হাল ফিরলেও চিকিৎসক না থাকায় ফাঁকা পড়ে কেতুগ্রাম ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
৩১০ জনের জায়গায় ১১০। খাতায় কলমে বর্ধমান জেলার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির চিকিৎসকের পরিসংখ্যানটা এ রকমই।
বাস্তব অবশ্য আরও করুণ। চিকিৎসকের সংখ্যা এতটাই কম যে জোড়াতালি দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না জেলা স্বাস্থ্য দফতর। ফলে চিকিৎসকেরা অভাবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চড়াও হয়ে ভাঙচুর চালানোর মতো ঘটনা ঘটেছে, চিকিৎসকের দাবিতে রাস্তা অবরো, অবস্থান-আন্দোলনেও নেমেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্বাস্থ্য কর্তারা মেনেই নিচ্ছেন, চিকিৎসকের দাবিতে ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা আরও বাড়বে। তাঁরা বলছেন, “নতুন নিয়োগ না হলে অপ্রীতিকর অবস্থা এড়ানো খুবই মুশকিল।”
কয়েকদিন আগে রাতে আউশগ্রামের বননবগ্রাম স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রাতে এক জখমকে নিয়ে যাওয়া হলে উপস্থিত নার্স চিকিৎসক নেই বলে ‘রেফার’ করে দেন। পরের দিন ঘণ্টা ছ’য়েক গুসকরা-সিউড়ি রোড অবরোধ করেন স্থানীয়রা। পরে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে ২ জন চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তাঁরাও অনিয়মিত বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। আবার দিন তিনেক আগেই সন্ধ্যায় জলে ডোবা এক বালিকাকে নিয়ে সিঙ্গত গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়েছিলেন মঙ্গলকোটের মাথরুন গ্রামের বাসিন্দারা। এখানেও চিকিৎসক নেই বলে রেফার করে দেন নার্স। অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পথে বালিকাট মারা গেলে হাসপাতালে ভাঙচুর চালান, নার্সকে মারধর করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার অসহায় স্বীকারোক্তি, “বাড়ির পাশে স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, অথচ চিকিৎসা মেলে না। ক্ষোভ জমতে জমতে একদিন ফাটবেই।’’
আগাছায় ঢেকেছে চন্দ্রপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
বেশ কয়েক বছর আগে, বাম আমলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মহকুমা এবং জেলা হাসপাতালের উপর চাপ কমাতে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির হাল ফেরানো হবে। তাতে প্রসবের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমন ছোটখাটো রোগ কিংবা জখম রোগীর চিকিৎসাও করা যাবে। বিশ্বব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে এই পরিকাঠামো তৈরি হবে বলেও ঠিক হয়। সেই মতো জেলার ১০৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে ৩২টিকে প্রাথমিক পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য দফতর ঘোষণা করে, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে ১০ শয্যার হাসপাতালে পরিণত করা হবে। এই ৩২টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে ২০১১-১২ সালে ২৪টির পরিকাঠামো নতুন করে তৈরি করা হয়। খরচ হয় ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। গত বছর বর্ধমানে এসে মুখ্যমন্ত্রী আরও চারটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যেকেন্দ্রের নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। দশ শয্যার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি তৈরি করতে জেলা প্রশাসনের খরচ হয় এক কোটি টাকারও বেশি। বাকি চারটির মধ্যে ২টিতে এখনও কাজ চলছে। মঙ্গলকোটের লাখুরিয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজ শেষ হওয়ার পরে গোটা ভবন জুড়ে ফাটল দেখা দেওয়ায় স্বাস্থ্য দফতর তা ঠিকাদারের কাছ থেকে নেয়নি। আউশগ্রামের ভেদিয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির কাজও স্থানীয়দের বাধায় দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি কাজ শুরু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
তবে এই ৩২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামেই দশ শয্যার হাসপাতাল। গত চার-পাঁচ বছরে এক দিনের জন্যেও রোগী ভর্তি হননি এখানে। কেতুগ্রামের শিবলুন, মেমারি বোহারের মতো বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর শয্যা, স্যালাইন রাখার স্ট্যান্ড, অক্সিজেন সিলিন্ডার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি এখনও হাসপাতালে উন্নীত হয়নি। স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক কর্তাই জানিয়েছেন, দশ শয্যার একটি হাসপাতাল ২৪ ঘন্টা চালু রাখতে অন্তত চার জন চিকিৎসক, সাত জন নার্স, এক জন ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন। কিন্তু নতুন চিকিৎসক দেওয়া তো দূরের কথা, যেখানে ২ জন চিকিৎসক রয়েছেন, সেখান থেকেও চিকিৎসক তুলে অন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে অবস্থা সামাল দিতে হচ্ছে। ফলে শুধুই বহির্বিভাগ চালু রয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের একটি রিপোর্টেও দেখা গিয়েছে, ২২টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাত্র ২টিতে কোনও চিকিৎসকের পদ ফাঁকা নেই। বাকি ১০৬টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মধ্যে অন্তত ৪০টিতে এক জন চিকিৎসকও নেই। চারটি গ্রামীণ হাসপাতালের মধ্যে এক মাত্র মেমারি গ্রামীণ হাসপাতালের অবস্থা তুলনামূলক ভাল। ৬ জনের মধ্যে পাঁচ জন চিকিৎসক রয়েছেন এখানে। ভাতারে চার জন ও পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুরে ২ জন চিকিৎসক রয়েছেন। আর মঙ্গলকোটের সিঙ্গতে ৫০ শয্যার হাসপাতালে এক জন চিকিৎসকই ভরসা। ফলে শুধু বহির্বিভাগই সম্বল বাসিন্দাদের। আবার বহু স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নীত করার সময়ে শৌচাগার, পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য দফতরের একটি রিপোর্ট বলছে, দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার না হওয়ায় তার অনেকগুলির খারাপ হয়ে গিয়েছে। আবার অনেক জায়গায় শৌচাগার ও পানীয় জল এলাকার বাসিন্দারাই ব্যবহার করছেন।
কিন্তু চিকিৎসকের ঘাটতির কারণ কী? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছরে ৭৫ জন নতুন চিকিৎসক বর্ধমান জেলায় যোগ দিতে এসেছিলেন। তার মধ্যে মাত্র ২০ জন যোগ দিয়েছেন। তার উপর জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মসূচীর চিকিৎসক সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। ৩৫ জনের জায়গায় রয়েছেন ১৬ জন। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্যও বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ছুটিতে রয়েছেন। ফলেই জেলা জুড়েই চিকিৎসক-সঙ্কট চলছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায়ও বলেন, “নার্স বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী চাইলে ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। কিন্তু চিকিৎসকের দাবি মেটানো অসম্ভব।” (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy