হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বিজ্ঞানীরা।
বেশ কিছু দিন যাবৎ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা এইচসিকিউ-এর বাজার ছিল রমরমা। সে কোভিড ঠেকাতে পারে জানার পর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সবাই। এই ওষুধ পেতে ভারতকে একরকম হুমকিই দিয় বসে আমেরিকা! বিদেশে রফতানি করা হয়েছিল টন টন এইচসিকিউ। দলে দলে মানুষ ডাক্তারের কথা অগ্রাহ্য করে খেতে শুরু করেছিলেন এই ওষুধ। ফলে ওষুধের অভাবে অসুবিধেয় পড়েছিলেন রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও লুপাসের রোগীরা। এর মধ্যে অবশ্য অন্য খবরও আসছিল, এইচসিকিউ খেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি।
এ বার বদলালো। জানা গেল, যে সব গবেষণার উপর ভিত্তি করে ভাবা হয়েছিল এইচসিকিউ তুলনাহীন, সে সবই ত্রুটিপূর্ণ। সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়েছে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী জানালেন, “কবে ভাইরাস ঢুকবে সেই ভয়ে মাসের পর মাস ওষুধ খেয়ে যাওয়া খুব বিপজ্জনক প্রবণতা। বিশেষ করে যে ওষুধের কোভিড ঠেকানোর বা মারার ক্ষমতাই নেই, উল্টে সাইড এফেক্ট আছে অনেক। রোগ হলে যখন শরীরে প্রদাহ হয়, তখন তার কিছু ভূমিকা আছে অবশ্যই। তবে ওই জ্বর-গলাব্যথা কমানো পর্যন্ত, তার বেশি কিছু নয়।”
তা হলে কিসের ভিত্তিতে দুনিয়া জুড়ে এত উথাল পাথাল হল! আসুন দেখে নেওয়া যাক।
অসম্পূর্ণ গবেষণা: বিতর্কিত তথ্য
বিশেষজ্ঞদের মতে, এইচসিকিউ নিয়ে যতটুকু যা গবেষণা হয়েছে, তা সবই প্রাথমিক পর্যায়ের। কোনও বিজ্ঞানী কিছু তথ্য পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে গবেষণাপত্র লিখে বিজ্ঞান পত্রিকায় পাঠানো মাত্র তা খবর হয়ে বেরিয়ে এসেছে। প্রবন্ধ ছাপা হওয়ার আগে যে পিয়ার রিভিউ হওয়ার কথা, অর্থাৎ আরও পাঁচ-দশ জন বিজ্ঞানী সেটা পড়বেন, মতামত দেবেন, কোথাও সন্দেহ থাকলে সেই সন্দেহ নিরসনে আরও কিছু পরীক্ষা করতে বলবেন, তার পর সব দিক বুঝে আটঘাট বেঁধে তা প্রকাশ করার অনুমতি দেবেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়নি। রেন্ডমাইজড কন্টেরাল ট্রায়াল অর্থাৎ কোনও রাসায়নিককে ওষুধের তকমা দেওয়ার আগে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করে যে সমস্ত লম্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব পার হতে হয়, তা এ ক্ষেত্রে হয়নি। কখনও আবার বৈজ্ঞানিক পরিভাষার ভুল ব্যখ্যা হয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
গবেষণাগার বনাম মানব শরীর
বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইন ভিট্রো ভার্সেস ইন ভিভো। ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে কয়েক জন চিনা বৈজ্ঞানিক জার্নাল অফ সেল রিসার্চের সম্পাদককে চিঠি লিখে জানান, রেমডেসিভির ও এইচসিকিউ-এর সমগোত্রীয় ক্লোরোকুইন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।
ভাল কথা। কিন্তু সমস্যা হল, এই গবেষণার পুরোটাই হয়েছে গবেষণাগারে, মানব শরীরে প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা দেখা হয়নি। এর আগেও এইচসিকিউ নিয়ে এ রকম পরীক্ষা হয়েছে। আরও অনেক ভাইরাসের বিরুদ্ধে তার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। তার মধ্যে সার্স ভাইরাসও আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত মানব শরীরে তার ভূমিকা জানা যায়নি। কাজেই এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে বলা যায় না যে, এইচসিকিউ কোভিড ১৯ সারাতে বা ঠেকাতে পারে।
বেশ কিছু গবেষণায়র তথ্য ভুল বলে মত প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। —প্রতীকী ছবি
বিতর্কিত ফরাসি গবেষণা
এই গবেষণার ফলাফল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টস-এ প্রকাশিত হওয়ার পরই আসল বাড়াবাড়িটা শুরু হয়। কারণ এক দল বিজ্ঞানী দাবি করেন, এইচসিকিউ ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কোভিড রোগীর চিকিৎসা করে তাঁরা দেখেছেন খুব দ্রুত ভাইরাসের পরিমাণ কমছে। তাঁদের সেই দাবি বিশেষজ্ঞদল যাচাইও করে নেন।
তা হলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল, কারণ যে ভাবে গবেষণার কাজ সাজানো হয়েছিল ও যে ভাবে তার ফলাফল ব্যাখ্যা করা হয়, তাতে গলদ ছিল। অনেক কিছু খোলসা করে বলা হয়নি। ওষুধ দেওয়ায় কত জন রোগীর উপসর্গ কমেছে, কত জনের বেড়েছে, কত জন মারা গিয়েছেন, সে সব তথ্য না দিয়ে তাঁরা শুধু শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কতটা কমেছে, সেটা জানিয়েছিলেন। আসল ঘটনা হল এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করার পর ৫ জন রোগীর মধ্যে ৪ জনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যায়। ৩ জনকে আইসিইউ-তে পাঠাতে হয়। এক জন মারা যান। আর এক জনের শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমে। তার ভিত্তিতেই তাঁরা বলেন, এইচসিকিউ খেলে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমে ও রোগী সেরে যান।
পরবর্তী কালে তাঁরা আরও যে সব পরীক্ষা করেন, সেখানেও নিয়ম মেনে কাজ হয়নি। ক্লিনিকাল ট্রায়ালের নিয়ম হল দুই দল এমন রোগীকে নিয়ে কাজ করতে হয়, যাঁদের সমস্যা, বয়স ইত্যাদি সব এক। তার মধ্যে একদলকে ওষুধ দিয়ে অন্য দলকে না দিয়ে দেখা হয় উপসর্গ কার ক্ষেত্রে কতটা কমল বা বাড়ল। যে দলকে ওষুধ দেওয়া হয় না তাঁদের বলে কন্টেরাল গ্রুপ। এই গবেষণায় কন্টেরাল গ্রুপ রাখাই হয়নি।
চাইনিজ ক্লিনিকাল ট্রায়াল
এপ্রিলের গোড়ায় ৬২ জন মৃদু কোভিড রোগীকে স্টাডি করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন চিনা বিজ্ঞানীরা। তাতে জানানো হয়, যাঁদের এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে তাঁদের জ্বর-সর্দি-কাশি কমেছে অনেক তাড়াতাড়ি।
সমস্যা হল, এত কম রোগীর উপর পরীক্ষা করে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়। ট্রায়ালে কোনও জটিল রোগী ছিলেন না। কাজেই তাঁদের উপর এই ওষুধের প্রভাব কতটা তা জানা যায়নি। প্রবন্ধ প্রকাশের আগে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তার ভাল-মন্দ যাচাই করা হয়নি। তার উপর গবেষকরা নিজেরাই বলেছেন, সঠিক চিত্র পেতে গেলে আরও বড় করে পরীক্ষা করা দরকার। এইচসিকিউ কী ভাবে মানবদেহে কাজ করে, তা জানতেও আলাদা করে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ফ্রান্সে পুরোনো তথ্যের বিশ্লেষণ
পুরোনো তথ্যের বিশ্লেষণ অর্থাৎ রেট্রোস্পেকটিভ অ্যানালিসিসের জন্য ফ্রান্সের গবেষকরা দু’দল কোভিড রোগীকে বেছে নেন। যাঁদের মধ্যে ৮৪ জনের চিকিৎসা হয়েছিল এইচসিকিউ দিয়ে। বাকি ৯৭ জনের অন্য ওষুধ দিয়ে। এঁদের চিকিৎসার নথি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানান যে, এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করলেই যে সব সময় ভাল ফল হবে এমন নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে রেট্রোস্পেকটিভ অ্যানালিসিস করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব নয়। যার প্রধান কারণ, কিসের ভিত্তিতে চিকিৎসক কাউকে এইচসিকিউ দিয়েছিলেন আর কাউকে দেননি তা এই এই পরীক্ষা থেকে জানা সম্ভব নয়। একমাত্র রেন্ডমাইজ কন্টেরাল ট্রায়াল করলেই এই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়।
ব্রাজিলীয় গবেষণায় এইচসিকিউ বাতিল
ব্রাজিলের গবেষকদের দাবি, এইচসিকিউ খুব জরুরি ওষুধ। তবে যেহেতু এর বেশ ভাল রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, তাই অ্যারিদমিয়া নামে হৃদরোগে রোগী মারাও যেতে পারেন। তাই খুব প্রয়োজন না হলে এই ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ছাড়া তো একেবারেই নয়।
সমস্যা হল এই গবেষণায় দু’টি বিভিন্ন মাত্রায় এইচসিকিউ দিয়ে রোগীর ভাল-মন্দের বিচার করেছিলেন গবেষকরা। ওষুধ না দিলে কী হয়, তা তাঁরা দেখেননি। তা ছাড়া এই গবেষণাপত্রের বিচার-বিশ্লেষণও করেনি বিশেষজ্ঞ কমিটি।
পাশ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় ব্রাজিলে বাতিল হয়েছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। —প্রতীকী ছবি।
আমেরিকায় পুরোনো তথ্যের বিশ্নেষণ
৩৬৮ জন পুরোনো কোভিড রোগীর নথি বিশ্লেষণ করেন মার্কিন গবেষকরা। তার মধ্যে একদল রোগী পেয়েছিলেন এইচসিকিউ, একদল এইচসিকিউ ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও একদলের চিকিৎসা হয়েছিল অন্য ওষুধ দিয়ে। তাতে দেখা যায় প্রথম দুই দল রোগীর ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হয়েছে ও এঁদের মৃত্যুহার কমেনি। এমনকি যাঁরা শুধু এইচসিকিউ পেয়েছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই মারা গিয়েছেন। তবে এই গবেষণায় শুধু পুরুষ রোগীদের কথাই ছিল। তার উপর যাঁরা এইচসিকিউ পেয়েছিলেন তাঁদের অবস্থা এতটাই জটিল ছিল যে, তাঁরা জটিলতার জন্য মারা গিয়েছেন না এইচসিকিউ-এর জন্য তা পরিষ্কার নয়। তা ছাড়া এই গবেষণাপত্রের বিচার-বিশ্লেষণও বিশেষজ্ঞ কমিটির দ্বারা হয়নি।
শেষ কথা
গত ২১ এপ্রিল ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের তত্ত্বাবধানে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তাঁরা কোভিড ১৯-এর চিকিৎসার যে গাইডলাইন প্রকাশ করেন, তাতে বলা হয় এখনও পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা হয়েছে তার ভিত্তিতে এইচসিকিউ ভাল না মন্দ তা বলা সম্ভব নয়। তবে যেহেতু হৃদরোগের আশঙ্কা আছে, তাই এইচসিকিউ ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন না দেওয়াই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy