নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া মানে পরোক্ষে মাধ্যমিক, সিবিএসই বা আইসিএসই-র প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া। অন্য দিকে, দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা শেষের সপ্তাহখানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় একাদশ শ্রেণির পড়াশোনা। গত কয়েক বছরের চেনা গতানুগতিকতায় বাদ সেধেছে অতিমারির করাল ছায়া। ২০২১ সালের সিবিএসই (দশম ও দ্বাদশ), আইএসসি (দ্বাদশ) বোর্ডের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা।
এই পরিস্থিতি ছাত্রদের মনে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। উদ্বেগে ভুগছেন তাদের অভিভাবকেরাও। কারণ পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় বোর্ড পরীক্ষার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতি, তার ফলাফল ঘিরে প্রত্যাশা-উৎকণ্ঠা ছাত্রজীবনের অঙ্গ। কিন্তু পরীক্ষাকেন্দ্রিক ভাবনাচিন্তার পরিবর্তে পরীক্ষার অবসান ছাত্রসমাজের মনে কি নতুন কোনও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে?
মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লসের ডিরেক্টর দেবী করের মতে, ‘‘যে কোনও পরিবর্তনকে মেনে নিতে মানুষ ইতস্তত করে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই।’’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘পরীক্ষা দিতে হল না—এই চিন্তা সাময়িক আনন্দ তৈরি করতে পারে। কারণ ৯৯ শতাংশ ছাত্রের মধ্যে পরীক্ষাকে ঘিরে ভয় কাজ করে। কিন্তু আনন্দের অনুভূতিও দীর্ঘস্থায়ী নয়।’’ মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পরীক্ষাকে ঘিরে যে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ তা পরীক্ষার রেজ়াল্ট নিয়ে প্রত্যাশারই ফল। তার জন্য পরীক্ষা দেব না... এমনটা খুব কমসংখ্যক ছাত্রেরই মনে হয়।’’
পরীক্ষা হচ্ছে না। কিন্তু তার পরে কী? পরীক্ষা-বহির্ভূত মূল্যায়ন কী ভাবে হবে? পূর্ববর্তী যে পরীক্ষাগুলির ফল এই বোর্ড রেজাল্টের ক্ষেত্রে গণ্য হবে, তা কি সকলের মেধার প্রতি সুবিচার করবে? এই প্রশ্নগুলি যেমন পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত নানা স্তরের ব্যক্তিদের ভাবাচ্ছে, তেমনই অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে ছাত্রসমাজের একাংশের মনেও। কারণ একাদশ শ্রেণির রেজ়াল্ট আশানুরূপ না হওয়ায়, অনেকেই হয়তো দ্বাদশের পরীক্ষাকেই পাখির চোখ করেছিল। আবার মেধাবী ছাত্রদের মনে হতে পারে, গড় নম্বরের জন্য কাঙ্ক্ষিত জায়গাটি তারা তৈরি করতে পারবে না। অনুত্তমা ও আবীর ছাত্রদের উদ্দেশে একটি বার্তা দিতে চাইছেন, ‘‘এই পরিস্থিতির শিকার গোটা দেশের হাজার হাজার পড়ুয়া। তাই ব্যক্তি বিপর্যয়ের পরিবর্তে ‘সমষ্টিগত বিপর্যয়’ হিসেবে দেখলে দুশ্চিন্তা কম হতে পারে।’’ দেবী করও গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষার কথা বলছেন, ‘‘অনেক ছাত্রছাত্রীর মুখেই শুনছি, ‘পরীক্ষা হল না তাই সব পড়া ব্যর্থ হল।’ আমি তাদের বলছি, কোনও শেখাই বিফলে যায় না।’’
সাময়িক হতাশা, দুশ্চিন্তা ছাত্রদের মনে আসবেই। অভিভাবকদেরও এই প্রাক-পরিণত বয়সের কিশোর-কিশোরীদের চাহিদা বুঝে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, যে শেখাটুকু তাদের হাতে রয়েছে, সেটুকু যেন তারা মন দিয়ে শেখে। বাকি পরীক্ষা ও ফলাফলের যে দিকটা তাদের হাতে নেই, সেটাকে যেন পরিস্থিতির সাপেক্ষে গ্রহণ করে।
পরীক্ষা না হওয়া নিয়ে ছাত্রদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যাচ্ছে। সিবিএসই দ্বাদশের পরীক্ষার্থী প্রিয়াংশু বসুর কথায়, ‘‘পরীক্ষা না হওয়ার ভাল দিকটা হল, এখন পুরো ফোকাস জয়েন্ট এন্ট্রাসের প্রস্তুতির জন্য। বোর্ড নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে না। আবার বোর্ড যদি হত, তবে প্রাপ্ত নম্বরের চেয়ে অনেক বেশি পাব বলেই আশা করেছিলাম।’’
আবীর মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘অভিভাবকেরা বা আমরা যারা পরীক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তাদের হয়তো মনে হচ্ছে পরীক্ষা না হলে অনেক কিছুই মিস হয়ে গেল। কারণ এই অভিজ্ঞতা আশা-আশঙ্কায় ঘেরা, আবার মনে রাখার মতোও। কিন্তু যারা দশম শ্রেণির পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের হয়তো এই উপলব্ধিই হবে না।’’
বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা ছাত্রদের একাংশের কাছে পরীক্ষা শুধু আগামী জীবনের নির্ণায়ক নয়, পড়াশোনার ভাগ্যও নির্ধারিত হয় পরীক্ষার মাধ্যমে। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের উপরেই হয়তো আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রী এবং তাদের পরিবার ঠিক করে, পড়াশোনা আর চালানো যাবে কি না। তাদের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে পরীক্ষার অনুপস্থিতি হয়তো একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলবে।
তবে বেশির ভাগ মনোবিদ, শিক্ষাবিদ একটি বিষয়ে আশ্বস্ত করছেন যে, এই পরিস্থিতি ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে গণ্য হবে এবং তা ছাত্রদের কেরিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কোনও অসুবিধে তৈরি করবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy