Advertisement
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Covid 19

ফুসফুস, কিডনি, হার্ট... কোভিডে আক্রান্ত হলে সব ক্ষেত্রেই হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি

প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ মৃদু-র উপর দিয়েই যায়৷ ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷

কোভিডে আক্রান্ত হলে হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি।

কোভিডে আক্রান্ত হলে হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি।

সুজাতা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২০ ১৭:২১
Share: Save:

হালকা রোগে ভুগে যাঁরা সেরে গেলেন বা যাঁদের সংক্রমণ হলেও উপসর্গ তেমন হল না, তাঁদের কোনও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয় না৷ মাঝারি রোগীদের কিছুটা হয়৷ বেশি হয় যাঁরা মৃত্যুর দরজা থেকে বেঁচে ফেরেন, তাঁদের৷ অবশ্য কোভিড ছাড়া অন্য কোনও কারণেও যদি কেউ অতখানি অসুস্থ হন, জীবন-মৃত্যুর সীমানায় চলে যান, তাঁদেরও সেই ক্ষত অনেকদিন বা কখনও জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়৷ কাজেই কোভিড বলে আলাদা করে ভয় পাওয়ার কিছু নেই৷ আর সবচেয়ে বড় কথা, প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ মৃদু-র উপর দিয়েই যায়৷ ১০-১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ তার মধ্যে সামান্য কয়েকজনেরই কেবল আইসিইউ-এর চিকিৎসা লাগে৷ কাজেই খুব কম মানুষকেই দীর্ঘমেয়াদী রোগভোগের কবলে পড়তে হয়৷

ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কোভিড চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যে সমস্ত কোভিড রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, তার মধ্যে মোটামুটি ৪৫ শতাংশ মানুষের বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরও কিছু চিকিৎসা লাগে৷ ৪ শতাংশ মানুষকে কিছুদিন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে রেখে চিকিৎসা করলে ভাল হয়৷ আর মাত্র এক শতাংশ মানুষকে কোভিডের জের বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর৷

প্রশ্ন জাগতে পারে, এত কথা বিজ্ঞানীরা জানলেন কী করে? রোগের বয়স তো মোটে ছ’মাস! এর উত্তর দিয়েছেন ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জোসেফ ব্রেনান৷ তাঁর কথায়, “আরও ছ’মাস না গেলে কোভিডের ক্ষতি সম্বন্ধে একেবারে সঠিক ভাবে বলা যাবে না ঠিকই।তবে করোনাভাইরাসের যে দুই সহোদরের পরিচয় আমরা পেয়েছি, সেই সার্স ও মার্স মহামারির দৌলতে অনেককিছুই বলা সম্ভব৷ এবং সে সব পূর্বাভাসের অনেকগুলিই মিলে যাচ্ছে৷”

আরও পড়ুন: আমরা চাই, আরও দোকানপাট খুলুক, গ্রামীণ অর্থনীতি চালুর বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

ফুসফুসে থাকছে ক্ষতের দাগ

ব্রেনান জানিয়েছেন, কিছু রোগী আছেন, সেরে ওঠার দেড়-দু’মাস পরও যাঁদের শুকনো কাশি থেকে গিয়েছে৷ রয়ে গিয়েছে বুকে জ্বালাধরাভাব, গভীরভাবে শ্বাস টানা, ও ছাড়তে না পারার সমস্যা৷ এর প্রধান কারণ সংক্রমণ ও প্রদাহের ফলে ফুসফুসের কিছু অংশের স্থায়ী ক্ষতি। যত নিউমোনিয়ার বাড়াবাড়ি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে ততই। সিটি স্ক্যানে ধরা পড়েছে ধূসর প্যাচ, যাকে বলে গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটি৷ চিনে হওয়া এক সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, জটিল রোগীদের মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশের সিটি স্ক্যানে এই চিহ্ন রয়েছে৷ রেডিওলজি জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, চিনের হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৭০ জন গুরুতর রোগীর মধ্যে ৬৬ জনের ফুসফুসের ক্ষতি হয়েছে এবং তার অর্ধেকের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে ধূসর প্যাচ৷ এমনকি উপসর্গহীন কোভিড রোগীদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা গিয়েছে৷ এবং তার কিছুদিন পর জাঁকিয়ে বসেছে রোগ৷

এ ক্ষতি যে সহজে সারার নয়, তার প্রমাণ আছে অতীতে৷ নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা জানান, ২০০৩-২০১৮ পর্যন্ত ৭১ জন সার্স রোগীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে তাঁরা দেখেছেন, এর তিন ভাগের এক ভাগের মধ্যে ফুসফুসের ক্ষত চিহ্ন থেকে গিয়েছে এবং তার হাত ধরে পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমেছে তাদের৷ ৩৬ জন মার্স রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেও এই একই তথ্য পাওয়া গিয়েছে৷ তাও তো এই দুই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল একটি ফুসফুস৷ কোভিডে কিন্তু সংক্রমণ হচ্ছে দু’টি ফুসফুসেই৷

ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পাণ্ডা জানিয়েছেন, “কোভিডে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা আরও বেশি হবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না৷ এটুকু বলা যায় যে, জটিল নিউমোনিয়া বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোমে ভুগে উঠলে ফুসফুসের যে ক্ষতি হয়, তা সারতে কম করে ৬-১২ মাস সময় লাগবে৷ তারপরও পুরোপুরি ঠিক হবে কিনা বলা যায় না৷ এর উপর কারও যদি হাঁপানি, সিওপিডি বা ইন্টারস্টিসিয়াল লাং ডিজিজ ইত্যাদি থাকে, কার্যকারিতা ফিরে আসবে বড়জোর ৬০-৭০ শতাংশ৷”

রক্ষা নেই হার্টের

কোভিড ভালভাবে চেপে ধরলে হার্টের যে ক্ষতি হয়, তা আজ প্রমাণিত। টেক্সাস হেল্থ সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আইসিইউতে ভর্তি কোভিড রোগীদের মধ্যেপ্রায় ১৯ শতাংশের হার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হার্ট ফেলিওর, অ্যারিদমিয়া, হার্ট অ্যাটাক, সবই হতে পারে৷ আগে থেকে হার্টের রোগ থাকলে তো কথাই নেই। এই সমস্যার রেশ থেকে যায় সেরে ওঠার পরেও। ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি হওয়ার আশঙ্কাবাড়ে। বাড়ে কার্ডিওমায়োপ্যাথির আশঙ্কাও৷ অর্থাৎ হার্টের পেশী দুর্বল হয়ে শরীরে রক্ত সরবরাহের ঘাটতি হয়। ফলে আগের মতো দৌড়ঝাঁপের জীবন ফিরে আসে না অনেক সময়ই।

সৌতিক জানিয়েছেন, “ভাইরাসের প্রভাবে যাঁদের হার্টের পেশীতে সরাসরি প্রদাহ হয়, যাকে বলে ভাইরাল মায়োকার্ডাইটিস, তাঁদের সেই ক্ষতের দাগ থেকে যেতে পারে দীর্ঘদিন৷ পেশী দূর্বল হয়ে রক্ত সরবরাহেরব্যাঘাত হয়। নিয়মিত ওষুধপত্র খাওয়ার সঙ্গে ধূমপান ও মদ্যপান ছেড়ে দিলে ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে পরিশ্রমের কাজ না করলে ৬-৮ সপ্তাহে অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়৷”

কিডনি ও লিভার

“কোভিডের জটিল পর্যায়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কিডনি ও লিভার”—দাবি সৌতিকের৷ “তাঁদের স্বাভাবিক হতেও সময় লাগে বেশি, কম করে ৩-৪ সপ্তাহ। কখনও পুরো স্বাভাবিক হন না৷ বিশেষ করে যদি আগে থেকে কোনও সমস্যা থাকে৷ কারও হয়তো সামান্য কিডনির সমস্যা ছিল।তাঁর রোগ এক ধাক্কায় বেশ খানিকটা বেড়ে যেতে পারে৷ কারও হয়তো এমন পরিস্থিতি ছিল যে, বছর দু’য়েক বাদে ডায়ালিসিস করলেও চলত।কোভিডের ধাক্কায় সেই সময়টা এগিয়ে আসতে পারে৷”

রক্তের সমস্যা

পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ জটিল কোভিড রোগীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অতিসক্রিয়তার জন্য প্রচুর পরিমাণে রক্তের পিণ্ড জমতে থাকে৷ এ থেকে নানা রকম সমস্যা হয়৷ যেমন—

• ফুসফুসে রক্তের পিণ্ড জমে পালমোনারি এমবলিজম নামে প্রাণঘাতী সমস্যা হতে পারে। ফ্রান্সে হওয়া এক সমীক্ষায় বিজ্ঞানীরা জানান, আইসিইউ-তে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ২৩-৩০ শতাংশের এই সমস্যা হয়৷ এরপর কিছু রোগী সেরে উঠলেও ক্লান্তি, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকে৷ একটু বেশি চলাফেরা ও কাজকর্ম করতেও কষ্ট হয়৷

• কারও রক্তের পিণ্ড পৌঁছে যায় ব্রেনে৷ স্ট্রোক হয়। উহানের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সেখানে আইসিইউতে ভর্তি কোভিড রোগীদের মধ্যে ৫ শতাংশের স্ট্রোক হয়েছে। একই ব্যাপার ঘটেছিল সার্সের বেলাতেও৷ কমবয়সি রোগীদের মধ্যে মারা যাওয়ার হার কম থাকলেও, পুরোপুরি সামলে উঠে কাজে যোগ দিতে পেরেছিলেন ৪২-৫৩ শতাংশ মানুষ।

• কারও হার্ট অ্যাটাক হয়৷ ফলে হার্ট আগের চেয়ে কমজোর হয়ে যায়।

• কিডনিতে পৌঁছলে কিডনির ক্ষতি তো হয়ই, ডায়ালিসিস করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ সেরে ওঠার পর কিডনির কার্যকারিতা কমে যায়।

• পায়ের শিরায় জমে দেখা দিতে পারে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস নামের জটিল রোগ। বাড়ি যাওয়ার পর হঠাৎ রোগ দেখা দিতে পারে।

এ সব কারণেই ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ থ্রম্বোসিস অ্যান্ড হিমোস্ট্যাটিস-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরও বেশ কিছুদিন রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ খেয়ে যেতে হবে৷

আরও পড়ুন: আধাসামরিক বাহিনীর ক্যান্টিনে এ বার বিকোবে শুধু দেশীয় পণ্য, ঘোষণা অমিতের

শেষ কথা

কোভিড নতুন রোগ। তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই এখনও অজানা৷ কাজেই সে যে কী ক্ষতি করতে পারে আর কী পারে না, তার কথা ভেবে আতঙ্কিত না হয়ে সাবধান হয়ে চলাই শ্রেয়। সতর্ক হয়ে চললে যে রোগ ঠেকানো যাবে, তা কিন্তু পরীক্ষিত সত্য।

অন্য বিষয়গুলি:

COVID 19 coronavirus Lung kidney Heart
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

সরাসরি দেখুন বছরের বেস্ট সন্ধ্যা

বছরের বেস্ট ২০২৪

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy