নিউ টাউনের ‘আর্টস একর মিউজিয়াম’-এ বসেছিল আলোচনা সভা। নিজস্ব চিত্র।
দেশভাগ নিয়ে নাটক বাংলায় ক’টা লেখা হয়েছে, হাতে গুনে বলা যাবে। ফলে ‘পার্টিশন’ নিয়ে চর্চা আর গবেষণা হলেও, সে বিষয়ক নাটক নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। ব্যতিক্রম হয়ে রইল শুক্র-সন্ধ্যা।
নিউ টাউনের ‘আর্টস একর মিউজিয়াম’-এ বসেছিল সভা। গুণিজনের জমায়েত। চর্চার কেন্দ্রে নাট্যকার ব্রাত্য বসুর লেখা ‘হৃদিপাশ’। ঘটনাচক্রে, তিনি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। ২০১৬ সালের অগস্টে রচিত এই নাটকে নাট্যকার দেশভাগকে দেখেছেন ‘ গ্রিক ট্র্যাজেডি’র আঙ্গিকে। ইতিহাসকে এ ভাবে দেখার প্রচেষ্টা বিরল। দেশভাগের পঁচাত্তর বছরে তাই তা নতুন করে প্রাসঙ্গিক।
এ নাটকের বিষয়টি ঐতিহাসিক। কিন্তু ইতিহাসও যে নাটকীয় হয়! এ ক্ষেত্রে তা কতটা নাটকীয়, নাটকে সে কথা বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হয়েছে আবার নাটকই। অথচ, এত বছরেও সে ভাবে আলোচিত হয়নি এ সময়ের বাংলার অন্যতম চর্চিত নাট্যকারের এই রচনা। হঠাৎ হাতে পেয়ে, সে নাটক পড়ে চমকে গিয়েছেন বিলেতের কলেজের ইতিহাসের তরুণ শিক্ষক মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। অতঃপর সভা। তাঁদের আলোচনায় সঙ্গ দিলেন প্রবীণ দুই চিন্তক, ইতিহাসবিদ সুগত বসু ও শিল্পী শুভাপ্রসন্ন।
চলতি কথায় যে কোনও বড় বিপর্যয়কে ‘ট্র্যাজেডি’ বলা হয়ে থাকে। ‘ট্র্যাজেডি’ কথাটি প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য-ভাবনার অবদান। প্রাচীন গ্রিসে সবচেয়ে উন্নত মানের কাব্য বলে ধরা হত ‘ট্র্যাজেডি’কে। কমেডি, স্যাটায়ার প্লে— এ সব ধরনের নাটককে মনে করা হত তুলনায় হালকা চালের। ট্র্যাজেডি লেখা হত জীবনের গুরুতর বিষয়গুলি নিয়ে। ক্রোধ, হিংসা, লালসা— এমন কত কী থেকেছে ট্যাজেডির কেন্দ্রে। প্রাচীন কালের সে ধরনের নাটক লেখার জন্য কয়েকটি নাম বিখ্যাত। সোফোক্লেস অন্যতম। তাঁর তৈরি ‘অয়দিপাউস’ চরিত্র মনোবিদ্যা থেকে ইতিহাস— নানা রকম জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে এত বছরে। তবে ‘পার্টিশন-চর্চা’য় সে ভাবে দেখা যায়নি। সে ক্ষেত্রে বাঙালি নাট্যকারের অবদান উল্লেখযোগ্য।
অয়দিপাউস চরিত্রটি পিতৃহত্যা এবং মাতৃগমনের জন্য কুখ্যাত। নাট্যকার ব্রাত্যবাবু দেশভাগ ও পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশের ইতিহাসকে অয়দিপাউসের জীবনের ট্যাজেডির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘হৃদিপাশ’ নাটকটি সে ভাবনারই ফসল। আলোচনার শুরুতেই সে কথা উল্লেখ করে সুগতবাবু বলেন, ‘‘দেশভাগ হল বৃহৎ আকারের ট্যাজেডি। তার নানা রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। ব্রাত্যর নাটক সেটিকে একটি বিশেষ ধরনের গ্রিক ট্যাজেডি হিসাবে দেখেছে। পিতৃহত্যার ইতিহাস হিসাবে দেখা হয়েছে দেশভাগকে।’’
ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে পঁচাত্তর বছর আগে। কিন্তু স্বাধীনতার বিনিময়ে এসেছে বড় বিপর্যয়। তিন টুকরো হওয়া ভারত সে ক্ষত আজও সামলে চলেছে। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সব ক্ষেত্রে এখনও বিচরণ করছে দেশভাগের প্রবল ছায়া। এক দিকে যেমন পঞ্জাব ভাগ হয়েছে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে, অন্য দিকে বাংলা ভাগ হয়ে এখন পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ। সে সময়ের রক্তপাত এখনও সমঝোতার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেননি। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে সে কথা মনে করানো হচ্ছে নানা ভাবে। এই সান্ধ্য-আড্ডাও তার অংশ হয়ে রইল।
অয়দিপাউসের জীবনের মূল সমস্যা ছিল নিয়তির সঙ্গে লড়তে না পারা। নাট্যকার দেশের ইতিহাসকেও নিয়তির সেই মারপ্যাঁচের নিরিখেই দেখেছেন। ব্রাত্যবাবু বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকে শম্ভু মিত্রের অয়দিপাউসের রেকর্ডিং শুনেছি। বুঝেছি, নিয়তির কাছে হেরে গিয়েছিল অয়দিপাউস। দেশভাগের কথা ভাবলে মনে হয়, আমরাও সেই হতভাগ্য জাতি, যাদের নিয়তি নিজেদের হাতে নেই। আমরাও পিতৃহত্যা করেছি। মাতৃগমন করেছি। তাই তো এমন পরিস্থিতি আমাদের।’’ এই নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা। সেখানেই নাটকের মূল চরিত্রের হাতে খুন হয় তার পিতা। অয়দিপাউসের মতোই অজান্তে। আর সে নাটক পড়েই মিলিন্দর মনে প্রশ্ন ওঠে, ‘‘ক্ষমতা নিতে গেলেই কি যে কোনও শাসক শ্রেণি হত্যাকে হাতিয়ার করে? যে কোনও প্রভুত্বই কি আদিম হত্যার সৃষ্টিকর্তা?’’ দেশভাগের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার দৌড়ে হত্যা করতে হয়েছে নিজের জনেদেরই। ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গিয়েছেন। মৃত্যুর মুখে একে-অপরকে ঠেলে দিয়েছেন উপমহাদেশের বাসিন্দারাই। নিজেদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কঠিন বাস্তব, যা প্রায় গোটাটাই হিংসা-নির্ভর। সে বাস্তবই ইতিহাসের নৃশংসতা নিয়ে ভাবাচ্ছে। তাই এত বছর পরেও চলছে তা নিয়ে আলোচনা।
আলোচনা চলাকালীন শিল্পী শুভাপ্রসন্নের পেন্টিংয়ের কোলাজ দেখানো হয়েছে প্রজেক্টরের সাহায্যে। কখনও দেওয়ালে ফুটে উঠেছে গ্রিক নাট্যকার-দার্শনিকের ছবি, কখনও বা ছবিতে দেখা গিয়েছে বাংলার কোনও নাট্যকারের মুখ। এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে গিয়ে কথায় কথায় শিল্পী বললেন, ‘‘আজও তো সেই লালসা, সেই প্রতিহিংসা, সেই ঈর্ষা, সেই যৌনতার মধ্যেই বিচরণ করছি আমরা। তাই নতুন কিছু করার যে বাসনা, সে বাসনা থাকবে। কিন্তু আমরা মহাভারতে, গ্রিক কাব্যে থাকব।’’
এর প্রেক্ষিতে সুগতবাবু মনে করালেন নাটকের শেষ গানের কথা। ‘চলো হত্যা করি চলো...’। হত্যা-প্রবাহ যে দেশভাগের পর এত বছরেও থামেনি, তাই যে সে দিকে ফিরে তাকানো জরুরি, সে কথাই তো বলতে চেয়েছিলেন নাট্যকার। আলোচনার শেষ প্রান্তে পৌঁছে উল্লেখ করলেন তিনি নিজেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy