বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সমস্যার মধ্যে অন্যতম আঁচিল। যদিও এই সমস্যায় ব্যথা বা বিশেষ কোনও অস্বস্তি থাকে না। কিন্তু ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন আপাত নিরীহ মনে হলেও এই সমস্যা কতটা বিড়ম্বনার হতে পারে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, সাধারণ ভাবে ত্বকের এই সমস্যাকে আঁচিল বলা হলেও রয়েছে রকমভেদ।
আঁচিল কয় প্রকার ও কী কী?
ত্বকের উপর হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আকারে ছোট এক ধরনের মাংসল বৃদ্ধিকে আঁচিল বলা চলে। কিন্তু সবক্ষেত্রে কি সে ভাবেই উৎপত্তি হয় আঁচিলের? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
আঁচিল সাধারণত চার প্রকার। প্রথম ধরনের আঁচিলকে বলা হয় অ্যাক্রোকর্ডন বা স্কিন ট্যাগ। দ্বিতীয় ধরনের নাম ভেরুকা বা ওয়ার্টস। তৃতীয় ধরনের আঁচিলকে বলা হয় মোল। এ ছাড়া জন্মগত আঁচিলও থাকে অনেকের। চতুর্থ ধরনটিকে বলা হয় সেবোরিক কেরাটোসিস।
অ্যাক্রোকর্ডন বা স্কিন ট্যাগ:
ঘর্ষণের ফলে মূলত এই আঁচিলের সৃষ্টি। পোশাক বা শক্ত কলারে ত্বক ক্রমাগত ঘষা খেয়ে ত্বকের ছোট একটি অংশ ফুলতে শুরু করে। ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয়, ঘর্ষণের ফলে স্থূল বা মাত্রাতিরিক্ত পাতলা হয়ে যাওয়া ত্বকের এপিডার্মিস স্তরের চারপাশে কোলাজেন প্রোটিন ফাইবার ও রক্তবাহগুলি আলগা ভাবে সজ্জিত হয়ে আঁচিলের সৃষ্টি করে। সোজা বাংলায় ঘর্ষণের জন্য ত্বকের কোষ শিথিল হয়ে প্রসারিত হলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এই রকমের আঁচিল তিন ধরনের হয়।
ছোট আকারের স্কিন ট্যাগ: ঘাড়ে ও বাহুমূলে এই ধরনের আঁচিল দেখা যায়। আকারে সাধারণত ১ থেকে ২ মিলিমিটার হয়।
মাঝারি আকারের স্কিন ট্যাগ: দেহের বিভিন্ন অংশেই এই আঁচিল গজিয়ে উঠতে পারে। আকারে ৫ মিলিমিটার থেকে ২ মিলিমিটারের মধ্যে হয়।
বড় আকারের স্কিন ট্যাগ: এই আঁচিলগুলোই পেডাঙ্কল নামক সরু অংশের সাহায্যে ত্বকে লেগে থাকে। মূলত দেহের নীচের অংশে এগুলি দেখা যায়। আকারে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
স্কিন ট্যাগ এমনিতে সে রকম ক্ষতিকারক না হলে পোশাকের ঘর্ষণে অনেক সময়ই সেগুলি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
ভেরুকা বা ওয়ার্ট:
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের আক্রমণের ফলে এই ধরনের আঁচিল দেখা যায়। ভেরুকা বা ওয়ার্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে যে বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা হল, এটি ছোঁয়াচে। তাই হঠাৎ করে যদি আপনি দেখেন আপনার হাত, পা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মুখে ওয়ার্টের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তা হলে বুঝবেন, অন্য কারও মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন আপনি। অনেক সময় জুতো থেকেও ওয়ার্ট হতে পারে। ওয়ার্ট মূলত চার প্রকার:
সাধারণ ওয়ার্ট: সাধারণত হাতে বা আঙুলে হয়।
প্ল্যান্টার ওয়ার্ট: পায়ের পাতা ও পায়ের নীচে হয়ে থাকে।
জেনিটাল ওয়ার্ট: এটি এক ধরনের যৌনরোগ। অসুরক্ষিত যৌনতা থেকে এই আঁচিলের উৎপত্তি।
ফ্ল্যাট ওয়ার্ট: শরীরে যে অংশে নিয়মিত শেভ করা হয়, সেখানে এই আঁচিল দেখা যায়। সাধারণত মুখে, কপালে, গালে এই আঁচিল গজিয়ে উঠতে পারে।
জন্মগত আঁচিল, তিল ও মোল
মেলানোসাইট নামের পিগমেন্ট-ফর্মিং কোষের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে ত্বকে মোলের সৃষ্টি হয়। মাত্রাতিরিক্ত সূর্যালোক ও জিনগত কারণের ফলে মেলানোসাইটের এই বৃদ্ধি দেখা যায়। মোল সাধারণত গাঢ় রঙের হয়। অনেক সময় মোলের রোমকূপ থেকে রোম গজায়। অনেক সময় মোলাস্কাম কন্টাজিওসাম ভাইরাসের ফলেও মোল হতে পারে।
অনেকের জন্মগত তিল ও আঁচিল থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় সেগুলি আকারে ছোট হয়ে যায়। যদি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকারে বাড়তে থাকে, তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মোল মানেই কিন্তু মেলানোমা বা স্কিন ক্যান্সার নয়। মেলানোমা বা স্কিন ক্যান্সারের শুরুর অবস্থার সঙ্গে মোলের সাদৃশ্য থাকলেও মনে রাখতে হবে মেলানোমার বৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিত হয়।
স্কিন ট্যাগ, ওয়ার্ট ও মোলের পার্থক্য
স্কিন ট্যাগ ত্বকের খুব ভিতরে যায় না। কিন্তু ওয়ার্ট বা মোলের বিস্তার ত্বকের অনেক গভীরে হতে পারে।
স্কিন ট্যাগ ও মোল সাধারণত নরম হলেও ওয়ার্ট খসখসে শক্ত।
বাকি দু’টি ছোঁয়াচে না হলেও ওয়ার্ট মারাত্মক ছোঁয়াচে।
ঘর্ষণের ফলে ত্বকের কোষ শিথিল হয়ে স্কিন ট্যাগের সৃষ্টি হয়। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস থেকে ওয়ার্টের উৎপত্তি। মাত্রাতিরিক্ত সূর্যালোক, জিনগত কারণ ও জন্মগত ভাবে মোলের উৎপত্তি।
সেবোরিক কেরাটোসিস:
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোষের অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে মুখে, পিঠে, ঘাড়ে ও বুকে যে খসখসে বড় আকারের উপবৃদ্ধি দেখা যায় তাকে বলে সেবোরিক কেরাটোসিস। এটি একেবারেই ছোঁয়াচে বা ক্যান্সারাস নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত বয়স বাড়ার কারণে ও জিনগত কারণে এগুলির উৎপত্তি। অনেক সময় এগুলিতে অস্বস্তিকর চুলকানি দেখা যায়।
আঁচিল কাদের হয়?
আঁচিল হওয়ার প্রবণতার দিকে নারী-পুরুষ উভয়েই সমানে সমান। তবে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আঁচিল হওয়ার হারও বেড়ে যায়, যেমন, মধ্যবয়সের পর আঁচিল হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বেশি বয়সের লোকেদের অনেক আঁচিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া, যাদের ওজন খুব বেশি ও গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে আঁচিলের প্রবণতা দেখা যায়।
শরীরে কোথায় আঁচিল হতে পারে?
শরীরে যে কোনও স্থানেই আঁচিল হতে পারে। তবে মূলত ঘাড়ে, বাহুমূলে, স্তনের নীচে ও শরীরের নিম্নাংশে স্কিন ট্যাগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। হাতে, পায়ে, শরীরের নিম্নাংশে দেখা যায় ওয়ার্টের উৎপত্তি। আর শরীরে যে সকল স্থান মাত্রাতিরিক্ত সূর্যালোক পায় সেখানে মোলের আবির্ভাব হতে পারে।
আঁচিলের চিকিৎসা
অনেকেই বাড়িতে নানা পদ্ধতিতে আঁচিলের চিকিৎসা করে থাকেন। সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা, ব্লেড দিয়ে কাটা, চুন ইত্যাদি টোটকা ব্যবহার করার কথাও শোনা যায়। চিকিৎসকদের মতে, এগুলো করা একেবারেই উচিত নয়। এর ফলে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। সাধারণত অ্যান্টি ভাইরাল ক্রিম ও ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা হয় ওয়ার্টের। আঁচিল সারিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় লেজ়ার, রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি সার্জারি ও ক্রায়োসার্জারি। ত্বকের অবস্থা থেকে চিকিৎসকেরাই বলে দেবেন রোগীর কোন চিকিৎসা প্রয়োজন। বর্তমানে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমেও চিকিৎসা সম্ভব। এ ছাড়া প্রয়োজন যত্নেরও। সানস্ক্রিন, ছাতা ছাড়া রোদে বেরোনো উচিত নয়। ত্বকের একটু যত্ন নিলে যদি বিড়ম্বনা এড়িয়ে ভাল থাকা যায়, ক্ষতি কী?
তথ্যসূত্র: প্লাস্টিক সার্জন মণীশ মুকুল ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy