সিনিয়রদের কাছে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে আত্মঘাতী এক কলেজপড়ুয়া।
একটি গ্রামে আত্মঘাতী তিন কৃষক।
আবাসনের একটি ঘর থেকে উদ্ধার বৃদ্ধার ঝুলন্ত দেহ।
এই ধরনের খবর প্রায়শই দেখা যায় কাগজে। কিন্তু দিন ঘুরে গেলে তা মুছেও যায় হয়তো আমাদের স্মৃতি থেকে। কেউ ভাবি না যে, এই প্রত্যেকটি খবরে পরিণতি এক হলেও কারণ ভিন্ন। একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে বোঝা যায় যে, সকলে একই কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন না। কারও ক্ষেত্রে তা সামাজিক, কারও ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক এবং কিছু ক্ষেত্রে তা মানসিক অবসাদ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত। করোনা পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে বিভিন্ন কারণে। তবে তা রোধ করার পথও রয়েছে। সুইসাইড প্রিভেনশন মান্থে সে কথা ভাবার সময় এসেছে। ১০ সেপ্টেম্বর ছিল ওয়র্ল্ড সুইসাইড প্রিভেনশন ডে। কিন্তু একটি দিনেই এই আলোচনা শেষ হওয়ার নয়। বরং এ বিষয়ে আলোচনা জারি থাকলে হয়তো সুরাহা মিলতে পারে।
আত্মহত্যার কারণ কী?
কেস স্টাডি করলে বোঝা যায়, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কারণ ভিন্ন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবির মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘অবসাদ একটি কারণ, তবে একমাত্র নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পিছনে। অনেকে একাকিত্ব থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেন। আবার বেকারত্বও এর অন্যতম কারণ। রয়েছে অ্যাবিউসিভ সম্পর্কও। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন কেউ। আবার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে র্যাগিং ও বুলিংয়ের শিকার হলেও আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা যায়। তাই কারণ ধরে সমাধানের দিকে এগোতে হবে।’’
এ বিষয়ে সহমত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামও। তাঁর কথায়, ‘‘ডিপ্রেশনের জন্য আত্মহত্যার ঘটনা যেমন দেখা যায়, তেমনই সামাজিক কারণও গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক, দলিতরা কেন আত্মহত্যা করেন? নির্যাতিতারা কেন আত্মহত্যা করছেন? সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। তাই সুইসাইড প্রিভেনশন পলিসি থাকা দরকার। তা হলে ঠিক কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব।’’ সেই অনুযায়ী সুরাহাও মিলবে।
নজর রাখতে হবে
আশপাশের মানুষ বা বন্ধুবান্ধবের মনখারাপ থাকলে সেটা চোখে পড়ে। আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাই। তাই এড়িয়ে গেলে আর চলবে না। ‘‘কেউ যদি মুখে একবারের জন্যও বলেন যে, ‘আর বেঁচে থাকতে ভাল লাগছে না’ বা ‘আমাকে আর দরকার নেই’ তা হলে কিন্তু সেই মানুষটির প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা তাকে বকুনি দিই বা হাসি-মশকরায় ব্যাপারটা লঘু করে ফেলি। মনে রাখতে হবে, কেউ যখন বলছে, তখনই তিনি অবচেতনে সাহায্য চাইছেন। সেই সময়ে যদি আমরা সাহায্য না করি, তা হলে তিনি শেষ আশ্রয়টাও আর পাবেন না,’’ বললেন ডা. আবির মুখোপাধ্যায়। তাই ঠিক সে সময়ে যদি আমরা তাঁকে বোঝাই এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায়, তা হলে তিনি উপকৃত হবেন।
অনেকে হয়তো মুখে বলেন না। কিন্তু আচার-আচরণ পাল্টাতে থাকে। হয়তো একটা বন্ধু হঠাৎ গুটিয়ে যেতে শুরু করল। অনেকে দরজা বন্ধ করে নেশা শুরু করে দেন। এই ধরনের আচরণও কিন্তু ওয়ার্নিং সাইন।
তবে আমাদের দেশে এখনও ইমপালসিভ আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। আগে থেকে তাঁকে দেখে হয়তো সব সময়ে বোঝাও যায় না। তাই কাছের মানুষের আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে নজরে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কেউ ঘুমের ওষুধ জমাচ্ছেন কি না। কেউ যদি কখনও আত্মহত্যার চেষ্টা করে সফল না হন, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির পরবর্তী সময়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো চিকিৎসা প্রয়োজন। কারণ যিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তিনি কিন্তু পরেও সেই চেষ্টা করতে পারেন।
উপায় ও পথ
নেতিবাচক মনোভাব থেকেই আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কোনও ব্যক্তি। আত্মহত্যার কথা মাথায় এলে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. জয়রঞ্জন রাম। তাঁর কথায়, ‘‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বা শেষ কয়েকটা দিন হয়তো খুব খারাপ কেটেছে কারও। কিন্তু আগামী তো সুন্দর হতে পারে। এই অন্ধকার সময়ের রেশ তখন আর থাকবে না। তাঁর জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর কথা ভাবতে হবে। পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের কথা ভাবতে হবে। তিনি চলে গেলে তাঁর চারপাশের মানুষগুলোর কী হবে, ভাবতে হবে।’’ প্রয়োজনে কাছের বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন নিজের মানসিক স্থিতি বা সমস্যা নিয়ে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মনের কথা শেয়ার করতে না চাইলে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া সুইসাইড প্রিভেনশনের বেশ কিছু হেল্পলাইন নাম্বার আছে। সেখানে ফোন করতে পারেন।
কথা বলার সুবিধে অনেক। মন হাল্কা হয়। যিনি নিজে অন্ধকারে রয়েছেন, তিনি হয়তো বাইরের আলো দেখতে পান না। কিন্তু বাইরের কারও সঙ্গে কথা বললে, সেই আলোর পথ অন্য কেউ তাঁকে দেখাতে পারেন। ফলে আত্মহত্যার চিন্তা সরে যায়। নিজের সমস্যা থেকে বেরোনোর উপায়ও পেয়ে যেতে পারেন।
‘‘নেশা ছাড়তে হবে। বিশেষ করে অ্যালকোহল মানুষের চিন্তাভাবনার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। একজন ব্যক্তি হয়তো আত্মহত্যার কথা ভেবেও দ্বন্দ্বে রয়েছেন। নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে তাঁর সেই যুক্তিবুদ্ধি লোপ পায়। ফলে আত্মহত্যার পথ ও পদক্ষেপ ত্বরান্বিত হয়। তাই মানসিক সমস্যায় কোনও নেশা মারাত্মক,’’ বলে সতর্ক করলেন ডা. আবির মুখোপাধ্যায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আমরা খুব একটা ওয়াকিবহাল নই। সেটাও অন্যতম কারণ। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনই আমরাও কিছু পদক্ষেপ করতে পারি। কর্মক্ষেত্রে ও স্কুল-কলেজে র্যাগিং, বুলিং নিজেরা বন্ধ করতে পারি। কাউকে নিয়ে মজা করার সময়ে, বিপরীত পক্ষ সেই মজা নিতে পারছেন কি না, সেটাও মাথায় রাখা উচিত। বিশেষত বয়ঃসন্ধিতে ছেলেমেয়েদের চিন্তাভাবনা খুব পরিণত হয় না, সে সময়ে তারা খুব ভালনারেবল থাকে। ফলে মা-বাবার সঙ্গে ঝগড়া, প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া বা বন্ধুবান্ধবের মাঝে হেনস্থা হলে তারা আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেয়। তাই কমবয়সিদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও যত্ন প্রয়োজন।
তবে সমীক্ষা বলছে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের মধ্যেই আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই কখনও এমন চিন্তা মাথায় এলে সে বিষয়ে আলোচনা করুন, কথা বলুন, প্রয়োজনে সাহায্য চান। ডা. জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘যাঁরা আত্মহত্যা করেন, অনেকে মনে করেন তাঁরা দুর্বল। সেটা কিন্তু নয়। এই বিষয়ে আমাদের স্টিগমা কাটাতে হবে। আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তার জন্য নিজেকে দুর্বল ভাবা বা গ্লানি বোধ করার কারণ নেই। বরং ‘আমি ভাল নেই’ বলে সাহায্য চাইতেও সাহস দরকার। সাহায্য চাইতে যেন ইতস্তত বোধ করবেন না।’’ সাহস করে নিজের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুন। দেখবেন, আপনি বললে হয়তো আরও দু’জন নিজের কথাও বলতে পারেন। এ ভাবে সকলে মিলেই হয়তো একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
আমাদের মনোভাবে বদল আনাও জরুরি। মন খারাপ হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা শরীর খারাপের কারণ দেখিয়েই ছুটি নিই। উল্টো দিকে কর্মক্ষেত্রে মনখারাপের জন্য ছুটি পাওয়ার সুযোগ সে ভাবে থাকে না। কিন্তু ভেবে দেখলে শরীর খারাপ নিয়েও কিছুটা কাজ করা সম্ভব, কিন্তু মন খারাপে কাজে মনঃসংযোগ করা যায় কি? তাই সিক লিভের মধ্যে মেন্টাল ইলনেসকে আনা যেমন জরুরি, তেমনই বছরে একবার রুটিন চেকআপের সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বা স্ক্রিনিং দরকার বলে মনে করেন ডা. মুখোপাধ্যায়। এই পদক্ষেপ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্টিগমা কাটাতেও সাহায্য করবে।
নথিভুক্তকরণ প্রয়োজন
‘‘আগে আমাদের দেশে আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত। ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেও তা খুব বেশি নথিভুক্ত হত না। বিশেষ করে যাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেও সফল হতেন না, সেই ধরনের কেস রিপোর্ট হত না। কিন্তু এতে সমস্যা হল, পরেও তিনি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু প্রথম ক্ষেত্রে ব্যাপারটা রিপোর্ট না হওয়ায় কোনও সাহায্য তিনি পেলেন না। তবে এখন আত্মহত্যা থেকে ‘অপরাধ’এর (ডিক্রিমিনালাইজ়) তকমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই আত্মহত্যার ঘটনা রিপোর্ট হওয়া উচিত,’’ মত ডা. আবির মুখোপাধ্যায়ের। রিপোর্ট হলে সমস্যার গোড়ায় পৌঁছনো যাবে।
জীবনের কোনও সমস্যায় ভেঙে পড়বেন না। মনে রাখবেন, কোনও সমস্যাই স্থায়ী নয়। তাই জীবন শেষ না করে সমস্যা শেষ করার উপায় বার করুন। নিজের জীবনের সব ভাল লাগাগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করুন। দেখবেন, এ জগতের সৌন্দর্য থেকে আপনিও বঞ্চিত নন। আপনার প্রাপ্তির ঝুলিও হাল্কা নয়। তাই অন্ধকার নয়, বরং আলোর পথ বেছে নিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy