প্রতীকী ছবি।
বাজি হল এমন এক আনন্দ, যা একা পেয়ে ঠিক স্বস্তি হয় না। বাজি পোড়ানোর সঙ্গী চাই। একসঙ্গে অনেক তারাবাজি, রংমশাল জ্বলবে। তবে না কালীপুজোর আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। পাড়ায় পাড়ায় আবার হত প্রতিযোগিতা। কার ঘরের তুবড়ি কত ক্ষণ জ্বলল, তা নিয়েও ছিল হইচই। তাই দোকানের বাজির উপর ভরসা না করে নিজেই বাজি বানিয়ে নিতেন অনেকে। আর সেই সুবাদে কালীপুজোর আনন্দ শুরু হয়ে যেত দিন কয়েক আগে থেকেই। কিন্তু এখন কি সেই চল আছে? এখনও কি ঘরে ঘরে কেউ বানান বাজি?
সে সময়ে আবার বাজি বানানো হত দল বেঁধে। কালীপুজোর কয়েক দিন আগে থেকে বাড়ির পুরুষরা কাজ থেকে ফিরে বসতেন বাজি বানাতে। বাড়িতে বানানো তুবড়ির আগুন যখন ফুলের মতো ঝরে পড়ত, সেই আনন্দ আলাদাই ছিল। শরৎ শেষে কার্তিক পড়তেই শুরু হয়ে যেত বাজি তৈরির প্রস্তুতি। বাজি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে কয়েক মুহূর্ত লাগে। বানাতে সময় লাগে বিস্তর। সেই সঙ্গে পরিশ্রম আর ধৈর্য তো রয়েছেই।
আগে অনেক বাড়িতেই তুবড়ি আর রংমশাল বানানো হত। এই বাজি বানানোর দায়িত্ব ছিল বাড়ির বড়দের কাঁধে। দাদু, জ্যাঠা, কাকা বা মামার চূড়ান্ত নজরদারিতে সাত দিন ধরে চলত সেই কর্মযজ্ঞ। ছুটির দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির প্রবীণ সদস্যরা বসতেন বাজি তৈরি করতে। চারপাশে ঘিরে থাকত কচিকাঁচারা। বাড়ির ভিতর থেকে হামানদিস্তায় ঠং ঠং শব্দ তুলে গুঁড়ো করা হত গন্ধক, সোরা, অ্যালুমিনিয়াম, কাঠকয়লা। দাঁড়িপাল্লায় বাজির মশলাগুলি সমান মাপে মেপে নিয়ে তার পর মেশানো হত। বাজি বানানোর অন্যতম গুরুত্পূর্ণ একটি ধাপ হল মশলার মাপ। এই মাপ যদি ঠিক না হয়, তা হলে কিন্তু কেলেঙ্কারি। মাপের গোলমালে উৎসবের আনন্দটাই মাটি যেতে পারে। তরুণ বয়স এমন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন পেশায় চিত্রশিল্পী অরিত্র সেনগুপ্ত। অরিত্রর কথায়, ‘‘আমি সারা জীবনই বাজিতে ভয় পাই। আমার বাবা ঠিক বিপরীত। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম কালীপুজোর আগে বাবা বাড়িতে বাজি বানাতেন। অফিস থেকে ফিরে বাবা বাজি বানাতে বসতেন। চলত সেই রাত পর্যন্ত। নেশার মতো ছিল যে। আমি মাঝেমাঝে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। কোনও কাজে সাহায্য করতাম না। তবে কালীপুজোর দিন রাতে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের ছাদে গিয়ে বাজি ফাটাতাম। এক বার বাবা একটি ঘট বাজি বানিয়েছিলেন। বাবা আমাকে প্রথম বাজির সলতেতে আগুন দিতে বললেন। আমি যথেষ্ট ভয়ে ছিলাম। বাবার কথা রাখতে দুরুদুরু বুকে সলতেতে আগুনটা সবে ছুইঁয়েছি, বোম ফাটার একটা শব্দ হল। সামনেটা পুরো ধোঁয়া। মা নীচ থেকে চেঁচাচ্ছেন। আর আমি দেখলাম আমার হাত থেকে অল্প অল্প রক্ত ঝরছে। আমাকে দেখে বাবা বললেন, যাক অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। পরে বাবা বলেছিলেন, রাতে ঘুমচোখে বাজি বানাতে গিয়ে মশলা পরিমাণ মতো ভরা হয়নি। তার পর থেকে বাবা আর কখনও বাজি বানানোর ঝুঁকি নেননি।’’
বাজি ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে কি না, তা দেখার জন্যও কালীপুজোর দু’দিন আগে পরীক্ষা করে দেখা হত। বাজি হাতে ফেটে যাওয়ার একটা ভয় থাকত। অমাবস্যার রাতে মাহেন্দ্রক্ষণের আগে এক বার যাচাই করে দেখা হত। এমন এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন কালীঘাটের বাসিন্দা দেবঋষি মোদক। দেবঋষির কথায়, ‘‘বাড়িতে বাজি তৈরির ভার ছিল বড় জেঠুর হাতে। বাজি পোড়ানো নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত থাকতাম। বড় জেঠু সেই উত্তেজনাকে প্রশ্রয় দিতেন। নিজের হাতে রংমশাল, তুবড়ি, সাপবাজি, বসনতুবড়ি বানাতেন। অনেক সময় নিয়ে, যত্ন করে নিঃশব্দে বানিয়ে ফেলতেন। টেরও পেতাম না। কালীপুজোর রাতে এক ঝুড়ি বাজি আমার চোখের সামনে চলে আসত। পাড়ার বন্ধুদেরও ডেকে নিতাম। একসঙ্গে সকলে মিলে বাজি পোড়াতাম। চকোলেট বোমা, কালিপটকা এগুলি কিনে আনতাম দোকান থেকে। বাকিটা একেবারে ‘হোম মেড’। অনেক বড় বয়স পর্যন্ত জেঠু আমাকে বাজি বানিয়ে দিতেন। বয়সজনিত কারণে জেঠু হঠাৎই এক দিন শয্যা নিলেন। জেঠু অসুস্থ হওয়ার পর আমি দোকান থেকে অল্প কিছু বাজি আনতাম। জেঠু ঘরের জানলা দিয়ে শুয়ে শুয়ে রংমশালের আলো দেখতেন। এক কালীপুজোর দিন জেঠুর মৃত্যু হয়। তার পর থেকে আমি আর কখনও বাজিতে হাত দিইনি।’’
বাজিকে কেন্দ্র করে এমন কতশত স্মৃতি জ্বলজ্বল করে ওঠে তার ইয়ত্তা নেই। এখন অবশ্য বাজি পোড়ানো নিয়ে এই আবেগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে এসেছে। বাড়িতে বাজি বানানো তো দূরের কথা, বাজির কাছেও সন্তানকে যেতে দেন না অনেকে। তারও অবশ্য সঙ্গত কিছু কারণ রয়েছে। বাজি তৈরি হয় নানা রকম রাসায়নিক সামগ্রী দিয়ে। সেগুলি চোখ-মুখে লাগলে ত্বকের ক্ষতি হয়। নানা রকম আশঙ্কা থেকে যায়। তাই শিশুরা বায়না করলে বড়জোর একটি তারাবাজি কিংবা ফুলঝুরি হাতে তুলে দেন অভিভাবকরা। তার বেশি নয়। রূপটানশিল্পী তনয়া বিশ্বাস বলেন, ‘‘ছোটবেলায় বাজি ফাটাতে খুব ভালবাসতাম। পাড়ার দাদাদের সঙ্গে সমান তালে বাজি পোড়াতাম। জেঠুর ছেলেরা বাড়িতেই বাজি বানাতেন। আমিও শিখেছিলাম। এখন অবশ্য ভুলে গিয়েছি। আমার বাপের বাড়ির পাড়ায় এখনও কালীপুজোয় বাজি পোড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়। কালীপুজো করে এমন বেশ কয়েকটি ক্লাব সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। আমার ৮ বছরের মেয়ে মিষ্টুও বাজি পোড়াতে ভালবাসে। কিন্তু ওর অ্যাজমা আছে। বারুদের গন্ধে ওর শ্বাসকষ্ট হয়। মিষ্টুর অ্যাজমা ধরা পড়ার পর থেকে আমিও আর বাড়িতে বাজি তুলি না, বানানোর কথা তো ভাবিও না। মেয়েটাই যখন বাজি পোড়াতে পারে না, আমি সেখানে ওর সামনে আনন্দ করি কী করে?’’
বাজি নিয়ে আবার ‘রংবাজি’ও কম হত না। বাজি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা আগেও হত। এখন কম হলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। কয়েকটি জায়গায় হয়। সেই প্রতিযোগিতায় জয়ীপক্ষের জন্য আবার আর্থিক পুরস্কারও থাকে। এখন আতশবাজির প্রদর্শন হয় দোকানে কেনা বাজি দিয়ে। আগে কিন্তু তেমনটা হত না। প্রতিযোগিতা হত হাতে বানানো বাজির। কার বানানো ছুঁচো বাজি সবচেয়ে বেশি ক্ষণ মাঠে দাপিয়ে বেড়াল, সেটাই দেখা হত। সেরা বাজি বানানোর গর্বে চওড়া হত বুক। তেমনই কিছু সোনালি দিনের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন বনগাঁর বাসিন্দা সত্তোরোর্ধ্ব মধুসূদন গোস্বামী। তাঁর কথায়, ‘‘কালীপুজো নিয়ে যত না আনন্দ হত, তার চেয়ে দ্বিগুণ উত্তেজনা থাকত বাজি বানানোর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নিয়ে। দুর্গাপুজোর ছুটি ভাইফোঁটা পর্যন্ত চলত। পড়াশোনা শিকেয় তুলে কালীপুজোর দিন সাতেক আগে আমি আর দাদা বাজি বানাতে বসতাম। ওই কয়েকটি দিন বাবার সঙ্গে মাঠেও যেতাম না। মা-বাবাও কিছু বলতেন না। আমরা দু’জন খেয়ে না খেয়ে সারা দিন ধরে বাজি তৈরি করতাম। তার পর আসত সেই মুহূর্ত। কালীপুজোর পরের দিন হত প্রতিযোগিতা। সারা সকাল উত্তেজনায় কাটত। কোনও বার আমরা জিততে পারতাম না। প্রতিযোগিতা শেষে আরও অনেকের সঙ্গে আমি আর দাদা মুখ চুন করে চলে আসতাম। কিন্তু এক বার আমরা জিতেছিলাম। দাদার তৈরি ঘট বাজিটা সবচেয়ে বেশি ক্ষণ জ্বলেছিল। এখন আর শরীর দেয় না। নয়তো নাতি-নাতনিদের আমিই বাড়িতে বাজি বানিয়ে দিতাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy