যক্ষ্মার টিকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খানিকটা বাড়বে, বলছেন বিজ্ঞানীরা। ফাইল ছবি।
টিউবারকিউলোসিস বা যক্ষ্মার টিকা কি আদৌ করোনা যুদ্ধে সঙ্গী হতে পারে? বিসিজি টিকা অর্থাৎ ব্যাসিলে কালমেট গেরিন কি করোনা প্রতিরোধ করতে সক্ষম?
নিউ ইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের একটি গবেষণায় এই তত্ত্বের কথা উঠে এসেছিল। এরপর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মলিকিউলার মেডিসিনের চেয়ারপার্সন গোবর্ধন দাস জানিয়েছিলেন, কিছুটা হলেও বিসিজি করোনা প্রতিরোধে সাহায্য করতে সক্ষম।তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিসিজি ভ্যাকসিন কাজ করে কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আইসিএমআর-এর অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্চে শুরু হয়েছে পরীক্ষা। এই ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করবে? আদৌ কাজ করবে কি? চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা কী ভাবছেন?
টিবি ভ্যাকসিন বা যক্ষ্মা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ছটি মেজর স্ট্রেন রয়েছে— পাস্তুর, ড্যানিশ, গ্লাক্সো ১০৭৭, টোকিও, রাশিয়া, মোরেউ। গোবর্ধনবাবু ও তাঁর সহযোগীদের রিভিউ স্টাডি প্রকাশিত হয়েছে সেল ডেথ অ্যান্ড ডিজিজ গবেষণাপত্রে। তাতে উল্লেখ রয়েছে, সব দেশের ক্ষেত্রে এটি একইরকমভাবে কার্যকর নয়। বিসিজি মিক্স, বিসিজি পাস্তুর, বিসিজি টোকিও তুলনামূলক ভাবে দ্রুত কাজ করে। আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয় বিসিজি মিক্স।
আরও পড়ুন: রোজ কেন খেতেই হবে এই গরিবের ‘আপেল’?
কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য জীববিজ্ঞানী শ্যামল রায় বললেন, ‘‘এত তাড়াতাড়ি এই টিকা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়। করোনা সংক্রমণ রুখতে পারে বিসিজি, এ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে এটা ঠিক যে কিছু দেশে বিসিজি টিকা নিয়ে নীতি রয়েছে, সেই সব দেশে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর হার কম।’’ এরই পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য,এতে আরও অনেকগুলো ফ্যাক্টর রয়েছে। বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত না হলে এ নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির বিজ্ঞানী দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় দীর্ঘ সময় ইমিউনোলজি, ইনেট ইমিউনিটি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি টিকাপ্রয়োগ নিয়ে বলেন, ''বিসিজি নিয়ে সেই অর্থে র্যানডমাইজড কন্ট্রোল এখনও হয়নি। নতুন করে বিসিজি বুস্টার দিয়ে দেখলে তবে তা বোঝা যেতে পারে। যিনি কখনও কোনও সংক্রমণ দেখেননি, তাঁর সিস্টেম তৈরিই নেই জৈব রাসায়নিক পদার্থ দেহে তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ করার।'' তবে ভারতের মতো ক্রান্তীয় দেশগুলিতে নানারকম রোগের সম্মুখীন হয়েছে মানুষ। তাই ‘ট্রেনড ইমিউনিটি’ রয়েছে অনেকটাই। তাঁর কথায়, যে সব দেশে বিসিজি ভ্যাকসিন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের অন্তর্গত সে সব দেশের ক্ষেত্রে একটু কম সংক্রমণ হচ্ছে দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকেই এই ধারণা।
তবে বিসিজির ক্ষেত্রে যে ট্রেনড ইমিউনিটি হয়, সেটা কি কোভিডের ক্ষেত্রে কাজ করছে?
দীপ্যমানবাবুর কথায়, ‘‘বিসিজির ক্ষেত্রে যে ইমিউন রেসপন্স, তা নির্দিষ্টভাবে কোভিডের ক্ষেত্রেও কাজ করে কি না সেটা দেখা জরুরি। বিসিজির ক্ষেত্রে সাধারণত ইমিউন সিস্টেমের যে প্রস্তুতি, সেটা কোভিডের ক্ষেত্রে সহায়তা করছে কি না, দু’টিই দেখা জরুরি।’’ অর্থাৎ বিসিজির ক্ষেত্রে যে টি সেল কাজ করে, সেটাই এ ক্ষেত্রে কাজ করছে কি না, এই সম্ভাবনাগুলো নিয়েই কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। তবে নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ মেলেনি এখনও।
কয়েকটি ট্রায়ালে শ্বাসনালীর কিছু সংক্রমণে কাজ দিয়েছে যক্ষ্মার টিকা বা বিসিজি। ফাইল ছবি
মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলিনার পোস্ট ডক্টরেট শিল্পক চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে আইআইসিবি-র একজন বিজ্ঞানী। দীর্ঘদিন কাজ করছেন ইমিউনোমেটাবলিজম ও টি সেল বায়োলজি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘‘বিসিজি ভ্যাকসিন তো নিজেই একধরনের মাইকো ব্যাক্টিরিয়া,কার্যকরী ক্ষমতার কারণে ইমিউন রেসপন্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এটি।’’ শিল্পকবাবু বলেন, ‘‘বিসিজি ভ্যাকসিনেশন কিন্তু আগে কয়েকটি ট্রায়ালে শ্বাসনালীর কিছু সংক্রমণ, ইনফ্লুয়েঞ্জা-সহ কয়েকটি ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিরোধে কাজ করেছে। কোভিড-১৯ একটি আরএনএ ভাইরাস, তাই ভাবা হচ্ছে কাজ করতে পারে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকায় এ নিয়ে কাজ হয়েছে।’’
বিসিজি ভ্যাকসিনেশন কী ভাবে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কাজ করবে?এটি তো ব্যাক্টিরিয়া।
শিল্পকবাবু বলেন,ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইনফেকশন জার্নালে এই সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি স্টাডির রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। হেপাটাইটিসের উপরেও বিসিজি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়েছে। ইতিবাচক ফল মেলার কারণেই কোভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে এটি কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু সেটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
আরও পড়ুন: করোনা-আবহে দাঁতের চিকিৎসায় অবহেলা করছেন? কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
যদিও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বিসিজি ভ্যাকসিনে কোভি়ড-১৯ সংক্রমণের প্রতিরোধের বিষয়টিতে এই মুহূর্তে গুরুত্ব দিতে একেবারেই নারাজ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে বলছেন তিনি। মেডিসিনের চিকিৎসক রাজর্ষি সেনগুপ্ত বলেন, বিসিজি টিকার সঙ্গে কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনও প্রমাণই মেলেনি। সরাসরি কোনও বিসিজি ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে টি লিম্ফোসাইটজনিত প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। সে ক্ষেত্রে‘সেলুলয়েড ইমিউনিটি’ বাড়লে অন্য রোগ প্রতিরোধও সহজ হবে। করোনার ক্ষেত্রেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা। ইটালির কিছু ক্ষেত্রে বিসিজি দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে কোভিড সংক্রমণের তীব্রতা অনেকটাই বেশি। কিন্তু বিসিজি দিলেই করোনা ভয়ঙ্কর হবে না, এ রকম কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি। এই সিদ্ধান্তে আসতে গেলে নানা বয়সের বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ‘কো মর্বিড ফ্যাক্টর’-সহ পরীক্ষামূলক ট্রায়াল প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
টিবির ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলেই যে করোনা হবে না, এ কথা একেবারেই ঠিক নয়, এমনটাই জানালেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজির বিভাগীয় প্রধান রিনারানি রায়। ‘পার্সোনালাইজড মেডিসিন’-এর কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ভাইরাসটি ক্রমাগত মিউটেট করে বদলে যাচ্ছে। বদলাচ্ছে উপসর্গও। প্রতিটি মানুষের জিনগত গঠন আলাদা। সে ক্ষেত্রে এটি মাথায় রাখা জরুরি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিসিজি দেওয়া থাকলে হয়তো প্রতিরোধ শক্তি বেড়েছে। কিন্তু একই কথা সবার ক্ষেত্রে কখনওই খাটতে পারে না। ঠিক যেমন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ক্ষেত্রেও হয়েছে।
মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, ‘‘বিসিজি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে তা মানুষকে করোনা থেকে বাঁচাবে, এমন কোনও প্রমাণ নেই। অস্ট্রেলিয়াতে ট্রায়াল হলেও প্রমাণিত হয়নি। নিশ্চিতভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। তাই বিসিজি দেওয়া আছে বলে প্রতিরোধের উপর গুরুত্ব না দিলে, বিপদ আরও বাড়বে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy