প্রতীকী ছবি।
প্রায় এক মাস হতে চলল দেশের সব মানুষ গৃহবন্দি। তবুও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পনেরো হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। লকডাউন করে সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
প্রথমেই বলি, ইউরোপ আমেরিকার মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলি যা করতে পারেনি, ভারতবর্ষ তা পেরেছে। ২২ মার্চ ‘জনতা কার্ফু’ ও তার পরে পরেই লকডাউন করার ফলে আমাদের দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটাই রয়েসয়ে হচ্ছে। বিত্তবান দেশ যে সিদ্ধান্ত নিতে দশ বার চিন্তা করেছে, ভারত তুলনামূলক ভাবে গরিব দেশ হয়েও লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছে। আমাদের দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ দিন আনে দিন খায়। সেই দেশের পক্ষে সব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত একটা উল্লেখযোগ্য বড় পদক্ষেপ। লকডাউন হয়েছিল বলেই এখনও পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ অসুস্থের সংখ্যা সরকারি ভাবে সবে পনেরো হাজারের গণ্ডি পেরলো।
বেসরকারি ভাবে করোনা রোগীর সংখ্যাটা কি আরও বেশি?
নিশ্চয়ই। চোদ্দো হাজার বা পনেরো হাজার সংখ্যাটা শুধুমাত্র অসুস্থ রোগীর সংখ্যা। এই হিসেবের বাইরেও আর একটা হিসেব আছে। লকডাউন শুরুর আগে শেষ চার-পাঁচ দিনে ইউরোপ, আমেরিকা, চায়না ও মিডল ইস্ট থেকে প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ দেশে ফিরেছেন। দেশের মানুষ ফিরবেন এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাঁরা যে সব দেশ থেকে এসেছেন সেখানে তত দিনে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। অঙ্কের হিসেবে তাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ চার লক্ষ মানুষ কোভিড-১৯ পজিটিভ। তাঁদের থেকে গড়ে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই জন আক্রান্ত হয়েছেন। তা হলে নভেল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৮–১০ লক্ষ। তা-ও দেশ জুড়ে সব কিছু বন্ধ থাকার জন্য বিদেশ ফেরত বেশির ভাগ মানুষই দোকান-বাজার, সিনেমা হল, আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি বা শপিং মলে ঘুরে বেড়াতে পারেননি। নইলে সংখ্যাটা যে কোথায় গিয়ে পৌঁছত তা ভাবতেই ভয় করছে। সরকারি ভাবে যে সংখ্যাটা ঘোষণা করা হচ্ছে, তাঁরা শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও অন্যান্য অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসার জন্য আসছেন বলে পরীক্ষা করে ধরা পড়ছে। সরকারি হিসেবে এই সংখ্যাটাই জানানো হচ্ছে।
তার মানে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জোর ধাক্কায় আমরা এখন ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছি?
মর্টালিটি বা মৃত্যুর হার দেখে আমরা সাইকেলের ধাক্কা খেয়েছি নাকি ট্রাকের ধাক্কা খেয়েছি তা খানিকটা আন্দাজ করা যায়। ১৩৫ কোটি মানুষের দেশে যখন কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের মৃত্যু এখনও পর্যন্ত পাঁচশোর মধ্যে সীমিত থাকে তা হলে নিঃসন্দেহে বলা যায় আমরা খানিকটা সামলাতে পেরেছি। সার্স কোভ ২-র যে মারাত্মক দিক বা হিংস্রতা তা ইউরোপ, আমেরিকা বা চিনে অনেক বেশি। ধরুন, ওদের বাঘে তাড়া করেছে আর আমাদের শেয়ালে, তফাৎটা এইখানেই। কয়েকটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভয়েই হোক বা অন্য কারণে বেশির ভাগ মানুষ লকডাউন মেনে গৃহবন্দি আছেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইটালির মানুষ যা মানতে পারেননি আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষ কিন্তু তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। যদিও আমরা বিদেশিদের তুলনায় নিজেদের বিশৃঙ্খল মনে করে হীনমন্যতায় ভুগি, কিন্তু দেশের মানুষ প্রমাণ করে দিলেন তাঁরা প্রয়োজনে নিয়ম মেনে চলতে পারেন।
আরও পড়ুন: র্যাপিড ডায়াগনস্টিক হোম কিট ব্যর্থ আমেরিকায়, তা হলে এই টেস্টের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
তা হলে কি এখন অসুখটা নিয়ন্ত্রণে?
লকডাউনের ২৪–২৫ দিনের মধ্যে কখনও অতি মহামারিকে ধুয়েমুছে সাফ করা সম্ভব নয়। তা-ও এক মাসের আগেই ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত কিছুটা স্তিমিত করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিষয়ে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন যে সার্স কোভ-২-র দাপট কম হওয়ার পিছনে দু’-তিনটি কারণ আছে। এক, আমাদের দেশে ম্যালেরিয়া বেশি হয়। দুই, জন্মের পরেই বিসিজি ভ্যাকসিন দেওয়া হয় এবং তিন, আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র হওয়ার কারণে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা বেশি আছে। কিন্তু এ সব তত্ত্ব প্রমাণসাপেক্ষ।
বিশ্বের নিরিখে হিসেব করলে ভারতে পরীক্ষার হার অনেক কম
তা হলে কি এখন আমরা কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি?
এখনও সে সময় আসেনি। লকডাউনের সময় বাড়ানো হলেও পর্যাপ্ত টেস্ট না হওয়ায় এখনও আমাদের মধ্যে এমন অনেক করোনা পজিটিভ মানুষ থাকতে পারেন যাঁদের উল্লেখযোগ্য কোনও লক্ষণ নেই। একমাত্র পরীক্ষা করে তাঁদের চিহ্নিত করে আলাদা করে না রাখলে রোগের বিস্তার ঠেকানো মুশকিল। এ বিষয়ে একটা কথা বলা দরকার যে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই নভেল করোনাভাইরাসের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করা হল ২৪ মার্চ। অন্য দিকে, করোনাভাইরাসের টেস্টিং-এর পদ্ধতির উপরেও জোর দেওয়া হয়নি, এখনও যে ব্যবস্থা জোরদার করা গিয়েছে তা-ও নয়। মার্চের শুরুতে আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করে ও টেস্টিং-এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হয়তো ভোগান্তি অনেক কম হত।
আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ঘাটতি আছে?
বিশ্বের নিরিখে হিসেব করলে ভারতে পরীক্ষার হার অনেক কম। দেশের মধ্যে আবার অপেক্ষাকৃত ভাবে কম টেস্ট হচ্ছে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে। এ ক্ষেত্রে কারওকে দোষারোপ করা ঠিক নয়, তবে যথাযথ ল্যাবরেটরি ও টেস্টিং কিট সমেত পরিকাঠামোর অভাবেই এই সমস্যা বলে মনে করি। অবশ্য গত কয়েক দিনে পরীক্ষার হার কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। সেই অনুপাতে টেস্টের হার কম। আগে যে সব বেসরকারি হাসপাতালকে টেস্ট করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাদের যথাযথ সামর্থের অভাব ছিল। সম্প্রতি কয়েকটি বড় হাসপাতালকে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যাদের এই ক্ষমতা আছে। লকডাউন সফল করার সঙ্গে সঙ্গে টেস্টিং না বাড়ালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: ‘হটস্পট’ জেলার মধ্যে ‘কনটেনমেন্ট’ এলাকা সিল করে দিচ্ছে রাজ্য
লকডাউন সফল করতে পুলিশ ও প্রশাসন ভাল কাজ করছে, এর সঙ্গে সঠিক চিকিৎসা করালে নিশ্চয় রোগ আয়ত্তে আসবে?
চিকিৎসকদের তুলনায় পুলিশ পাঁচ গুণ বেশি কাজ করছে। কিন্তু ব্যাপারটা তো রায়ট কন্ট্রোল নয়। সংক্রমণ নিয়ে যদি কেউ বাড়িতে বসে থাকে, ৭–১০ দিন পরে সে কাজ করতে বেরলে আবার অজস্র মানুষ সংক্রমিত হবেন। তাই লকডাউন সফল করার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করিয়ে রোগীকে চিহ্নিত করা একান্ত প্রয়োজন। আর চিকিৎসার ব্যাপারে বলি, আক্রান্তদের একটা সেন্ট্রাল হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা না করলে আমাদের জন্য কিন্তু আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ২/৪ জন রোগীর চিকিৎসা হলে চিকিৎসক, নার্স-সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হবেন। চিকিৎসা করার জন্য হাসপাতাল বা ডাক্তার কারওকেই পাওয়া যাবে না। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল সংক্রমণের ভয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আমি অনুরোধ করছি, সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রোগী রেখে বিপদ ডেকে আনবেন না। আমাদের রাজ্যে অন্যান্য অসুখে আক্রান্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। অজস্র রোগী করোনার ভয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। কলকাতার অনেকগুলি হাসপাতালে ক্রনিক কিডনি ফেলিয়োরের রোগীরা নিয়মিত ডায়ালিসিস করেন। গত দু’-তিন সপ্তাহে ডায়ালিসিসের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। বাকিরা যে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন! তাই চিকিৎসক হিসেবে আমার বক্তব্য, রোগীদের জন্য হাসপাতাল ও প্রয়োজনীয় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কথা ভাবা হোক। অসুস্থ মানুষেরা যেন কোভিড-১৯-এর ভয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা না পড়েন। সবাই সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy