগুলি। এদের কাজ শ্বাসনালি আর ফুসফুস আগলে রেখে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করা। কিন্তু ধূমপায়ীদের এই সিলিয়াগুলি কার্যত অকেজো হয়ে যায়। আর ফুসফুসের লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায়। ‘‘ফুসফুস ভাল রাখতে হলে ধূমপান বন্ধ করা ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। কম পলিউশনেও ফুসফুস ভাল থাকে,’’ মন্তব্য পালমোনালজিস্ট পার্থসারথি ভট্টাচার্যর। তার সঙ্গে ব্যালান্স ডায়েট, যে সব খাবারে ভিটামিন সি, ডি থাকে সেগুলি খাওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি।
ফিটনেস বিশেষজ্ঞেরা প্রাণায়াম, যোগাসনের কথা বলেন। কিন্তু চিকিৎসকদের মতে, এগুলির সরাসরি কোনও প্রভাব নেই ফুসফুস ভাল রাখার ক্ষেত্রে। তবে বেসিক শারীরচর্চা ফিটনেসের জন্য সব সময়েই ভাল। করোনা সেরে গেলেই এক্সারসাইজ়ের জন্য না ঝাঁপানোই উচিত। আগে নিজের শরীরকে বুঝতে হবে। দেখতে হবে আপনি কত দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। সেই মতো এক্সারসাইজ়ের রুটিন সেট করুন। যাঁরা করোনা মেজর, মডারেটে ভুগছিলেন, তাঁদের সচেতনতা দরকার বেশি। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিছু করবেন না। যাঁদের হালকা উপসর্গ ছিল তাঁরা শরীর বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।
সব শেষে খেয়াল রাখুন আপনি করোনা আক্রান্ত হন বা না-ই হন, ফুসফুস ভাল রাখার জন্য ধূমপান বন্ধ করতেই হবে এবং কম পলিউশনের মধ্যে থাকার চেষ্টা করতে হবে। ঘটনাচক্রে, লকডাউন এবং আনলক ফেজ়ে পলিউশনের মাত্রা অনেক কমে গিয়েছে। তবুও ফুসফুস নিয়ে অবহেলা নয়, একটু যত্ন নিলেই তাকে সুস্থ রাখা কঠিন নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy