দ্রুত নিজেকে বদলাচ্ছে করোনাভাইরাস।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকরা এই মুহূর্তে কোভিড-১৯-কে জব্দ করার চেষ্টায় মগ্ন। প্রতি দিনই প্রায় অচেনা মারণ ভাইরাসের নতুন নতুন চরিত্র জানতে পারছেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যালামাস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একদল গবেষক জানিয়েছেন, নভেল করোনাভাইরাসের যে বিবর্তিত ধরনটি (মিউটেটেড স্ট্রেন) ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে তার সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। লস অ্যালামাস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষক দলের প্রধান, কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট বেট করবার এবং ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড ও ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষক দল একত্রে সার্স কোভ-২ ভাইরাস নিয়ে গ্লোবাল ডেটাবেস বিশ্লেষণ করে আমেরিকার প্রথম সারির দৈনিক ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে এই তথ্য জানিয়েছেন
নভেল করোনাভাইরাস ইউরোপে পৌঁছনর পর ডি-৬১৪ জি স্পাইক প্রোটিন মিউটেট করে, অর্থাৎ বিবর্তিত হয়ে আরও মারাত্মক হয়ে উঠেছে। আরএনএ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনই মানুষের কোষে সংক্রমণ ঘটায়। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল কোভিড-১৯ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মিউটেশনের ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ আরও জোরদার হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ইউরোপে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়। তখনই চিনের উহান থেকে আসা এই ভাইরাসটির মিউটেশন হয়। আর বদলে যাওয়া স্পাইক D614G নিয়ে দ্রুত মারাত্মক হারে ছড়িয়ে পড়ে। গবেষণাটি আরও নিখুঁত তথ্য ও যথাযথ সমীক্ষার পর গ্রাহ্য হবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অধিকর্তা ফ্রান্সিস কলিন্স ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কে ইমেল মারফৎ জানিয়েছেন যে লস অ্যালামাস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষক দলের প্রধান উদ্দেশ্য, নভেল করোনাভাইরাসের মিউটেশনের আগেই তা জেনে নেওয়া। এই প্রসঙ্গে গবেষকরা জানিয়েছেন যে কোনও জীবাণু জেনেটিক মিউটেশন কপি করার সময় কিছু ভুল করতে পারে, তবে তার জন্য জীবাণুটির সংক্রমণ ও রোগ সৃষ্টিতে সে রকম কোনও হেরফের হয় না। জেনেটিক্যালি ভিন্ন হলেও কার্যকারিতা, অর্থাৎ রোগ সৃষ্টির দিকে থেকে খুব আলাদা নয়। কিন্তু কোভিড-১৯ এর আশ্চর্যজনক দিক হল অনবরত অদ্ভুত ভাবে মিউটেশন হওয়া। কমবেশি সব ভাইরাসই নিজেকে বদলে ফেলে। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস আশ্চর্যজনক ভাবে অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় অনেকটাই স্থিতিশীল। আর এই কারণেই কোভিড-১৯-এর এত বাড়বাড়ন্ত বলে ভাইরোলজিস্টদের ধারণা।
আরও পড়ুন: উপসর্গ কমলে টেস্ট ছাড়াই হাসপাতাল থেকে ছুটি, বিতর্কে নতুন কেন্দ্রীয় নিয়ম
লস অ্যালামাসের গবেষক দল বিশ্বের ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটাবেস থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিড ১৯-এর থেকে ইউরোপের ভাইরাসের স্পাইকের ( D614G ) মিউটেশন হয়েছে। হার্ভার্ডের এপিডেমিওলজিস্ট এবং সংক্রামক রোগের বিবর্তন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম হ্যানাগে জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ এর স্পাইক প্রোটিন সংক্রমণ সৃষ্টির জন্যে দায়ী ঠিকই কিন্তু মিউটেশনের জন্য এর সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ে তা নিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে আরও সমীক্ষা প্রয়োজন। তিনি জানান, নভেল করোনাভাইরাস যখন উত্তর ইটালিতে পৌঁছয় সেখানকার বয়স্কদের মধ্যে রোগের বিস্তার হয় দ্রুত হারে। কোভিড-১৯-এর দু’ধরনের স্ট্রেন মার্চের শুরুতে ইউরোপে পৌঁছয়। আর এখন দুটি স্ট্রেনের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। যদি মিউটেটেড ভাইরাস বেশি সংক্রামক হত তা হলে রোগটা আরও ছড়িয়ে পড়ত বলে হ্যানাগে মনে করেন।
উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট ডেভিড ওকন্নোর মতে, লস অ্যালামোসের গবেষকদের বিশ্লেষণ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় ঠিকই, কিন্তু তাঁদের তথ্য সংগ্রহে কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছে। সঠিক বিশ্লেষণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে পরিসংখ্যান নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওঁরা শুধুমাত্র ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকার ডেটাবেসের উপর ভিত্তি করে গবেষণা করেছেন। এমনকি, মিউটেটেড নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি সংক্রান্ত কোনও তথ্য লস অ্যালামাসের গবেষকরা জানাতে পারেননি।
ভারতে নভেল করোনাভাইরাসের মিউটেশন এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে ভাইরোলজির বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী জানালেন, আমাদের শরীরে অজস্র কোষ আছে, কিন্তু ভাইরাস কোনও কোষ নয়, জীব ও জড়ের মাঝামাঝি এক পার্টিকল। এই ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করেই শুরু করে কেরামতি। মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে যে জিন আছে তার মধ্যে গেড়ে বসে। কোভিড-১৯ আরএনএ ভাইরাসের যে স্পাইক নিয়ে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, সেটাই হল এই ছোঁয়াচে অসুখের বড় হাতিয়ার। এই স্পাইকের সাহায্যেই কোভিড-১৯ আমাদের শরীরের শ্বাসনালী, মুখ, নাক বা গলায় পৌঁছে কোষে আটকে যায়। আটকে গিয়েই কোষে একটা ছিদ্র করে দিয়ে ভাইরাসের জিনকে আমাদের কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খোলস বাইরে ফেলে দেয়। এ বারে ভাইরাস জিনের মধ্যে পৌঁছে যায়। আমাদের জিন মনে করে, ভাইরাস আমাদের শরীরেরই অঙ্গ। তাই তারই নির্দেশিত পথে কাজ শুরু করে, বললেন অমিতাভবাবু। আমাদের জিনে একটা বিশেষ জায়গা আছে, তাকে বলে সিগনেচার। ব্যাপারটা অনেকটা কাপড় মাপার ফিতের মতো। এক একটা জায়গা এক একটা কাজের জন্য নির্দিষ্ট। ধরুন, এক ইঞ্চি জায়গায় গায়ের রং ঠিক হয়, এক ইঞ্চিতে মনমেজাজ, অন্য জায়গায় চুলের ঘনত্ব, এই রকম আর কী। ভাইরাস সেই অংশে গিয়ে জিনকে তার বিভিন্ন অংশ তৈরির নির্দেশ দেয়। স্পাইক, মেম্বব্রেন বা খোলস তৈরির পর কম্পিউটারের মতো অ্যাসেম্বল করে পুরো ভাইরাস তৈরি হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ ভাইরাস তৈরি হলে এক কোষ থেকে অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। এই ব্যাপারটা সঠিক ভাবে জেনে নিয়েই ভ্যাকসিন তৈরি করা হচ্ছে। স্পাইকের সুনির্দিষ্ট গঠন জানাটা খুব জরুরি। তবে যে হারে কোভিড-১৯ মিউটেট করছে আগামী দিনে হয়তো প্রতি বছরই নতুন নতুন টিকা বানাতে হবে বলে জানালেন অমিতাভবাবু।
আরও পড়ুন: ভাইরাস ভয় ভাঙতে ছোঁয়াচে হোক শিল্প
মোহালির ইসার (আইআইএসইআর)-এর হিউম্যান প্যাথোজেনিক ভাইরাসের সংক্রমণজনিত অসুখের গবেষক ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, নভেল করোনাভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি মিউটেট করে। ইউরোপ আমেরিকাতে কোভিড-১৯-এর মিউটেশন অনেক বেশি মানুষকে আক্রমণ করেছে। আমাদের দেশে অ্যানালিসিস চলছে, কতটা মিউটেশন হয়েছে এখনও জানা যায়নি। ইন্দ্রনীলবাবু জানালেন, ভাইরাসের মিউটেশন আর আমাদের বংশগত জেনেটিক মিউটেশন, এই দুটোর কম্বিনেশনের উপর নির্ভর করে ভাইরাস কতটা মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়বে বা এর প্রাবল্য তুলনামূলক ভাবে কম হবে। এই নিয়ে কাজ চলছে। তবে এখনই কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কমে যাবে এ কথা বলা যাচ্ছে না। বরং আরও বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। তাই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে অনেক দিনই।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy