লকডাউন উঠলেও মাস্কে ভরসা রেখে চলুক জীবন। ছবি: শাটারস্টক।
আমেরিকার ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে, করোনার টিকা হাতে পাওয়ার পরেও কম করে বছরখানেক মাস্ক পরতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও সায় আছে তাতে। সে আপনি বাজারে যান কি অফিস, ক্লাবে যান কি পার্টিতে। যেখানে যেখানে দু’টি মানুষের মধ্যে কম করে ৬ ফুটের দূরত্ব নেই, সেখানেই পরতে হবে। ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না অনেকেরই। মনে হচ্ছে নতুন উপদ্রব। আসলে তা নয়। এই মাস্ক আপনাকে বাঁচাবে করোনা ছাড়া আরও অনেক বিপদের হাত থেকে। এবং ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে, তা হয়ে উঠবে আপনার নতুন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
ফ্যাশন স্টেটমেন্ট! পুরো মুখই তো ঢেকে গেল, তা হলে আর কিসের ফ্যাশন!
ঠিক এমন বাজই পড়েছিল মরক্কো, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি, মেরিল্যান্ড ও আরও বেশ কিছু জায়গার অগুনতি মানুষের মাথায়, যখন মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ঘোষিত হয়। কিন্তু উপায় নেই, পরে না বেরলে বিপুল অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে। টেক্সাসের কিছু অংশে যেমন তার মাত্রা এক হাজার ডলার পর্যন্ত। ফলে বেজার মুখে যখন তাঁরা ঘরেই বানাতে বসলেন ডাবল লেয়ার বা থ্রি লেয়ার কাপড়ের মাস্ক, কারণ এন-৯৫ মাস্ক সাধারণ মানুষের পরা বারণ, ঠিক তখনই ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনে খবর বেরল, শিরোনাম ‘মাস্ক টু শপ নাও’।
আরও পড়ুন: ৩০তম দিন: আজকের যোগাভ্যাস
কী তার প্রতিপাদ্য? না, এখানে বড় বড় কোম্পানিরা তাদের তৈরি ফ্যাশনেবল মাস্কের খবর ছাপবেন, যাঁর দরকার তিনি অর্ডার করলে ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন পছন্দসই জিনিস। কী নেই সেখানে? পোশাকের সঙ্গে মানানসই টাই-ডাই মাস্ক চান? পেয়ে যাবেন। সিল্কের চান, ডেনিমের চান, পলিয়েস্টারের চান? সব পাবেন। বাথিং স্যুটের সঙ্গে মানানসই মাস্কও আছে। আছে ‘রেডি ফর পার্টি’ মাস্ক, ‘রেডি টু ওয়ার্ক’ মাস্ক। বাচ্চাদের জন্য নিতে পারেন ব্যাটম্যান মাস্ক কি জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ। টিনএজ সুন্দরীর জন্য আছে ফুলেল মাস্ক। আর আপনি যদি পপ কালচারের মানুষ হন, তা হলে তো নিশ্চয়ই জানেন জাপান ও কোরিয়ার পপ কালচার কী ভাবে মাস্কে অধ্যুষিত! আপনার জীবনেও তা হলে তার অনুপ্রবেশ ঘটুক না, ক্ষতি কী!
মাস্ক বানিয়ে পরার চল শুরু হয়েছে গোটা বিশ্বে।
অর্থাৎ, ফ্যাশন অ্যাক্সেসরিজের তালিকায় সানগ্লাস, ব্যাগ, স্কার্ফ, জুতো, বেল্টের পাশাপাশি চলে এল রকমারি মাস্কও, যা তৈরি করবে আপনার নিজস্বতা। ব্যক্তিত্বে যোগ হবে নতুন মাত্রা। তার পাশাপাশি থাকবে সুস্বাস্থ্যের প্রতিশ্রুতিও।
মাস্ক মানে সুস্বাস্থ্য
এখন নাহয় করোনার কারণে আমরা মাস্ককে চিনেছি, তার ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরনো। ১৮৯৭ সালে ফরাসি শল্য চিকিৎসক পল বার্গার প্রথম তার ব্যবহার শুরু করেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, সাধারণ কথাবার্তা বলার সময়েও ড্রপলেটের মাধ্যমে মুখ থেকে যে সমস্ত জীবাণু বেরোয়, অপারেশনের ঘা বিষিয়ে দিতে সে একাই একশো। প্রথম দিকে সার্জিক্যাল গজ নাকে-মুখে জড়িয়ে কাজ শুরু হয়। পরের বছর বিজ্ঞানী হুবনার জানান, যত পুরু করে গজ জড়ানো হবে তত ভাল। এবং এক বার ব্যবহার করার পরই তা ফেলে দিতে হবে। ১৮৯৯ সালে যক্ষা প্রতিরোধ মাস্ক ব্যবহারের প্রসঙ্গ উঠে আসে। ১৯০৫ সালে হ্যামিল্টন সাহেব বিজ্ঞান নিবন্ধ প্রকাশ করে জানালেন, স্ট্রেপ্টোকক্কাস জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে অদৃশ্য থুতু তথা ড্রপলেটের মাধ্যমে। বললেন স্কারলেট ফিভারও ছড়ায় ড্রপলেট দিয়ে। কাজেই নার্সদের মাস্ক পরতে হবে। ১৯১৮ সালে ডা ওয়েভার জানালেন ডিপথেরিয়া ঠেকাতে মাস্কের বিকল্প নেই। সেই মাস্ক ভিজে গেলে পাল্টাতে হবে। এবং হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে হাত দেওয়া যাবে না।
এর পর এসে গেল ঐতিহাসিক স্প্যানিশ ফ্লুয়ের বছর। মাস্ক হয়ে গেল সর্বজনীন। কারণ তত দিনে ফ্লু ঠেকাতে তার দক্ষতার কথা জেনে গেছেন সবাই। ২০১৩ সালে গবেষকরা প্রমাণ করলেন ফ্লুয়ের রোগী এবং তাঁর ধারে কাছে যাঁরা থাকেন তাঁরা সবাই যদি মাস্ক পরেন, রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা ৬০-৮০ শতাংশ কমে যাবে। জানা গেল, জ্বর-হাঁচি-কাশি হলে বা স্রেফ হাঁচি-সর্দি হলেও রোগীর চারপাশে এমনিই ভাইরাসের বাতাবরণ থাকে, তা তিনি কাশুন বা না-ই কাশুন।
আরও পড়ুন: শুধু মাস্ক, স্যনিটাইজার বা হাত ধোওয়া নয়, করোনা ঠেকাতে মেনে চলুন এ সবও
সংগ্রহে রাখতে পারেন ত্রিস্তর বিশিষ্ট সার্জিকাল মাস্ক।
অর্থাৎ, হাঁচি-কাশি বা কথা বলার মাধ্যমে যত রোগ ছড়ায়, তা সে টিবি হোক কি সাধারণ হাঁচি-সর্দি, করোনা হোক কি সাধারণ ফ্লু, সবার উত্তর লেখা আছে মাস্কের মধ্যেই। মাস্ক ঠেকায় পরিবেশ দূষণের ক্ষতি। এখন না হয় লকডাউন চলছে বলে বাতাস কিছুটা পরিষ্কার। বাইরে বেরনো বন্ধ বলে পোলেন অ্যালার্জির আশঙ্কা কম। কম ডাস্ট অ্যালার্জির আশঙ্কা। ঘরের মধ্যে জীবাণুর রমরমাও নেই তেমন। তবে এ দিন তো আর থাকবে না। ভিড় বাসে-ট্রেনে যাতায়াত শুরু হয়ে যাবে। বাতাসে ফের এসে মিশবে গাড়ি, উনুন-কলকারখানার ধোঁয়া। এর হাত থেকেও কেউ যদি বাঁচাতে পারে, সে হল মাস্ক। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন থেকে জানানো হয়েছে, ঘরে বানানো থ্রি লেয়ার মাস্ক পরে পথেঘাটে বেরলে এ সব বিপদের আশঙ্কা চলে যাবে তলানিতে। তাতে সায় দিয়েছেন চিকিৎসকরাও। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ দেবাশিস মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “মাস্ক পরার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে পোলেন অ্যালার্জির প্রকোপ অনেক কমে যাবে। কমবে ডাস্ট অ্যালার্জি। এমনকি, ফুসফুসের বেশ কিছু রোগ, গলার কিছু সমস্যা কম হবে। বা থাকলেও কমবে তার প্রকোপ।’’ দেবাশিসবাবুর মতে, এর ফলে কমবে কিছু ক্যান্সারের আশঙ্কাও। শীতের সকালে যে ধোঁয়াশার ভয়ে পার্কে হাঁটতে যেতে ভয় পেতেন, সে ভয় আর পেতে হবে না। ভয় পেতে হবে না ধূমপায়ীকেও। কারণ দেখা গিয়েছে, থ্রি লেয়ার মাস্ক পরা থাকলে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিও কম হয়।
অতএব, মাস্ককে ভয় নয়। বরং তাকে আপন করে নিন। আপনার তো উপকার হবেই, ভাতের জোগাড় হবে সেই সব মানুষেরও, মন্দার বাজারে যাঁরা জামাকাপড়ের ব্যবসায় ব্যাপক লোকসান করে মাস্ক বানানোকেই তাঁদের জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy