চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সুস্থ থাকুন। ছবি: শাটারস্টক।
বাড়িতে আমরা কেবল দু'জন। আমি ও আমার মেয়ে। বিরাট এক আবাসনে থাকি। যেখানে হাজারো নিয়ম। পরিচারিকারা আসবে না। বাইরের লোক ঢুকবে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও একেক বারে পরিবার পিছু একজন বেরতে পারবেন, খুব দরকার হলে তবেই। ইত্যাদি। নিজেরাও সাবধানতার নিয়ম মেনেছি অক্ষরে অক্ষরে।
মেয়ে একদিন বাড়ি ফিরল প্রবল জ্বর নিয়ে। সঙ্গে কাশি, গা-হাত-পা ব্যথা, মাথা ব্যথা। নিয়ম মেনে তাকে সংযুক্ত শৌচাগার-সহ আলাদা ঘরে রেখে দিলাম। ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ চলল। খাবার বানিয়ে দরজার কাছে রেখে দিতাম। সে খেয়ে, বাসন ধুয়ে বের করে দিত। আমি পরে আবার ধুয়ে আলাদা করে রাখতাম। তাও শেষরক্ষা হল না।
তিন দিনের মাথায় আমার গলা ব্যথা শুরু হল। তার পরদিন মাথা ব্যথা দিয়ে শুরু হয়ে ১০০ মতো জ্বর। সঙ্গে শুকনো কাশি। চেনা হোম ডেলিভারি পরিষেবাকে বললাম একদিন অন্তর চার বেলার খাবার দরজার বাইরে রেখে যেতে। কি-হোলে চোখ রেখে যখন দেখতাম, সামনের সব ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ, খাবার ঢুকিয়ে আবার এঁটে দিতাম দরজা।
আরও পড়ুন: বর্ষার আবহে করোনা দোসর, জামাকাপড় যত্নে রাখতে এই সব মানতেই হবে
ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম ফোনে। তাঁর কথা মতো ওষুধ আনিয়ে খেতে লাগলাম দু'জনে। মেয়ে সেরে গেল ৬ দিনের মাথায়। আমার জ্বর চলতেই লাগল। সঙ্গে কাশি আর মারাত্মক দুর্বলতা। ডাক্তার বললেন, যতটুকু পারেন খান আর ঘুমান। দিনে ৪-৫ বার আদা-চা, ভেষজ কাড়া, গার্গল, স্টিম, প্যারাসিটামল, অ্যান্টিবায়োটিক, সাপ্লিমেন্ট চলতে লাগল। ক'দিন পর মনে হল, কোভিড টেস্ট কি করা দরকার? ভয়ও লাগছিল।
ঘরের বাইরে খাবার রেখে আসুন জ্বর হলেও। ফাইল ছবি।
সবাই কী ভাববে! যদি ফ্ল্যাট থেকে চলে যেতে বলে? যাব কোথায় এই পরিস্থিতিতে! যদিও আমার ডাক্তার একবারও কোভিড টেস্ট করতে বলেননি। বার বার একই কথা বলেছেন, "দুশ্চিন্তা করছেন কেন, কোভিড ছাড়া কি বাজারে রোগ নেই! আপনাদের এমনি ভাইরাল জ্বর হয়েছে। তাও নিরাপত্তার খাতিরে এক পা-ও বাইরে বেরবেন না। সব সেরে যাওয়ার পরও কম করে ১৫ দিন ঘরে থাকবেন।"
কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, আমি বা আমার ডাক্তার যা-ই ভাবি না কেন, জ্বর আর গলা ভারী বলে সবাই ধরে নিয়েছে, কোভিড হয়েছে। কাছের মানুষদেরও অগাধ কৌতূহল! ফোন করে ভারী গলা শুনে একটাই প্রশ্ন, "টেস্ট করেছ?" "কীসের টেস্ট?" "না, ওই আর কী! অবশ্য তোমার কিছু হয়নি, ভয় নেই।"
কেউ কেউ আবার খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন, "জ্বর কত থাকছে? কাশিটা কি শুকনো? কফ উঠছে? আচ্ছা, খাবারের স্বাদ পাচ্ছ? গন্ধ পাচ্ছ? ঘরের কাজ কে করছে? কাজের লোক আসছে না? কেন?" ইত্যাদি ইত্যাদি।’
আরও পড়ুন:আক্রান্তের বীর্যেও এ বার মিলল করোনাভাইরাসের আরএনএ!
অথচ কেউ একবার জানতে চাইছে্ন না, কী খাচ্ছি? কিছু খাবার পাঠাবেন কি না বা কোনও কাজে লাগতে পারেন কি না? বুঝলাম, কারও মৃত্যুর খবর শুনলে অনেকে যেমন নিজের দিন ঘনিয়ে এসেছে ভেবে কাঁদতে বসে, এও তেমনই। খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নেওয়া, যাতে তাঁদের যদি হয় কখনও এমন, সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এদিকে ৭ দিন কাটল, ১০ দিন কাটল, কেটে গেল সপ্তাহ দুয়েকও। আমি আর সারি না। হঠাৎ একদিন জ্বর বাড়ল। এতদিন ছিল ১০০, এখন কখনও ১০১, কখনও ১০২। তার পর আবার ১৬ দিনের মাথায় হঠাৎ জ্বর ছেড়ে গেল। শুরু হল ভয়ানক কাশি। দু'দিন অবিরাম। ডাক্তার কাফ সিরাপ দিলেন। একটু ঠিক হল। আবার একদিন দুপুরে জ্বর। ১০০। আর সারা দিন নেই। পরদিন আবার দুপুরে ১০০। তিন সপ্তাহ বাদে জ্বর ছেড়ে গেল।
আরও পড়ুন:প্রতিবেশী বা আবাসনে কেউ করোনা আক্রান্ত? যা যা খেয়াল রাখতেই হবে
আমি কি তাহলে সেরে গেলাম একদম? ২২-২৩ দিন পরও রয়ে গেছে অগাধ ক্লান্তি। সারা মুখে ঘা। গ্যাস্ট্রাইটিস। স্বাভাবিক অবস্থায় যা খেতাম, তার চার ভাগের এক ভাগও খেতে পারি না। এখনও হঠাৎ হঠাৎ ভিতর থেকে শিউরে ওঠার মতো করে শীতভাব উঠে আসে। উঠে ফ্যান বন্ধ করি। মন দিয়ে কোনও একটা বই পড়তে পারি না। মাথায় কিছু ঢোকে না। নিজেরই অবাক লাগে, হল কী আমার! কীসের এত ক্লান্তি!
আতঙ্ক নয়, সাবধানে থাকতে হবে। ফাইল ছবি।
মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার কি তাহলে কোভিড-ই হয়েছিল? আবার ভাবি, ডাক্তার বাবু না বললে কী করব? উনি তো বললেন, প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া, যেভাবে নিজেকে ও মেয়েকে প্রায় এক মাসের বেশি আইসোলেট করেছি, সেটাই এখন যে কোনও জ্বরেই জরুরি বললেন চিকিৎসক। প্রবল জ্বর মানেই যে করোনা এমনটা কিন্তু নয়। চিকিৎসকের পরামর্শে এক মাস বাড়ির ভিতরেই ছিলাম।
আসলে সমস্যাটা এইখানে। কোভিড রোগ হিসেবে খুব জটিল না হলেও, এ ঠিক কুষ্ঠের মতো। যতই চিকিৎসায় রোগ সেরে যাক-না কেন, মানুষের কাছে সে ব্রাত্য হয়েই থাকবে। সেদিন স্থানীয় একটি ছেলে ফোন করে বলল, "দিদি, ছেলের না বড্ড জ্বর আর কাশি।" জিজ্ঞেস করলাম, "ডাক্তার দেখিয়েছ?" "না, ওই ক্যালপল আর কাফ সিরাপ খাওয়াচ্ছি। ছেলে তো কোথাও যায় না দিদি, ওর আর ওই সব রোগ কোথা থেকে আসবে!"
ওই ছেলেটি ও তাঁর স্ত্রী দু-জনেই চাকরি করে। বাড়িতে ৮-১০ জন সদস্য। কাজের লোক আসে। এই পরিস্থিতিতে ছেলে বেরল কি না বেরল, তাতে কী! ছেলের যদি সত্যি কোভিড হয়ে থাকে, বাড়ির ১০ জন লোক তো ১০ দিক দিয়ে রোগ ছড়াবে!
চারদিকে এই এক পরিস্থিতি। 'আইসোলেশন', 'কোয়রান্টিন' শব্দগুলি কেমন যেন অর্থহীন লাগে শুনতে। বুঝতে পারি, নেহাত বাধ্য না হলে আর কেউ সাধ করে এই পরীক্ষা করাবে না। তাই আমাদের বিপদও চট করে ঘুচবে না। তবুও আশায় থাকি, সব ঠিক হবে তাড়াতাড়ি।
আরও পড়ুন: বর্ষার মরসুমে চিন্তা বাড়াচ্ছে শিশুদের ডায়ারিয়া
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy