বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চে যা বলা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে সৎকারের কাজ হয়। ছবি: পিটিআই।
সংক্রামক কোভিড-১৯-কে ঘিরে আতঙ্ক মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রোগী ও তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা আসছেন, তাঁদের নিয়ে যেমন ভয়, তেমনই আশঙ্কা মৃতদেহ নিয়েও। পাড়া দিয়ে, রাস্তা দিয়ে শববাহী গাড়ি গেলেও আতঙ্কে ভুগছেন এলাকাবাসী। তার উপর মৃতদেহ সৎকারে অংশ নেওয়া এক জনের শরীরে জীবাণুর হদিশ পাওয়ার পর যেন আগুনে ঘি পড়ে।
ভয়ের উৎস
কোভিডে মৃত মানুষের দেহে ভাইরাস কত ক্ষণ থাকে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত খবর এখনও জানা নেই গবেষকদের। আর এই অজানা ক্ষেত্রই বেশি করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এর আগে ইবোলা সংক্রমণের বেলায় কিন্তু মৃত মানুষের দেহ থেকেও সংক্রমণ ছড়াত।
মৃতদেহ নিয়ে যাঁদের কাজ, মর্গের বা শ্মশানের কর্মী, তাঁদের অনেকেরই টিবি, ভাইরাল হেপাটাইটিস, এইচআইভি, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি অসুখ হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ওই সব রোগে মৃত মানুষের দেহ ঘাঁটাঘাঁটির ফলেই অনেক সময় এ রকম হয়।
আরও পড়ুন: বাড়তি ওজন থাকলে কোভিড-১৯-এ ভয় কতটা? অসুখ এড়াবেন কী কী উপায়ে?
গত ১২ এপ্রিল ‘জার্নাল অব ফরেনসিক ও লিগাল মেডিসিন’-এ একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। পত্রলেখক জানান, তাইল্যান্ডে এক ফরেন্সিক চিকিৎসক-পরীক্ষক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। পত্রলেখকের দাবি ছিল, ওই চিকিৎসকের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়েছে মৃতদেহ থেকে। ঠিক তার ১০ দিন পর ব্যাঙ্ককের ‘আরভিটি মেডিক্যাল সেন্টার’ ও চিনের ‘হাইনান মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি’-র দুই চিকিৎসক সেই চিঠির সংশোধন করে জানান, বিষয়টা ঠিক তা নয়। সংক্রমণ কোথা থেকে এসেছে, তা জানা নেই। কিন্তু তত ক্ষণে ভয় যা ছড়ানোর তা ছড়িয়ে পড়ে।
পিপিই না পরে মৃতদেহের কাছে যাওয়ার নিয়ম নেই। ছবি: এএফপি।
সত্যি কতটা ভয়ের?
চিকিৎসকদের নিয়ে তৈরি সরকার নিযুক্ত অডিট কমিটির সদস্য ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চে যা বলা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে কাজ হয়। পিপিই, গগলস, গামবুট পরে মৃতদেহের পরীক্ষা চালান চিকিৎসকরা। যাঁরা দেহ সৎকার করছেন, তাঁরাও যথাযথ পোশাক পরছেন। মৃত্যুর পর রোগীর কান-নাক বা স্যালাইন গোঁজা জায়গা থেকে অনেক সময় ফ্লুইড বেরতে পারে। যে কোনও সংক্রামক রোগে মৃত্যু হলেই এই ফ্লুইডে জীবাণু থাকে। তাই তাঁর নাক-কানে তুলো দেওয়া হয়। সব ক্ষত এক শতাংশ সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে জলনিরোধী ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়। ফলে শরীরের ফ্লুইড কোনও ভাবেই বাইরে বেরতে পারে না। আত্মীয়স্বজন কাউকে মৃতদেহের কাছে আসতে দেওয়া হয় না, তাঁরা আবেগপ্রবণ হয়ে দেহকে ছুঁয়ে ফেলতে পারেন ভেবেই। মৃতদেহ থেকে আজ পর্যন্ত কোথাও কোনও সংক্রমণ ছড়ায়নি।’’
সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীও। তাঁর কথায়: ‘‘মৃতদেহ সৎকারের কর্মী আর পাঁচ জনের মতোই অন্য কারণে সংক্রামিত হয়েছেন। তাঁর অন্য কোনও উৎস থেকে সংক্রমণ হতে পারে। যে ভাবে আটঘাট বেঁধে নিয়ম মেনে কাজ করা হয়, তাতে মৃতদেহ থেকে সংক্রামিত হওয়ার কোনও ঘটনা এখনও ঘটেনি এবং আশঙ্কাও একেবারে নেই বললেই চলে। এখানে একটা ভুল ধারণা ঠিক করে দেওয়া দরকার। অনেকে ভাবেন কোভিডে মারা গেলে কবর দেওয়াই নিরাপদ। তা কিন্তু নয়। নিয়ম মেনে দাহ করলেও কিন্তু কোনও অসুবিধে নেই।”
আরও পড়ুন: করোনা-হানায় মহিলাদের তুলনায় পুরুষরাই বেশি মারা যাচ্ছেন কেন?
সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “রাস্তা দিয়ে, পাড়া দিয়ে শববাহী গাড়ি গেলে, অশান্তি করার কোনও মানে নেই. কোনও যুক্তিও নেই। দেহ না ছুঁলে কোনও ভয় থাকে না। শ্মশানে কোভিড রোগী এলে আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। শুধু একটু দূরে দূরে থাকুন, তা হলেই হবে। কবর দেওয়ার পর বা চুল্লিতে দাহ করার পর বাতাসে, পরিবেশে কোথাও জীবাণু থাকে না।’’
কোন নিয়মে দাহ?
• মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যেতে ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে চার জনের দরকার হয়। কাজেই শুধু চার জনই থাকেন। তার মধ্যে দু’জন হাসপাতাল কর্মী, দু’জন সৎকারকর্মী। পিপিই পরানো হয় তাঁদের। পুরো শরীর ঢাকা জলনিরোধক অ্যাপ্রন, এন ৯৫ মাস্ক, গ্লাভস, চশমা, বিশেষ জুতো তাতে অবশ্যই থাকে।
• মৃতদেহ থেকে সব টিউব, ড্রেন, ক্যাথেটার খুলে ঢাকা দেওয়া নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলে শরীরের সব ক্ষত এক শতাংশ সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে জলনিরোধী ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয় যাতে শরীরের কোনও তরল চুঁইয়ে আসতে না পারে।
• মুখ-নাক-কান ও আরও যে যে জায়গা থেকে তরল বেরতে পারে তা তুলো দিয়ে বন্ধ করে লাগানো হয় লিউকোপ্লাস্ট।
• মৃতদেহে এক শতাংশ হাইপোক্লোরাইড স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করা হয়। তার পর ভরা হয় প্লাস্টিকের লিকপ্রুফ ডেডবডি ব্যাগে। যাকে ক্যাডাভার ব্যাগও বলে। চেন বন্ধ করে আবার এক শতাংশ হাইপোক্লোরাইড স্প্রে করা হয় ব্যাগের সর্বত্র।
দাহকার্যে অংশ নেওয়া সকলকেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেতে হয় নির্দিষ্ট মাত্রায়।
• এর পর আত্মীয়দের মধ্যে এক জন বা দু’জনকে পুরো পিপিই পরিয়ে মৃতদেহ দেখানো হয়। দেখানো বলতে চেন খুলে শুধু মুখটুকু দেখানো, তা-ও বেশ খানিকটা দূর থেকে। ছোঁওয়া একেবারে বারণ। এ জন্য মৃতের আত্মীয়দের ভাল করে কাউন্সেলিং করে নিতে হয়। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লে সামলাতেও হয় তাঁদের।
• দেখানোর পর্ব শেষ হলে ব্যাগটিকে কফিনে ভরে, ঢাকা আটকে আবার এক শতাংশ হাইপোক্লোরাইড স্প্রে করে কফিন জীবাণুমক্ত করা হয়।
• কবর দেওয়ার প্রশ্ন থাকলে ৬ ফুট গভীর করে গর্ত কেটে তার মধ্যে কফিন নামিয়ে কফিনের উপর পুরু করে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে তার পর মাটি বা সিমেন্ট দিয়ে দেওয়া হয়।
• দাহ করতে গেলে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢোকানোর ঠিক আগে দেহ বিবস্ত্র করে ঢোকানোর নিয়ম। সে ক্ষেত্রে সৎকারকর্মীরা যেহেতু সবাই পিপিই পরে থাকেন, মৃতদেহে হাত লাগালে তাই কোনও সমস্যা হয় না। বাড়ির কেউ যদি শেষযাত্রার সঙ্গী হতে চান, হতে পারেন। তবে তাঁকে ৬-৮ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে থাকতে হবে। পিপিই সমেত অন্যান্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাও নিতে হয়।
• প্রথা মেনে চিতাভস্ম ও অস্থি বাড়ির লোক নিতে চাইলে কোনও অসুবিধে নেই। তাতে জীবাণু থাকে না। অত তাপমাত্রায় পোড়ার পর ভাইরাসও শেষ হয়ে যায়।
• সব মিটে যাওয়ার পর পিপিই খুলে এক শতাংশ হাইপোক্লোরাইড দ্রবণে ৩০-৩৫ মিনিট ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করে তবে তাকে নষ্ট করতে হয়।
• চার জন শববাহককে এর পর ভাল করে সাবান দিয়ে স্নান করে ১৪ দিনের জন্য কোয়রান্টিনে যেতে হয়। সঙ্গে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেতে হয় নির্দিষ্ট মাত্রায়। তবে ওষুধ খাওয়ানোর আগে ইসিজি করে দেখে নেওয়া দরকার তাঁর হার্টে কোনও গোলমাল আছে কি না। থাকলে শেষযাত্রায় তাঁকে সঙ্গীই করা হয় না। স্বাস্থ্য ও পুলিশ বিভাগের কর্তাদের উপস্থিতিতে পুরো কাজটা হয়। কাজেই জীবাণু ছড়ানোর কোনও প্রশ্নই থাকে না।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy