বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে উপসর্গ অনেক কম। ছবি: শাটারস্টক।
করোনার ক্ষেত্রে বাচ্চারা কি কম আক্রান্ত হচ্ছে? ভাইরাস কি একই রকম ভাবে প্রভাব ফেলছে বাচ্চাদের জীবনেও? বাচ্চাদের থেকেও কি অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে?
আমাদের রাজ্যেই বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ন'দিনের নবজাতক করোনা আক্রান্ত হয়ে ফিরে এসেছে মৃত্যুর মুখ থেকে। একটি ক্ষেত্রে মা করোনা আক্রান্ত হলেও সন্তান কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়ে জন্মায়নি। একরত্তি শিশু, এক জন দুই, একজন আড়াই। মেদিনীপুরের দুই খুদে জয় করেছে করোনাকে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকে আক্রান্ত হলেও বাড়ির সাত-আট বছরের বাচ্চাটির রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এটা কি শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে হচ্ছে? শিশুদের ক্ষেত্রে করোনার আচরণ খানিকটা হলেও আলাদা?
আমেরিকার ইলিনয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের শ্বাসনালীর উপরের অংশে প্রচুর পরিমাণে কোভিড-১৯ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।
আরও পড়ুন: মানসিক চাপে কমছে রোগপ্রতিরোধ শক্তি, কী করবেন, কী করবেন না
আমেরিকার 'জেএএমএ পেডিয়াট্রিক্স জার্নাল'-এ প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাচ্চাদের থেকে সংক্রমণের বিষয়টি জানতে পারলে জনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকা তৈরিতে সুবিধা হবে, তাই মহামারির ক্ষেত্রে এই তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে সহমত পোষণ করলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ পল্লব চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন, সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি কেসে দেখা গিয়েছে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভাইরাল লোড (রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ) বেশি হচ্ছে। তাদের থেকেও সংক্রমণ হচ্ছে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে করোনা কম হচ্ছে, এ জাতীয় তত্ত্ব থাকলেও তা এখনও প্রতিষ্ঠিত নয়। ছবি : শাটারস্টক
২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত সোয়াবের তথ্য নিয়ে ইলিনয়ের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যান অ্যান্ড রবার্ট লুরে চিলড্রেনস হাসপাতালের তরফে যে স্টাডি হয়েছিল, তাতে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে সঙ্গে শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্কের করোনা সংক্রমণের নানা দিক ধরা পড়েছে। আপৎকালীন বিভাগের রোগীরাও এতে বাদ পড়েননি। বাদ পড়েননি হাসপাতালে ভর্তি নন অথচ আক্রান্ত, এমন ব্যক্তিও। এতে পাঁচ পর্যন্ত শিশু, পাঁচ থেকে ১৭ পর্যন্ত বয়সিরা এবং ১৭ থেকে ৬৫ বছর বয়সিদের সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: শরীর অচল থেকে পক্ষাঘাত, করোনার দোসর কি এ বার গুলেনবারি সিনড্রোম? কী বলছেন চিকিৎসকেরা
ওই পরীক্ষায় জানা যায়, ১০ থেকে ১০০ গুণ ভাইরাল লোড ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই। তুলনামূলক ভাবে বড় যারা, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে ভাইরাল লোড ছিল পূর্ণবয়স্কদের সমান। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে ভাইরাল নিউক্লিক অ্যাসিডের পরিমাণ (প্রোটিনের জেনেটিক কোড, যা ভাইরাস তৈরিতে সহায়ক) অনেক বেশি। তবে এই সমীক্ষার ক্ষেত্রে ভাইরাল নিউক্লিক অ্যাসিডের পরিমাণের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, সংক্রমণকারী ভাইরাসের ক্ষেত্রে নয়। এই প্রসঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ বলেন, এই তথ্য এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। কারণ, দেশ ও স্থান বিশেষে ভাইরাসের চরিত্র পালটে যায়। কিছু বিশেষ রিসেপটরের জন্যও এটা হতে পারে, এমনটাও ধরে নেওয়া হচ্ছে। মূলত পুরোটাই তত্ত্বের উপরে দাঁড়িয়ে। বাচ্চারা আক্রান্ত কেন কম হচ্ছে বা বাচ্চাদের থেকে কেন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, এ সংক্রান্ত অনেক গবেষণা প্রয়োজন। প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভাইরাল লোড বেশি। এমন অনেক কেসও আসছে। অনেকেই উপসর্গহীন বাহক হয়েই থেকে যাচ্ছে।
বাচ্চারা কি কম আক্রান্ত হচ্ছে?
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে করোনা কম হচ্ছে, এ জাতীয় কয়েকটি তত্ত্ব থাকলেও তা এখনও প্রতিষ্ঠিত নয় বলেই জানান অপূর্ববাবু। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা জিনের কিছু সংযোগ এক্ষেত্রে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর কথায়, এটা ‘ইনহেরেন্ট ইমিউনিটি’ বা বংশগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, যার ফলে করোনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার বা হলেও জটিলতা বাড়ার আশঙ্কা কম।
তাঁর কথায়, করোনা ভাইরাস রক্তে ডেলা তৈরি করে, জমাট বাঁধে রক্ত, স্বাভাবিক প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে, হয়তো এটা বড়দের ক্ষেত্রে একটু বেশি, সেই জন্য বাচ্চারা হয়তো কম আক্রান্ত হচ্ছে বা হলেও উপসর্গহীনভাবে থেকে যাচ্ছে, তবে সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়াতে সে সক্ষম। তবে এই নিয়ে আরও অনেক গবেষণা জরুরি বলেই মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: যত বেশি ওজন, তত বেশি ঝুঁকি বাড়ছে কোভিডে, কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
আক্রান্ত হলে কোন ধরনের উপসর্গ আছে বাচ্চাদের?
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে উপসর্গ অনেক কম। ভাইরাল লোডের ক্ষেত্রে সেই অর্থে কোনও তত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, এ কথা জানান ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের ডেপুটি ডিরেক্টর অরুণালোক ভট্টাচার্য। তাঁর কাছে বেশ কয়েক জন বাচ্চা করোনা এসেছে, যাদের করোনা ধরা পড়েছে। তাঁর কথায়, বড়দের উপসর্গের সঙ্গে বাচ্চাদের উপসর্গের একটা তফাত রয়েছে। বাচ্চাদের বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপসর্গ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বড়দের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট থাকলেও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ডায়ারিয়া, অল্প জ্বর-- এ জাতীয় উপসর্গ দেখা যাচ্ছে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে।এ ছাড়াও কাওয়াসাকি ডিজিজ-জাতীয় উপসর্গও দেখা গিয়েছে শিশুদের ক্ষেত্রেও অর্থাৎ যারা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়নি।
বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে সচেতন হচ্ছেন, এটা ইতিবাচক দিক। ছবি: শাটারস্টক
বাচ্চারাও সংক্রমণ ছড়ায়
উপসর্গবিহীন বা অল্প উপসর্গ থাকলে বাচ্চারাও ‘রিজারভয়ের’ হিসাবে কাজ করছে। তাদের থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে আর পাঁচজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মতোই।
পল্লববাবু বলেন, অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার করোনা হয়ে সেরে গিয়েছে। বোঝাই যায়নি কিছু হয়েছে। হয়তো সামান্য কাশি ছিল। তবে সেরে যাওয়ার পর গুলেনবারি সিনড্রোম (ভাইরাল সংক্রমণ থেকে স্নায়ুর অসুখ) বা কাওয়াসাকি ডিজিজ হচ্ছে।পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম ধরা পড়েছে মুম্বইয়ের বেশ কিছু শিশুর ক্ষেত্রে। এই উপসর্গ যুক্ত দুই শিশুর মৃত্যুও হয়েছে। এই রোগকে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে কাওয়াসাকি ডিজিজ। তাই চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা গায়ে র্যাশ বেরনোর বিষয়গুলিতে সতর্ক থাকতে বলেন তিনি।
আবার, কিছু ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গে র্যাশ নিয়ে আসছে কেউ কেউ, তখন দেখা গেল করোনার অ্যান্টিবডি পজিটিভ। তখন বোঝা যাচ্ছে যে করোনা হলেও ধরা পড়েনি। তাই সতর্ক থাকতেই হবে। মেনে চলতে হবে মাস্ক পরা, বার বার হাত ধোওয়া সংক্রান্ত পরিচ্ছন্নতার দিকগুলিও।
বাচ্চার গায়ে লাল রঙের র্যাশ ? সতর্ক থাকতে হবে করোনা আবহে। ছবি: শাটারস্টকে
ভাইরাল লোড কি বাচ্চাদের বেশি?
বাচ্চারা করোনার সঙ্গে যুঝতে পারছে বলেই উপসর্গ প্রায় থাকছে না বললেই চলে। তবে বাহক হিসাবে কাজ করছে। আক্রান্ত হলে বাচ্চাদের ভাইরাল লোড বেশি হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে, এমনই দাবি পল্লববাবুর। বাচ্চার কাছে এসে পরিবারেরই কেউ হাঁচলে বা কাশলে, অসতর্ক থাকলে বাচ্চার ওজন ও পৃষ্ঠতলের (সারফেস এরিয়ার) ভিত্তিতে বড়দের তুলনায় ভাইরাল লোড বেশি হচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন, জানান তিনি।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার কম?
পল্লববাবুর কথায়, সাধারণত বাচ্চাদের কো-মর্বিডিটি কম, রক্তচাপ বা ডায়াবিটিসের সমস্যাও নেই। বাচ্চারা বাড়ির বাইরে বেরচ্ছে না, স্কুলও বন্ধ। বাড়ির বড়রা তুলনামূলকভাবে সারা বিশ্বেই বাচ্চাদের নিয়ে এই মুহূর্তে যথেষ্ট সচেতন। শিশুদের ক্ষেত্রে যক্ষ্মার ভ্যাকসিন, এমএমআর ভ্যাকসিন বেশির ভাগেরই দেওয়া। এগুলি খানিকটা হলেও সুরক্ষা দিচ্ছে শিশুদের। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ছে এর ফলে, এমনটাই মনে হচ্ছে। যদিও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওবেসিটি থাকলে খুব সাবধান হতে হবে বলেই পরামর্শ দেন তিনি। কারণ এই পরিস্থিতিতে কারও কারও ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটরও প্রয়োজন হয়েছে করোনা হলে। অপূর্ববাবুর মত, আমরা প্রতিটা কেস থেকে বিষয়গুলিকে ধরে নিচ্ছি, অর্থাৎ এগুলি তত্ত্ব। তবে এ বিষয়ে হাতে-কলমে প্রচুর তথ্য ও গবেষণার প্রয়োজন।
ভাইরাল লোড বাচ্চাদের বেশি হচ্ছে, তবে তার কারণ নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাচ্চারা আক্রান্ত হলেও রোগের ভয়াবহতা তুলনামূলকভাবে কম। তবে সব মিলিয়ে বাচ্চাদের থেকেও যে করোনা সংক্রমণ হচ্ছে, তারাও বাহক হিসেবে কাজ করছে, এ কথা নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন: বুক ধড়ফড়? পা, গোড়ালি ফুলে যাচ্ছে? হার্টের ছন্দে গোলমাল নয় তো?
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy