—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বালিশটা কিছুতেই কাছছাড়া করতে চায় না মিঠি। কেউ মাথা দেবে ভেবে আগেই জাপটে ধরে নরম বালিশটাকে। বাবা-মা কথা বললে বা কখনও একটু পাশাপাশি বসলেই সঙ্গে-সঙ্গে দু’জনকে ঠেলে ফাঁকে ঢুকে পড়ে জিনি। রাহুল সব কিছু অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেও লাল গাড়িটা দেয় না। কোনও বন্ধু নিলেও ঠোঁট ফুলে যায় ওর।শিশুদের নাম বদলে গেলেও ছবিগুলো বড্ড চেনা অভিভাবকদের। প্রথম চেনা পৃথিবী মাতৃগর্ভ। সেখান থেকে বেরিয়ে মায়ের গায়ের গন্ধ, কোল, এটুকুই বড্ড আপন হয় সন্তানের। এই চেনা পৃথিবীকেই আঁকড়ে ধরে সে। সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর পরিধি যদি না বাড়ে, আঁকড়ে থাকা, অধিকার বোধের মাত্রা যদি না কমে, তা হলেই চিন্তা। আমরা অভিভাবকেরা ভাবতে বসি, ‘ছেলেটা কি বড্ড পজ়েসিভ হয়ে গেল!’ ‘মেয়েটা কি ভাগ করে নেওয়া শিখছে না?’ ‘সন্তানের মধ্যে কি স্বার্থপরতা দেখা যাচ্ছে’, এমনই হাজার ভাবনা। কিন্তু ভেবে দেখুন, ছোটবেলায় আমরাও হয়তো এমনই ছিলাম।
ছোটদের ‘পজ়েসিভনেস’ বা অধিকারবোধ স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। প্রিয় জিনিস থেকে প্রিয় মানুষ, কোনওটাই সে ছোট্ট মুঠো থেকে ছাড়তে চায় না। কিন্তু শৈশবের একটা করে ধাপ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অধিকারের মাত্রাটাও কমার কথা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুটি যত সকলের সঙ্গে মিশবে, নতুন জিনিস দেখবে, তত ওর পৃথিবীটা বড় হবে। প্রত্যেকটা অচেনা জিনিস বা মানুষের সঙ্গেই যে ভয়ের, অজানার একটা সংযোগ থাকে, সেটা কাটিয়ে উঠবে সে। নিরাপত্তাহীনতা যত কমবে, তত কমবে আঁকড়ে ধরার প্রবণতাও।সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহা বললেন, ‘‘বাচ্চারা চেনা পৃথিবীর মধ্যে নিরাপদ অনুভব করে। এটা স্বাভাবিক। সেটা মানুষ, ঘর, খেলনা, বন্ধু, জামাকাপড় থেকে একটা বালিশ সবই হতে পারে। কিন্তু এটা থেকে বেরোতে না পারলে সমস্যা। বাচ্চা কাঁদছে বলে অনেকেই ঝট করে ওর চাহিদা মিটিয়ে দেন। প্রিয় জিনিসটা হাতে গুঁজে দিয়ে শান্ত করান। কিন্তু অচেনা জিনিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোটাও জরুরি। তা না হলে বাচ্চার আত্মবিশ্বাস আসবে না।’’ প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা করলে তাঁদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে শেখে শিশুরা। জোর করা ঠিক নয়। তবে যত দেখবে, যত আগ্রহ জন্মাবে ততই সুবিধে হবে, দাবি জলির।
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, “এই অধিকার বোধের ব্যাপারটা পাঁচ বছর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি থাকে। এটা দু’রকম হতে পারে। বস্তুর উপরে ও সম্পর্কের উপরে। সোজা কথায়, যেখানে ওদের আরাম, সেটা ওরা ছাড়তে চায় না। এখন বহু বাড়িতেই বাবা-মা দু’জনে চাকরি করেন, সন্তান গৃহসহায়িকার কাছে থাকে। তিনি যদি শিশুটির ছোটখাটো চাহিদা, আরাম ভাল বুঝতে পারেন, শিশু যদি তাঁর থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পায়, তা হলে সেখানেও জন্মায় অধিকারবোধ। এমনও দেখা যায়, বাবা-মা থাকলেও হয়তো সেই গৃহসহায়িকা ছাড়া চলছে না শিশুটির। আসলে ভরসার জায়গা হয়ে ওঠেন তিনি। তবে এ ক্ষেত্রে অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। সময় কাটাতে হবে সন্তানের সঙ্গে।”
অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের মধ্যে এক জনের প্রতিও ভীষণ পজ়েসিভ হয় সন্তান। বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখলে মাঝে ঢুকে পড়া, বড়রা কথা বলার সময়ে অহেতুক সেখানে কথা বলা, এগুলো সবই নজর কাড়ার চেষ্টা। প্রিয়জনকে অন্য কারও সঙ্গে দেখলে, তার একা লাগতে থাকে। আবার এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও সমস্যা হয় অনেক সময়। পায়েল জানান, যে অভিভাবকের কাছে কম ঘেঁষে সন্তান, তিনিও আবেগ দিয়ে ভাবতে শুরু করেন। সন্তানের সঙ্গে বুঝি ফাঁক তৈরি হচ্ছে, সন্তান বোধহয় তাঁকে ভালবাসে না, এমন ভাবনা মাথাচাড়া দেয়। এ ক্ষেত্রে অভিভাবককে এ সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বুঝতে হবে এটা সাময়িক। বেশি আবেগপ্রবণ না হয়ে সন্তানকে একটা পদ্ধতির মধ্যে ফেলতে হবে। নতুন জিনিস দেখিয়ে, আগ্রহ বাড়াতে হবে। ওর গণ্ডিটা বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে হাতের মুঠো খুলে দু’হাত ছড়িয়ে দিতে পারে ভরসা করে।
বাবা-মায়ের মধ্যে যাঁর উপরে সন্তানের নির্ভরতা বেশি, তাঁকে কিছু ক্ষেত্রে সরে গিয়ে অন্যকে জায়গা দিতে হবে। নয়তো একটা সময় নিজেরই অসন্তোষ তৈরি হবে। ‘বাচ্চা সব সময় আমাকেই জডিয়ে থাকে’ থেকে ‘কেন কোল থেকে নামছে না, কেন কারও কাছে যাচ্ছে না’, এই ভাবনা এসে যাবে। সন্তানের ঘুমের সময়ে, স্কুলে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও দু’জনে ঘুরিয়েফিরিয়ে সময় দিতে পারলে ভাল হয়। এক জনের উপরে নির্ভরতা কমবে।
এ ছাড়া পজ়েসিভনেস কাটাতে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, মেলামেশা বাড়ানো জরুরি। হয়তো সব সময় বাইরে, পার্কে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তখন বাড়িতে ডাকতে হবে বন্ধুদের। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আপনার সুসম্পর্ক ওর মনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ওর আরাম, নিরাপদ অনুভব করার পরিধিটাও বাড়বে। আমাদের চারপাশে এখনও যে হাত বাড়ালেই বন্ধু, বুঝে যাবে সে। হারানোর ভয়কে হারিয়ে রোদ-বৃষ্টি ধরতে ছুটবে খুদে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy