হাঁটুর ব্যথা এখন প্রতিটি ঘরের সমস্যা। ব্লাড প্রেশার, ডায়াবিটিসের মতোই এই রোগও জাঁকিয়ে বসেছে বাঙালি পরিবারে। মধ্য চল্লিশেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন হাঁটুর ব্যথায়। ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। বয়সের সঙ্গে হাড়ের ক্ষয়ও বাড়তে থাকে। তবে একেবারে অল্প বয়সে হাঁটুতে ব্যথা হওয়ার সাধারণত কোনও কারণ নেই।
হাঁটুর ব্যথার কারণ
জন্মগত কারণে কারও কোনও ডিফর্মিটি থাকলে, কোনও সংক্রমণ হলে, চোট লাগলে, আর্থ্রাইটিস হলে বা কার্টিলেজে আঘাত লাগলেও হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। আবার কিছু কিছু টিউমরের কারণেও নি-পেন হতে পারে।
আর্থ্রাইটিসের প্রকারভেদ:
প্রায় একশো ধরনের ভাগ থাকলেও, সাধারণত এই দু’টিই দেখা যায়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এতে শুধু জয়েন্ট নয়, অনেকের ক্ষেত্রে ত্বক, চোখ, হার্টও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
উপসর্গ: জয়েন্ট স্টিফ হয়ে যাওয়া, বিশেষত কাজের পরে ব্যথা বেশি বাড়া, জ্বর, খিদে কমে যাওয়া, অবসাদ, জয়েন্ট ফুলে যাওয়া।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রথমে ছোট জয়েন্টগুলির ক্ষতি করে। অর্থাৎ আঙুল আর হাতের জয়েন্ট বা পায়ের আঙুলের সঙ্গে পায়ের পাতার অস্থিসন্ধি।
রোগটা যত বাড়তে থাকে, কব্জি, হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, কাঁধে ব্যথা বাড়তে থাকে। সাধারণত দেহের দু’দিকের একই জয়েন্ট এতে আক্রান্ত হয়। অনেকের ক্ষেত্রে জয়েন্টে হয়তো কোনও উপসর্গ হয়ই না। তাঁদের ক্ষেত্রে ত্বক, চোখ, ফুসফুস, হার্ট, কিডনি অথবা স্যালাইভারি গ্ল্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিস: রিউমাটয়েড এবং অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের উপসর্গগুলি মোটামুটি একই। তবে বয়স এ ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর। বয়সের সঙ্গে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে। পাঁচটি পর্যায়ে এই রোগ বাড়তে পারে।
ফোলা বাড়লে: জয়েন্টের মধ্যে সাইনোভিয়াল ফ্লুয়িড বাড়তে পারে। সাধারণত হাঁটাহাঁটির সময়ে এই ফ্লুয়িড ঘর্ষণ কমায়। তবে এর পরিমাণ বাড়লে জয়েন্ট ফুলতে পারে। ভাঙা কার্টিলেজের অংশবিশেষও সাইনোভিয়াল ফ্লুয়িডে ভাসতে পারে। এর ফলে ব্যথা ও ফোলা দুই-ই বাড়বে।
ব্যথা বাড়লে: কাজ করলে তো ব্যথা বাড়বেই। তবে যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখনও ব্যথা হতে পারে। আর দিন যত বাড়বে, ব্যথাও তত বাড়বে।
দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত: জয়েন্টে ব্যথা, আড়ষ্টতার কারণে হয়তো হাঁটু ঘোরাতেও সমস্যা শুরু হবে। এতে রোজকার কাজেও ব্যাঘাত ঘটবে।
জয়েন্টের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া: অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের তীব্রতা বাড়লে জয়েন্টের ভারসাম্যও বিঘ্নিত হয়। হঠাৎ জয়েন্ট লক হয়ে গেলে বা হাঁটু একেবারে জরাজীর্ণ হয়ে গেলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
অন্য উপসর্গ: পেশির দুর্বলতা, জয়েন্ট ডিফর্মিটিও হতে পারে।
অস্টিয়োপোরোসিস: হাড় যখন এতটাই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যায় যে, হালকা ধাক্কাতেও হাড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়, সেই অবস্থাকে অস্টিয়োপোরোসিস বলে। সাধারণত মেরুদণ্ড, কব্জি ও নিতম্বে এই ক্ষয় বেশি হয়। মেনোপজ়ের পরে মহিলাদের অস্টিয়োপোরোসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অস্থি বিশেষজ্ঞ ডা. সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, যে কোনও ধরনের আর্থ্রাইটিসজনিত ব্যথা থেকে দূরে থাকতে বা এই রোগের গ্রোথকে স্তিমিত করতে ছোট বয়স থেকেই তিনটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে— সুষম ডায়েট, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। এখনকার সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে খুব অল্প বয়স থেকেই ওবেসিটিতে ভুগতে শুরু করেন অনেকে। পরবর্তী কালে তাঁদের হাঁটুর সমস্যার জন্য আগেভাগেই সতর্ক করলেন চিকিৎসক।
হাঁটু প্রতিস্থাপন কখন করবেন?
রোগীদের দু’টি বিষয় জানা জরুরি।
ব্যথা: কোনও রকম মেডিক্যাল বা নন-ইন্টারভেনশনাল থেরাপির পরেও ব্যথা যদি প্রশমিত না হয়, তখন সার্জারির জন্য ভাবা যেতে পারে। অর্থাৎ ইঞ্জেকশন, স্টেরয়েড কোনও কিছুতেই ব্যথা না কমলে সার্জারির দিকে যেতে হতে পারে।
ডিফর্মিটি বাড়তে থাকলে: খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা, পায়ের পাতা ঠিক করে ফেলতে না পারা... এই ধরনের উপসর্গ বাড়তে থাকলেও প্রতিস্থাপনের কথা ভাবতে পারেন।
অস্ত্রোপচারের পরে যত্ন:
ঠিক পরপরই: সংক্রমণ যাতে কোনও ভাবে না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখুন। কারও সর্দিকাশি হলে, সে ধরনের ব্যক্তির কাছাকাছি না থাকা ভাল। ড্রেসিং, বরফ ঘষা, প্যাড দেওয়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়ামও জরুরি।
দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের জন্য: প্রথমে ওয়াকার নিয়ে, পরে লাঠি নিয়ে হাঁটতে হবে। রোগীকে সচল থাকতে হবে। মাসল পাওয়ার বাড়াতে হবে।
হাঁটু বাদে দেহের যে কোনও অঙ্গে সংক্রমণের প্রবণতা থাকলে, (দাঁত, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট, সাধারণ সর্দিকাশি) তা অবহেলা করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ় চালু করা উচিত। তবে সার্জারির পরে কোন রোগী কী ভাবে থাকবেন, তা সেই রোগীর মেডিক্যাল হিস্ট্রি বিচার করে নির্ধারিত হবে।
অস্ত্রোপচার পরবর্তী সমস্যা:
অনেক রোগীর হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরেও ব্যথা হয়। তার পিছনে কতকগুলি কারণ থাকে। রোগীর ঠিক কোন পর্যায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছিল, সেটা দেখতে হবে। পা অনেকটা বেঁকে যাওয়ার পরে যদি রোগী সার্জারি করান, তবে দীর্ঘদিন ওই ভাবে হাঁটার ফলে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। অনেক সময়ে অ্যালাইনমেন্ট পুরোপুরি ঠিক করা যায় না। তার জন্য অস্ত্রোপচারের পরেও ব্যথা হতে পারে। কোনও রকম সংক্রমণ হলেও ব্যথা হতে পারে। তবে এই ব্যথা একটা সময়ের পরে ঠিক হয়ে যায়। অস্ত্রোপচারের ১৫-২০ বছর পরে যখন কৃত্রিম হাঁটুও ক্ষয় হতে থাকে, তখন সেই ক্ষয়িষ্ণু পার্টিকলের কারণেও ব্যথা হতে পারে। দেহের অন্য অংশে সংক্রমণের কারণেও ব্যথা হতে পারে।
হাঁটুজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আগেভাগেই সচেতন হোন।
(মডেল: ভারতী লাহা, ছবি: অয়ন নন্দী, মেকআপ: চয়ন রায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy