সারা দেশে এখনও চোখ রাঙাচ্ছে কোভিড। ছবি: পিটিআই।
প্রায় তিন মাস সারা দেশ গৃহবন্দি থাকা সত্ত্বেও কোভিডকে আয়ত্তে আনা যায়নি। প্রতি দিনের হিসেবে নতুন করে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বাড়ছে। পৃথিবীতে আর কোনও দেশে এমনটা হয়নি।
আক্রান্তের নিরিখে বিশ্বে এখন চার নম্বর ভারত। অঙ্ক বলছে, এই হারে সংক্রমিত হতে থাকলে হয়তো তালিকার এক বা দুই নম্বরে উঠে ভারত শেষ করবে তার সংক্রমণের দৌড়। ভারতের জনসংখ্যা কিন্তু পৃথিবীতে কেবল চিনের পরেই। তাই সে দিক থেকে এই এক বা দু’নম্বরে উঠে আসা বেশ শঙ্কার। যদিও এ সব ক্ষেত্রে সুরক্ষাবিধি মেনে চলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, চিকিৎসা পরিষেবা এ সব নানা ফ্যাক্টর সংক্রমণ ঠেকানোর হাতিয়ার। তাই শুকনো কিছু সংখ্যার উপর ভিত্তি করে তৈরি কোনও আঙ্কিক মডেল ও তথ্যনির্ভর ডেটা সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট অঙ্কের হিসেব মিলিয়ে দিতে পারে না ঠিকই, তবে অঙ্ক এমন এক বিষয় যা সদা তথ্যনির্ভর সত্য বলে। তাই একটা আন্দাজ সে দিতেই পারে।
আমাদের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবিদদের প্রস্তাবিত এসআইআর মডেল বলছে, ১৫ জুলাই ভারতে করোনা আক্রান্ত সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় আট লক্ষের কাছাকাছি। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় চল্লিশ হাজার। সংক্রমণের একটি মাপকাঠি হল রিপ্রোডাকশন নম্বর, অর্থাৎ এক জন কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি গড়ে আরও কত জনকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় সেই সংখ্যা। লকডাউনের ফলে ভারতে এই রিপ্রোডাকশন সংখ্যা (R) কমে এসেছে ৩.৫ থেকে ১.২-এ। কিন্তু তবুও কোভিড সংক্রমণের সংখ্যা ধীর গতিতে হলেও ক্রমেই বাড়ছে। গতি কমলেও ভাইরাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে এখনও।
আরও পড়ুন: কোভিডে সুস্থ হওয়ার হার কেন বাড়ছে দেশে? ভাইরাসের ভয় এখনও কতটা?
পৃথিবীর তালিকায় প্রথম দিকে থাকা অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। কিন্তু সেটাও দ্রুত বদলে যেতে পারে যদি একসঙ্গে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে স্থানাভাব ঘটে। এমনিতেই লকডাউন শিথিল করলে আবার সংক্রমণ দেখা দেবে, এটা জানা কথাই ছিল, কিন্তু সেই সংখ্যাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে মৃত্যুহার কম থাকবে।
পশ্চিমবঙ্গে আবার ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় মৃত্যুহার উপরের দিকে। যদিও সব রাজ্যেই পরীক্ষা বা টেস্টের সংখ্যা বেশ কম, তাই সব রাজ্য এই টেস্ট বাড়লে হিসেবের ঘরেও বদল আসতে পারে। তবে এত কিছুর মধ্যেও আশার কথা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা গিয়েছে আনুমানিক ৮০ শতাংশেরই কিন্তু করোনা টেস্ট পজিটিভ এলেও হাসপাতালে যাওয়ার দরকার পড়ছে না। ইদানীং সুস্থ হওয়ার সংখ্যাও অনেকটা বেড়েছে। ভারতে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে সেই অঙ্ক। গবেষকদের মতে, যদি সকলকেই উপসর্গবিহীন রোগী ধরে নিয়ে সকলেরই করোনা কেস টেস্ট করানো যেত, তা হলে মৃত্যুহার দাঁড়াত ০.৫-১ শতাংশে।
আমরা সকলেই জানি ভাইরাসটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই নিয়ম না মানলে এই মৃত্যু হার ও আক্রান্তের সংখ্যাটা বড় হয়ে যেতে খুব একটা সময় নেবে না। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে। এ দিকে আমাদের এখন উদ্দেশ্য মৃত্যুসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই বয়স্ক মানুষ তো বটেই, এ ছাড়া যাঁদের ডায়াবিটিস, রক্তচাপ, কিডনির অসুখ, শ্বাসকষ্ট বা হার্টের অসুখ আছে তাঁদেরও অতিরিক্ত সাবধানতায় রাখতে হবে। যাঁরা রোজ কর্মসূত্রে অনেক মানুষের সান্নিধ্যে আসেন, তাঁদের ঘন ঘন টেস্ট করা দরকার।
আরও পড়ুন: করোনা পরিস্থিতিতে বাইরে খাওয়া কতটা নিরাপদ?
মোট কথা, আগামী বেশ কয়েক মাস আমাদের সকলকে সম্মিলিত ভাবে কষ্ট করতে হবে। সংগঠিত সংযম, ধৈর্য ও ত্যাগের প্রয়োজন। আমাদের জীবনযাপনে আপাতত অনেক বদল এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিকতা ও ছন্দ ফিরে পাওয়ারও উপায় নেই। লকডাউন করলেই যে ভাইরাস নির্মূল হয়ে যাবে এ আশাও যে ঠিক নয়, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। তবু ভীত হলে চলবে না। আমরা এর আগেও অনেক সমস্যা ও অসুখ নিয়ে বেঁচেছি। তাই কোভিডের ভয়ে অন্য অসুখের যত্ন না নিলে, দেশের অর্থনীতির ভরাডুবি হলে আমাদের সব মিলিয়ে অনেক বড় ক্ষতির শঙ্কা থেকে যাবে। যত দিন না কোভিডের প্রতিষেধক টিকা বা নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে, আমাদের জীবনে একটা লাগাম থাকবেই। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, প্রয়োজন ছাড়া না বেরনো, বড় অনুষ্ঠান ও জনসমাগম যথাসম্ভব বর্জন করা, এগুলো জীবনের অঙ্গ হয়ে থেকে যাবে আরও কয়েক মাস। এ আমাদের একেবারে অচেনা জীবন, বাঙালির তো বটেই! রোগ নিয়ন্ত্রণে দুই সরকারকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। টেস্টের সংখ্যার পাশাপাশি হাসপাতালের বেডের সংখ্যা, পরিষেবা প্রদানকারী শ্রমিক সংখ্যাও বাড়াতে হবে। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তাও সরকারকেই দিতে হবে। আমাদেরও সেই সব মানুষদের দিকে শ্রদ্ধা ও নিরাপত্তার হাত বাড়াতে হবে। কঠিন হলেও এ ভাবে বাঁচা অবাস্তব নয়।
ভেবে দেখুন, ধারাভির মতো ঘনবসতিতেও মানুষ এবং সরকারি পরিকাঠামো একযোগে কাজ করে ঘুরিয়ে দিয়েছে ভাইরাস কার্ভ। বিয়েবাড়ি, খেলার উদ্যান, স্কুলবাড়িতে গড়ে উঠেছে আক্রান্তদের রাখার সাময়িক ব্যবস্থা। স্ক্রিনিং মেশিন, অক্সিজেন মাপার যন্ত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিলি হয়েছে ফেস মাস্ক। প্রতিষেধক সামগ্রীও দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। সুতরাং উপায় যে নেই তা নয়। দেশ ও রাজ্যভিত্তিক প্রতি দিনের হিসেব ও খুঁটিনাটি দেখতে চোখ রাখতে পারেন আমাদের ওয়েবসাইট covind19.org.-তে।
তবে অঙ্কের মডেল যাই বলুক, মডেলকে হারাতে পারে একমাত্র মানুষের চেষ্টা সদিচ্ছা। তাই হাল ছাড়তে পারি না আমরা। বালির ঝড়ের মধ্যে মাথা নীচু করে বসে থাকব ঝড় কাটার প্রতীক্ষায়।
উই উইল বেন্ড দ্য কার্ভ।
(লেখক ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান-এর বায়োস্ট্যাটিস্টিক্সের বিভাগীয় প্রধান।)
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy