শরীরের মধ্যে যে কোনও যন্ত্রণা স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটায়। কোনও কোনও যন্ত্রণা এতটাই মারাত্মক হতে পারে যে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও থাকে না। সায়াটিকা স্নায়ুর যন্ত্রণা বা সায়াটিকা নার্ভের পেন তেমনই এক সমস্যা। যদিও ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে ওষুধ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা যায়।
ব্যথার লক্ষণ
হঠাৎ করে কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি বিশেষ করে গোড়ালির পিছন অবধি অসহ্য যন্ত্রণায় হাঁটাচলা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। পা ফেলা তখন দায়। ঠিক মতো দাঁড়ানোই যায় না। কিছু ক্ষেত্রে আলপিন ফোটার মতো যন্ত্রণা হয় পায়ের পাতায়। কখনও আবার পায়ের বিশেষ বিশেষ অংশে জ্বালাভাব অনুভূত হয়, অবশ হয়ে যায়। সাধারণত একসঙ্গে দুটো পায়ে সায়াটিকার ব্যথা হয় না। এই ধরনের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই প্রথমে ঠান্ডা-গরম সেঁক দিয়ে থাকেন, ব্যথা কমানোর মলম লাগান বা প্যারাসিটামল ওষুধ খান। কিন্তু এতে সাময়িক ভাবে ব্যথা কমলেও ক’দিন পরে আবার ফিরে আসবে। এই সমস্যার উৎপত্তি নার্ভ থেকে। তাই ফেলে না রেখে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কেন হয়?
শুধু কি বয়স্কদের এই সমস্যা হয়? ‘‘না, বরং অল্পবয়সিদের বা মধ্য পঞ্চাশের নীচেই এই রোগ বেশি হয়। কারণ কমবয়সিরাই বেশি পরিশ্রম করেন, দুমদাম ভারী জিনিস তোলার মতো কাজ বেশি করেন। এই ধরনের কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ পেশি ও স্নায়ু আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে,’’ বললেন নিউরোসার্জন ডা. জয়ন্ত রায়।
সায়াটিকা আমাদের শরীরের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে মোটা নার্ভ। যা শুরু হয় স্পাইন বা মেরুদণ্ড থেকে। এর একাধিক রুটের মধ্যে কিছু আসছে কোমরের নীচের দিকে লাম্বার স্পাইন থেকে। সেখানে আঘাত পেলেও এই ব্যথা হয়। সে জন্য এই সমস্যাকে লাম্বোসায়াটিকা পেনও বলা হয়। আর বাকি রুটের উৎপত্তি মেরুদণ্ডের শেষ অংশ থেকে, যাকে স্যাক্রাম বলে। এই নার্ভরুটগুলো একসঙ্গে হয়ে ডান-বাঁ দু’দিকে কোমর ও নিতম্বের নীচ থেকে একেবারে পায়ের গোড়ালি অবধি চলে যায়।
সায়াটিকা পেন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। গাড়িতে যেমন শক অবজ়ার্ভার থাকে তেমন মেরুদণ্ডের হাড়ের মাঝেও ছোটছোট হাড়ের বাক্সের মাঝে ডিস্ক থাকে, যারা শক অবজ়ার্ভারের কাজ করে। কোনও কারণে যখন ডিস্ক ফেটে ভিতরের জেলির মতো মাংসপিণ্ড বেরিয়ে এসে নার্ভরুটগুলোতে ধাক্কা মারে, তখন সেখানে ব্যথা হয়। এটি টিপিক্যাল সায়াটিকা পেনের কারণ। এ ছাড়া নার্ভের কোনও অসুখ হলে তার থেকেও এই ধরনের সমস্যা হয়। স্পাইনাল কর্ডে টিউমর হলে তার চাপ নার্ভরুটগুলোর উপরে পড়ে এই ধরনের ব্যথা হয়। সায়াটিকা নার্ভ যেখান দিয়ে নামছে, সেখানকার পেশিতে যদি আঘাত লাগে বা পেশি ছিঁড়ে যায় তা হলে ব্যথা হয়। এই ধরনের সমস্যাকে পাইরিফরমিস সিনড্রোম বলে। এ ক্ষেত্রে টিপিক্যাল সায়াটিকা পেনের মতো কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি টানা ব্যথা নাও হতে পারে। কখনও মেরুদণ্ডের পিছনে, শুধু পায়ের নীচে বা কাফ মাসল বা থাইয়ের অংশবিশেষে ব্যথা হতে পারে। ওবেসিটি, ডায়াবিটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস সায়াটিকা পেনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া দুর্ঘটনার জন্য কোমরে আঘাত পেলে বা ভেঙে গেলেও সায়াটিকা পেন হতে পারে। অনেক সময় প্রেগন্যান্ট মহিলাদের এই সমস্যা হয়। গর্ভাবস্থায় একধরনের হরমোন শরীরের ভিতরে নিঃসরণ হয়, যা লিগামেন্টগুলি শিথিল করে দেয়। এর ফলে মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলি পিছলে গিয়ে এই ব্যথা হতে পারে। যদিও প্রেগন্যান্সির জন্য এই সমস্যা হওয়ার রেকর্ড বেশ কম।
বিধিনিষেধ
এই ব্যথার সমস্যায় প্রথমেই অন্তত দু’সপ্তাহ শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। এ সময়ে হাঁটাচলা যত কম করা যায়, তত তাড়াতাড়ি সুফল পাওয়া যাবে। চিকিৎসা চলাকালীন কোনও ভারী জিনিস বহন করা বা মাটি থেকে তোলা যাবে না। বেন্ট হওয়া বা মাটিতে বসা যাবে না। এতে নার্ভের উপরে আরও চাপ পড়বে আর চাপ পড়লে ব্যথা বাড়বে। যাঁরা জিমে গিয়ে শারীরচর্চা করেন, এ সময়ে জিমে যাওয়া বন্ধ রাখুন। সুস্থ হওয়ার পরে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তবেই এক্সারসাইজ় শুরু করবেন। যাঁরা টানা বসে কাজ করেন, তাঁরা মাঝেমাঝে চেয়ার থেকে উঠে হেঁটে আসুন এবং মেরুদণ্ডের উপযুক্ত চেয়ার ব্যবহার করতে হবে। সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার পরেও বসা ও শোওয়ার ভঙ্গি ঠিক রাখা জরুরি। ড্রাইভিংয়ের সময় পিঠের সাপোর্টের জন্য সিটে ছোট একটা বালিশ রাখা প্রয়োজন। সায়াটিকা পেন কমে যাওয়ার পরেও পিঠের পেশি শক্তিশালী রাখতে, হাড়ের জয়েন্টগুলো সচল রাখতে ও হাড় মজবুত রাখতে চিকিৎসকেরা কিছু ব্যায়াম দিয়ে থাকেন, তা আজীবন করে গেলে শুধু সায়াটিকা নয় অন্য অনেক সমস্যার নিরাময় সম্ভব। ‘‘শুধু নিরাময়ের পরে নয়, একটা বয়সের পর থেকে পেশি মজবুত রাখা ও লিগামেন্ট ফ্লেক্সিবল রাখার জন্য এ ধরনের এক্সারসাইজ় করলে এই ধরনের সমস্যা অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া যায়। পাশাপাশি অবশ্যই পুষ্টিকর ডায়েটের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে,’’ বললেন ডা. জয়ন্ত রায়।
খাওয়াদাওয়ায় কোনও বিধিনিষেধ না থাকলেও ধূমপান এবং অতিরিক্ত জাঙ্কফুড খাওয়া এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। সায়াটিকা নার্ভের যন্ত্রণা শুরু হলে বাড়িতে বসে না থেকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি রোগের উৎস জানা যাবে তত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করে সেরে ওঠা সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy