ইভেরমেক্টিন নিয়ে এখনও বিশদে গবেষণা এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগ প্রয়োজন। ফাইল ছবি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে উল্লেখ করলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এখনও যথেষ্ট সংশয় আছে। কোভিড-১৯-এর মোকাবিলায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) ওষুধটি কতটা কার্যকর সে এখনও সমীক্ষা চলছে। সম্প্রতি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের বিকল্প হিসেবে উঠে আসছে ইভেরমেক্টিন নামে অন্য একটি ওষুধের নাম। করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে এই ওষুধ। অনেক ক্ষেত্রেই ফল মিলছে ভালই।
এর আগে রেমডেসিভির নিয়ে আশার আলো দেখেছিলেন সারা বিশ্বের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের উপর কার্যত কোনও কাজই করছে না রেমডেসিভির—সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র পরীক্ষামূলক প্রয়োগে। বিশ্বের ৩০টি দেশের প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি মানুষের উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে সব ক্ষেত্রে কাজ দিচ্ছে না, এমনও নয়। রেমডেসিভিরের সঙ্গেই ইভেরমেক্টিনও প্রয়োগ করা হয়েছে এ রাজ্যের রোগীদের উপরে। মেলবোর্নের চিকিৎসকরাও এই ওষুধ প্রয়োগের কথা জানিয়েছেন। নতুন এই ওষুধ কি করোনা নিরাময়ে দিশা দেখাতে সক্ষম? এটি কি বিপদের দিনে তুরুপের তাস হতে পারে? এ রাজ্যের চিকিৎসকরা কী বলছেন?
বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, “ইভেরমেক্টিন এপ্রিল থেকেই প্রয়োগ করছি এটা যেমন ঠিক। তবে এই ওষুধটা যে কার্যকর হবেই, এমন প্রমাণ নেই, সেটাও ঠিক। একটা নতুন অসুখ। চিকিৎসকদের কাছে সে অর্থে কিছুই নেই। কিছু গবেষণাগারের পরীক্ষার ফল ছিল। ইন-ভিট্রো অর্থাৎ গবেষণাগারের স্টাডির উপর ভিত্তি করে এই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন:বিপদসঙ্কেত! ‘কেরলের শিক্ষা না নিলে পুজোর পর করোনা-সুনামি’
ডোজ কতটা?
যোগীরাজ জানান, চিকিৎসকরা এই মুহূর্তে অল্প পরিমাণেই ব্যবহার করছেন। এটা কতটা কার্যকর, তা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু স্টাডি এসেছে সম্প্রতি। কিন্তু আরও গবেষণা দরকার। অক্সিজেন থেরাপি, (সব যন্ত্র-সহ সব বিধি মেনে), অ্যান্টি-কোয়াগুলেশন ( রক্ত জমাট আটকাতে হেপারিন অ্যানালগ বা লো মলিকিউলার হেপারিন প্রয়োগ) এবং স্টেরয়েড এই হচ্ছে চিকিৎসা পদ্ধতি। এ ছাড়াও জেনারেল মেডিক্যাল কেয়ার। মানে জ্বর হলে প্যারাসিটামল এটুকুই। কিন্তু বাদবাকি অর্থাৎ প্লাজমা থেরাপি খানিকটা কাজ করছে, রেমডেসিভির খানিকটা কাজ করছে। ইভেরমেক্টিন কিছু ক্ষেত্রে কাজ করছে এটাই বলা যেতে পারে। এ নিয়ে বিশদে গবেষণা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন:পুজো-রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি নিয়ে হাইকোর্টে উদ্যোক্তারা, শুনানি কাল
ভাইরাস নতুন, রোগটাও। পর্যাপ্ত পরিমাণে টেস্টের প্রয়োজন আরও বেশি। ছবি: পিটিআই
এই ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের বিকল্প?
জনস্বাস্থ্য চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর কথায়, “এগুলি সবই এম্পিরিকাল ড্রাগ। যেহেতু ভাইরাস নতুন, রোগটাও। তাই প্রমাণভিত্তিক ওষুধ বলে কিছু নেই সারা পৃথিবীর কাছে। প্যারাসিটামলও প্রমাণভিত্তিক ওষুধ, তাই জ্বরে এটা ব্যবহার করা হয়। সারা বিশ্বে র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (সলিডারিটি ড্রায়াল) যেটা চলেছে অর্থাৎ কোন ওষুধ কাজ করছে, হাসপাতালের রোগীদের নমুনাও নেওয়া হয়েছে, স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছেন যাঁরা। সেখানে কিন্তু এ দেশের ১০ শতাংশ রোগীও অংশ নিয়েছেন। ওই পরীক্ষামূলক প্রয়োগে প্রথম ধাপে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, রেমডেসিভির এগুলি ছিল। আইসিএমআর গত শনিবার দিনই বলেছে, সে অর্থে কাজ করছে না রেমডেসিভির। এ দিকে ইভেরমেক্টিন এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রায়ালে কাজের কিংবা অকাজের বলে প্রমাণিত হয়নি। তবে কিছু কিছু অ্যান্টিভাইরাল দিক রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই কাজ দিচ্ছে। রোগীকে তাই প্রয়োগ করেছি। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনও কিছু ক্ষেত্রে কাজ দিয়েছে।‘’
আরও পড়ুন:দ্রুত মেদ ঝরাতে চান? বিপাকক্রিয়ার হার বাড়াতে কী কী করবেন
এটা তো পরজীবীরোধক বা অ্যান্টিপ্যারাসিটিক্যাল ড্রাগ, তাহলে করোনায় কেন?
মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কৃমির ওষুধ এটি। প্রয়োগ করা হয় উকুন আটকাতেও অর্থাৎ অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস রোধে ভাল কাজ করেছে ইভেরমেক্টিন।’’
কীভাবে কাজ করে এই ওষুধ?
অরিন্দম জানান, কোষের দুটি অংশ। নিউক্লিয়াস, সাইটোপ্লাজম। নিউক্লিয়াসে ডিএনএ থাকে। এই ডিএনএ-তেই তথ্য লুকিয়ে থাকে। ভাইরাস হানা দিলে, তা রুখতে শরীর প্রদাহ তৈরি করতে যে তথ্য জরুরি। করোনা শরীরে হানা দিয়েই প্রথমেই বংশবৃদ্ধি করে সাইটোপ্লাজমে। ডিএনএ-তেও ভাইরাস ঢোকে যাতে কোনও তথ্য না পৌঁছায়। ফলে প্রদাহ তৈরি না হয়ে ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারবে। এ বার ভাইরাস ঢুকতে বাহকের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে করোনায় বিশেষ (আইএমপি) বাহক প্রয়োজন। আইএমপি আলফা এবং আইএমপি বিটা। এ দুটি ভাইরাসকে নিউক্লিয়াসে প্রবেশে সাহায্য করে, যেখানে ডিএনএ রয়েছে। ইভেরমেক্টিনের কাজ হল বাহকদুটিকে ব্লক করে দেওয়া। ফলে ভাইরাস নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করতে পারছে না। প্রদাহ তৈরি হয়ে ভাইরাসকে ধ্বংস করছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইন-ভিট্রো পদ্ধতিতে অর্থাৎ গবেষণাগারে ইভেরমেক্টিনের প্রয়োগে এ ভাবেই ধ্বংস হয়েছে ভাইরাস। তবে মানুষের উপর প্রয়োগ হয়নি।
অক্সিজেন থেরাপিতে জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফাইল ছবি।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সপ্তাহে সপ্তাহে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি আটকাতে প্রয়োগ করা হয়েছিল। ইভেরমেক্টিনকেও সেভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি রুখতে সে সক্ষম, এই স্টাডির উপর ভিত্তি করেই ওষুধুটি দেওয়া হচ্ছে। তবে এই নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। এগুলি সম্পূর্ণভাবেই ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর অনুমোদনেই প্রয়োগ করা হচ্ছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ভাল ফল মিলেছে।
আরও পড়ুন:হার্ট ভাল রাখার অব্যর্থ দাওয়াই, কেন রোজ খেতেই হবে ‘নিরামিষ মাংস’
যদিও সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি শুধুমাত্র জেনারেল কেয়ার, অক্সিজেন থেরাপি ও প্যারাসিটামলেই ভরসা রাখছেন। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা ইভেরমেক্টিন এখনই প্রয়োগের পক্ষপাতী নন। অমিতাভ বলেন, “এই জাতীয় ওষুধ প্রয়োগের আগে বিশদে গবেষণা প্রয়োজন। আমি এই ওষুধ এখনও প্রয়োগ করছি না।”
আরও পড়ুন:ঘন ঘন কফি পান ভাল না খারাপ?
চিকিৎসকরা এই বিষয়ে সহমত, ইভেরমেক্টিন নিয়ে এখনও বিশদে গবেষণা এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগ প্রয়োজন। ভাইরাস গুরুতর অসুস্থ রোগীদের উপর প্রয়োগ করে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ এখন মেলেনি। কিছু ক্ষেত্রে কাজ দিয়েছে। কোনও ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে গেলে সুদীর্ঘ ট্রায়াল দিতে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর। এখনও সেই পরিসংখ্যান চিকিৎসকদের হাতে নেই। তবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফলাফলের প্রাথমিক বিশ্লেষণে ইভেরমেক্টিন আশা জাগাচ্ছে। এ নিয়ে গঠনমূলক বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা প্রয়োজন।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy