Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Jamai Sasthi 2024 Special

জামাইষষ্ঠীর উৎসব ঘিরে এ পার বাংলার সঙ্গে ও পার বাংলার লড়াই হাড্ডাহাড্ডি! দৌড়ে এগিয়ে কারা?

জামাইষষ্ঠীর আয়োজনে কোনও কমতি রাখা পছন্দ করতেন না সে কালের শাশুড়িরা। আর এখনও সেই নিয়ম চলেছে। বদলেছে শুধু মোড়কটা। জামাইরাও কিন্তু এই দিনটি দিব্যি উপভোগ করেন। এখনকার কর্পোরেট সংস্কৃতিতেও জামাইষষ্ঠী দিব্যি বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

Different rituals of Jamai Sasthi celebrating in Bengali households

জামাই আদরে এগিয়ে কারা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সুদীপা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৪ ১১:০১
Share: Save:

পার্বণের নাম জামাইষষ্ঠী। তা ঘিরে আয়োজন এলাহি। এ দিন শাশুড়িরা জামাইয়ের দীর্ঘায়ু ও কল্যাণের জন্য পুজো দেন এবং জামাইকে আদর করে খাওয়ানোর পর তবেই কিছু মুখে তোলেন। জামাইষষ্ঠীর আয়োজনে কোনও কমতি রাখা পছন্দ করতেন না সে কালের শাশুড়িরা। আর এখনও সেই নিয়মই চলেছে। বদলেছে শুধু মোড়কটা। জামাইরাও কিন্তু এই দিনটি দিব্যি উপভোগ করেন। এই কর্পোরেট সংস্কৃতিতেও জামাইষষ্ঠী দিব্যি বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি অফিসগুলিতে জামাইষষ্ঠীর দিন অর্ধদিবস ছুটি অন্তত সে দিকেই ইঙ্গিত দেয়।

শুরুটা হল যে ভাবে

কথিত আছে, আঠেরো-উনিশ শতকে যখন বিধবাদের জীবনে ছিল সতীদাহের যন্ত্রণা, সেই পরিস্থিতিতে বাঙালি মা ও মেয়েদের কাছে জামাই ও স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা ছিল একটা বড় ব্যাপার। অন্য দিকে, সেই সময়ে বিয়ের পর মেয়েরা ইচ্ছা করলেই বাপের বাড়িতে চলে যেতে পারতেন না। এই ষষ্ঠী উপলক্ষে জামাইকে নিমন্ত্রণ করলে মেয়েরাও একটি দিন খুশিমনে বাবা-মায়ের কাছে আসতে পারতেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে সাবিত্রী চতুর্দশীতে স্ত্রীদের যমের আরাধনা করে স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনার পুরনো লোকাচারটির সূত্র ধরেই নাকি শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীটি জামাইকে নিবেদন করার চল শুরু হয়েছিল। তবে এতেও আছে এ পার-ও পারের দ্বন্দ্ব।

এ পার-ও পারের রকমারি নিয়ম

ফুটবল হোক কিংবা খাওয়াদাওয়া— এ পার বাংলার সঙ্গে ও পার বাংলার টানাপড়েন সবেতেই। জামাইষষ্ঠীর উদ্‌যাপনেও কিন্তু চোখে পড়ে তাঁদের মধ্যে বহু অমিল, বহু ভেদাভেদ। ষষ্ঠী পুজোর সময়ে ও পার বাংলার মায়েরা যে পুজোর ডালি ব্যবহার করেন, তার নাম মুঠা। এ পার বাংলার বাড়িতে আবার সেই পুজোর ডালিটি বাটা নামেই পরিচিত। জামাইষষ্ঠীর দিন জামাইয়ের মঙ্গলকামনায় শাশুড়িরা হলুদ ও সর্ষের তেলে ডোবানো মোটা সুতো বেঁধে দেন জামাইয়ের হাতে। ও পার বাংলার লোকেরা যাকে বলেন বানা। এ পার বাংলার লোকেদের মধ্যে আবার বানা শব্দটির চল নেই। তালপাতার পাখা, গোটা আম, দুর্বা, প্রদীপের তাপের উপচারে জামাই-বরণ না করে কিছু দাঁতে কাটবেন না ও পার বাংলার শাশুড়িরা। তবে এ পার বাংলার অনেক বাড়িতেই জামাইকে পাখার বাতাস করার রেওয়াজ নেই।

Different rituals of Jamai Sasthi celebrating in Bengali households

এ পার বাংলা হোক কিংবা ও পার বাংলা, গ্রাম বাংলার পাশাপাশি শহুরে পরিবেশেও জামাইষষ্ঠী পালনের রীতিনীতি এখনও খুব একটা ফিকে হয়ে যায়নি। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

খানাপিনায় বৈচিত্র

শুধুই কি নিয়ম-আচার? জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে দুই বাংলার খানাপিনাতেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। এ পার বাংলার অনেক বাড়িতেই ষষ্ঠীর দিন উপবাস ভঙ্গের পর নিরামিষ খাওয়ার চল। আগেকার দিনে ওই দিন মূলত চিঁড়ে, দই দিয়ে ফলাহার করানো হত জামাইকে। ভোজের আয়োজন হত অন্য কোনও দিন। জামাইষষ্ঠী ব্যাপারটাই তো ভোজন ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাই এ পার বাংলায় জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে জামাইয়ের পাতে থাকত চিংড়ি, তপসে, পারশে, চিতলের মতো মাছের বাহার। শুভ অনুষ্ঠান বলে মাংস খাওয়ানো হত না জামাইদের। তবে ও পার বাংলার বাড়িতে আবার জামাইষষ্ঠীর দিনই জামাইবাবাজিকে পাত পেড়ে খাওয়ানোর চল। সে দিন জামাইয়ের ভোজে মা‌ছ, মাংস সব রকম পদই থাকত। এখন অবশ্য জামাইদের ব্যস্ততা বেড়েছে। দু’দিন অফিসের ছুটি নিয়ে আসার অবকাশ নেই। তাই ও পার বাংলার পাশাপাশি এ পার বাংলার শাশুড়িরাও একই দিনে ভূরিভোজের আয়োজন করেন জামাইদের জন্য। অনেক শাশুড়ি সে দিন রেস্তরাঁয় গিয়েও আমিষ চেখে দেখেন না, ওইটুকুই নিয়ম মানা।

Different rituals of Jamai Sasthi celebrating in Bengali households

জামাইষষ্ঠীর দিনে জামাইবরণের পাশাপাশি ভূরিভোজেরও আয়োজনটাও কিন্তু ‘মাস্ট’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

বিশেষ দিনের ভূরিভোজে জামাইদের জন্য শাক তো থাকবেই। তবে শাক রান্নার মধ্যেও চোখে পড়বে বৈচিত্র। এ পার বাংলার শাশুড়িরা জামাইয়ের জন্য যে শাক রাঁধেন, তা হয় নিরামিষ। মূলত নারকেল-ছোলা দিয়ে কচুশাক, পোস্ত ছড়িয়ে লাল শাক ভাজাই রান্না করেন তাঁরা। তবে ও পার বাংলার শাশুড়িরা শাক বানালে তাতেও থাকে আমিষের ছোঁয়া। হয় মাছের মাথা দিয়ে পুঁই চচ্চড়ি কিংবা চিংড়ি মাছ কিংবা ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক— মেনুতে যেন এগুলিই ঘোরাঘুরি করে প্রত্যেক বার। এখানেই শেষ নয়, পটলের দোরমাটা কম-বেশি সব শাশুড়ির মেনুতেই থাকে। তবে এ পার বাংলার শাশুড়িরা পটলের ভিতরে ডাল কিংবা ছানার পুর ভরেন। অন্য দিকে, ও পার বাংলার শাশুড়িরা আবার পটলে ভরে ফেলেন শুঁটকি, চিংড়ি কিংবা মাংসের পুর। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে গেলে কিন্তু এ পার বাংলার শাশুড়িদের রান্নায় খুব বেশি তেল, ঝাল, মশলার আধিক্য থাকে না। তবে জামাইবাবাজি যদি ও পার বাংলার হন, তা হলে তাঁর শাশুড়ির রান্নায় খানিকটা মিষ্টি বেশি লাগতে পারে। অন্য দিকে, ও পার বাংলায় তেল-মশলাদার রান্না করার চল বেশি। সেই খাবার খেয়ে এই গরমে জামাইদের পেটের অবস্থা ভাল থাকলেই হল!

শোভাবাজার রাজবাড়ির গল্পকথা

শোভাবাজার রাজবাড়িতেও জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে এলাহি আয়োজন হত সব সময়েই। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের ছেলে রাজকৃষ্ণ দেবের মোট আট ছেলে। এখন শোভাবাজার এলাকায় সেই আট ছেলের পরিবার-পরিজনেরাই রয়েছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাজপরিবারে কখনওই একসঙ্গে জামাইষষ্ঠীর আয়োজন হত না, আট বাড়িতেই আলাদা আলাদা নিয়মেই করা হত জামাইবরণ। রাজকৃষ্ণ দেবের ছোট ছেলের পরিবারের শেষ রাজা গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দেবের এক মাত্র জীবিত নাতনি ৯৪ ব‌ছরের কৃষ্ণ সন্ধ্যা বসুর কাছ থেকে পুরনো দিনের সেই গল্প শুনে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন মেজোছেলে কালিকৃষ্ণ দেবের পরিবারের সদস্য কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দেবের এগারো জন ছেলে ও বারো জন কন্যা নিয়ে বিশাল সংসার। জামাইষষ্ঠীর দিনে কিন্তু বাড়ির বৌদের বাপের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। বাড়ির জামাইদের আপ্যায়নের কাজেই তাঁরা ব্যস্ত থাকতেন। দিনের বেলায় নয়, রাতের বেলাই জামাইরা বাড়িতে আসতেন। মালা পরিয়ে, চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, পাখার বাতাস দিয়ে বরণ করা হত জামাইদের। করা হত নৈশভোজের এলাহি আয়োজন। রুপোর থালা-বাটিতে ভাত, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, হরেক রকমের সব্জি, তিন রকম মাছের পদ, পাঁঠার মাংস, তিন পদের চাটনি, দই, মিষ্টি, রাবড়ি, সন্দেশ, রকমারি ফল সাজিয়ে পরিবেশন করা হত জামাইদের। রাজবাড়িতে রান্নার দায়িত্ব ছিল মূলত বাবুর্চি ও রাঁধুনিদের উপর। বাবুর্চিদের আনা হত চট্টগ্রাম থেকে। তাঁরা চপ-কাটলেট, প্যান্থারাস, স্যুপ, পুডিংয়ের মতো সাহেবি পদগুলি রান্না করতেন। তাঁরা থাকতেন বাড়ির বাইরে অন্য জায়গায়। সেখানেই হত রান্নাবান্না। তবে জামাইষষ্ঠীর দিন কিন্তু ওড়িয়া রাঁধুনিরাই রান্নার দায়িত্বে, বিশষ দিনের রান্নায় তাঁদের সাহায্য করতেন বাড়ির বৌমারা।’’ কৃষ্ণ শর্বরী আরও বলেন, ‘‘শোভাবাজার রাজবাড়ির অন্যান্য ভাইদের বাড়িতে কিন্তু সকাল এবং রাত দু’বেলাতেই জামাইষষ্ঠীর জন্য এলাহি খাবারের আয়োজন করা হত। দিনের বেলা ভাত-পোলাওয়ের ব্যবস্থা হলেও রাতে পরোটা, লুচি, কালিয়া, মালাইকারির মতো পদগুলি রাঁধা হত জামাইদের জন্য।’’

Different rituals of Jamai Sasthi celebrating in Bengali households

পুজোর সময় ও পার বাংলার মায়েরা যে পুজোর ডালি ব্যবহার করেন তার নাম মুঠা, এ পার বাংলায় সেটি আবার বাটা নামেই পরিচিত। ছবি: সংগৃহীত।

আরও কিছু কাহিনি

এ বছর সুদীপা চট্টপাধ্যায়ের বাড়িতে জামাইষষ্ঠী হবে না। এ বছর জানুয়ারি মাসে তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়েছে। আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথাবার্তায় তাঁর মনে পড়ে গেল পুরনো দিনের স্মৃতিগুলি। সুদীপার মা এ পার বাংলার রীতিনীতি মেনেই জামাই অগ্নিদেব চট্টপাধ্যায়কে বরণ করে নিতেন। সুদীপা বললেন, ‘‘মা অগ্নিকে মাছের মাথা, পাঁচ রকম ভাজা দিয়ে সাজিয়ে ভূরিভোজ খাওয়াতেন। খাওয়াদাওয়ার আগে অবশ্য অগ্নি ও আদিকে পাশে বসিয়ে ওদের আরতি করতেন, হাতে একটি ফল দিতেন আর পাখার হাওয়াও দিতেন। মা এখন নেই, তবে তিনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ওঁর মৃত্যুর পরেও জামাইষষ্ঠীর দিন অগ্নিকে একই ভাবে আদরযত্ন করা হয়। এ বছর নয়, তবে পরের বছর থেকে জামাইষষ্ঠীর দিনে মায়ের কথা মতো আমিই অগ্নির জন্য রান্না করব, ওকে সাজিয়ে-গুছিয়ে খেতে দেব।’’

২৪ বছর বয়সি স্নেহা তালুকদার। জামাইষষ্ঠী নিয়ে তাঁর মনেও ভেসে উঠল বেশ কয়েক বছরের আগেকার স্মৃতি। স্নেহা বলেন, ‘‘আমার বাবারা বরিশালের লোক। বরিশালের লোকেদের নাকি জামাইষষ্ঠীর নিয়ম নেই। তাই ঠাকুরমাকে কখনওই দেখিনি ষষ্ঠীর পুজো করতে। মনে আছে বছর দশেক আগেও আমি জামাইষষ্ঠীর দিনে বাবা-মায়ের সঙ্গে দিদার বাড়ি যেতাম। আগের রাতেই পৌঁছে যেতাম আমরা। সকাল হলেই দিদার সঙ্গে পুকুরপাড়ে যেতাম। দিদার বন্ধুরা সবাই দলে দলে নাচতে নাচতে পুকুরপাড়ে জমা হতেন। পুকুরের জলে ডুব দিয়ে শুরু হত নিয়ম-আচার। তার পর বাড়ি ফিরে দিদা বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাকেও পাখার হাওয়া দিতেন। করমচা, দূর্বা, বটপাতা, লালসুতো আর ছয় রকম ফল দিয়ে হত পুজো। পুজোর শেষে চলত উপহার দেওয়ার পর্ব। জামাইষষ্ঠীর অজুহাতে আমারও একটি করে জামা পেতাম। তার পর হত খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন। তবে এখন দিদার বয়স হয়েছে, তাই আর তিনি এত আয়োজন করতে পারেন না। সেই মধুর স্মৃতিগুলি জামাইষষ্ঠীর দিনে যেন আরও বেশি করে মনে পড়ে যায়।’’

মনেপ্রাণে যতই আমরা আধুনিক হই না কেন, কিছু কিছু প্রথা-পার্বণ এখনও বাঙালি ঘরে থেকে গিয়েছে। তবে পুরনো লোকাচারগুলি হাজির হচ্ছে নতুন মোড়কে, জামাইষষ্ঠীর আয়োজনেও জড়িয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এ পার বাংলা হোক কিংবা ও পার বাংলা, গ্রামবাংলার পাশাপাশি শহুরে পরিবেশেও জামাইষষ্ঠী পালনের রীতিনীতি এখনও খুব একটা ফিকে হয়ে যায়নি। রকমারি পদ রেঁধে-বেড়ে জামাইকে খাওয়ানোর আহ্লাদ আগেও ছিল, এখনও আছে। আদরের ‘জামাইবাবাজি’র আপ্যায়নের ধরনটা বদলেছে শুধু। সারা দিন ধরে ঘেমেনেয়ে রান্নার জোগাড় করা থেকে শুরু করে জামাইয়ের জন্য ভূরিভোজ বানানোর ব্যাপার বদলে দিয়েছিল কিছু বাঙালি রেস্তরাঁর ‘জামাইষষ্ঠী স্পেশ্যাল থালি’।

অন্য বিষয়গুলি:

Jamai Sasthi Jamai Sasthi Special Bengali Rituals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy