কেকের মিলমিশে সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্য প্রত্যয়ের। নিজস্ব চিত্র।
নতুন পোশাকের উপর অ্যাপ্রন চাপিয়ে, দু’হাতে গ্লাভ্স গলিয়ে বাদাম, মোরব্বা ও টুটি ফ্রুটির টুকরোগুলি কমলালেবুর রস দিয়ে মাখতে মাখতে শিশুর মতো অনাবিল আনন্দে হেসে উঠলেন তাঁরা। কারও মনে পড়ল ছেলেবেলার স্মৃতি, কেউ হয়তো মনে করলেন আপনজনকে। কমলার গন্ধে ম ম করা সকালে একমুঠো দমকা বাতাস মুছিয়ে দিল মনোরোগী আবাসিক ও বাইরের দূরত্ব। বৃহস্পতিবার সকালে কেক মিক্সিং-এর আসর বসেছিল প্রত্যয়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতর ও স্বাস্থ্য দফতরের সহায়তায় চলা মনোরোগীদের জীবন সহায়তা কেন্দ্র ‘প্রত্যয়’। পোশাকি নাম ‘হাফওয়ে হোম’।
পাভলভ বা লুম্বিনী মানসিক হাসপাতালে মনের অসুখ সারিয়ে যাঁরা পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যেতে পারেননি, অথবা সমাজ যাঁদের আপন করে নেয়নি, তাঁদেরই ঠাঁই দেয় প্রত্যয়। এখানকার আবাসিকরা সমাজের মূলস্রোতে ফেরার চেষ্টা করছেন অসম্ভব এক মনোবলকে পুঁজি করে। প্রত্যয় তাঁদের কাছে নিছক মাথা গোঁজার আশ্রয় নয়, এখানেই তাঁরা নতুন করে গড়ে তুলেছেন সখ্য, অভ্যাস হয়েছে নতুন এক যৌথ যাপনের। রাজ্য সরকারের সহায়তায় ও ‘অঞ্জলি’-র চেষ্টায় এ সব মানুষকে সমাজে মূল ধারায় ফিরিয়ে দেওয়াই হল উদ্দেশ্য। ‘কেক মিক্সিং’ তারই এক প্রয়াস মাত্র। শহরের আর পাঁচটা নামী ক্লাব, বিলাসবহুল হোটেলের ‘কেক মিক্সিং’-এর সঙ্গে প্রত্যয়ের কেক মেশানোর আসরের আকাশপাতাল তফাত। নিছকই আনন্দঘন কোরাস নয়, সমাজের দুই প্রান্তকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও বটে।
প্রত্যয়ীদের অভিভাবক মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “মনোরোগ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে পুনর্বাসনের পথটা বড়ই দীর্ঘ। ক্লান্তি মুছে হেঁটে যেতে যে শক্তি চাই, তাই জুগিয়ে চলেছে প্রত্যয়।” রত্নাবলীর কথায়, “সমাজ যাঁদের গায়ে ‘মনোরোগী’ তকমা সেঁটে বিভাজনের প্রাচীর তুলে দিয়েছে, তাঁদের নিয়েই সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গড়ে তোলাই লক্ষ্য প্রত্যয়ের। এর পিছনে কোনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই, প্রচারের অভিপ্রায়ও নেই। ছোট ছোট এই আনন্দ আয়োজনগুলি সেতুবন্ধন করে। ওঁরাও সমাজের আর পাঁচজন মানুষকে দেখে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করেন। এইটুকুই মনোবল জোগায়। তা ছাড়া কে কোন কাজে দক্ষ, নানা কর্মশালার মাধ্যমে তা-ও বুঝে নেওয়ার চেষ্টা হয়।” মানসিক রোগের একটি বড় অভিঘাত হল নিজের পরিচয় গুলিয়ে ফেলা। মানসিক হাসপাতালে রোগীদের পরিচয়হীনতাই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সেই পরিচয় দেওয়ারই চেষ্টা করে। কেবল সমাজে পুনর্বাসন দেওয়া নয়, মনোরোগ সারিয়ে ওঠাদের কর্মক্ষম করে যোগ্য করে তোলাও লক্ষ্য।
প্রত্যয়ের বাকি আবাসিকদের মতো অ্যাপ্রন ও গ্লাভ্স পরে কেক মেশানোর আসরে যোগ দেননি সিদ্ধান্ত। তাঁর কাজ বাড়ির দেখাশোনা করা। কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে, সব দিকেই সতর্ক নজর। কথাবার্তা স্পষ্ট ও সাবলীল বছর একত্রিশের যুবকের। বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। অথচ বছর দুয়েক আগে তাঁর ঠিকানা ছিল পাভলভ মানসিক হাসপাতাল। জটিল মনোরোগ স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া পরিবার থেকে আলাদা করেছিল। সিদ্ধান্ত এখন সুস্থ। বললেন, “ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত। কিন্তু কোনও সমস্যা নেই। বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। এখন মিন্টো পার্কে ছোটখাটো একটা চাকরি করি। প্রত্যয়ের দেখাশোনাও করি।” প্রত্যয় থেকে বেরিয়ে নিজের নিরাপদ আশ্রয় নিজেই খুঁজে নিয়েছেন সিদ্ধান্ত। সাবলম্বী হয়ে ওঠার লড়াইয়ে পাশে পেয়েছেন তাঁরই মতো কয়েক জন প্রত্যয়ীকে।
প্রত্যয়ের আবাসিকদের নিয়ে আশাবাদী রত্নাবলী। তিনি বললেন, ‘‘মনোরোগের প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার যে ধাঁচা, সমাজবিচ্ছিন্নতা তার অন্যতম শর্ত। ফলে, চিকিৎসকের মতে কোনও মনোরোগী যখন সুস্থ, হাসপাতালে থাকার আর কোনও প্রয়োজন নেই তাঁর, তখন তিনি তাঁর চেনা পরিবেশ থেকে পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ফলে শুধু পরিবারের কাছে তাঁকে পৌঁছে দেওয়াটাই কাঙ্ক্ষিত সমাধান হতে পারে না। তাঁর অধিকার ও অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। আর সেটা আমরাই করি। সরকারি বা বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই আপাত ভাবে যে কোনও প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন মানুষকে কাজে নেওয়ার ব্যাপারে লিখিত আইন, নীতি এগুলি সবই আছে। কিন্তু সেগুলি কতটা বাস্তবায়িত হয়, সে নিয়ে সংশয় আছে। সমাজের একাংশ মনে করে, মনোরোগ সারিয়ে ওঠারা কাজকর্মের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারণা একেবারেই সেকেলে। প্রত্যেয়ের আবাসিকরা তা প্রমাণ করেছেন।”
মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতা এক জন মানুষের অধিকারকে সীমিত করার কোনও কারণ হতে পারে না, এমনই মনে করেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনিও। অনুত্তমা বললেন, “প্রত্যয়ের একেবারে গোড়া থেকে দেখছি, যে সব মানুষ হাসপাতালের ঘেরাটোপে ছিলেন, তাঁরা এখন নিজেদের জীবন এবং জীবিকার পথ নির্বাচন করছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাই এই উদ্যাপন কেবল কেক মিক্সিং নয়, বরং সমাজে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনাও। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নিঃসন্দেহে খুব বড় পদক্ষেপ।”
সারা বছরই নানা কর্মশালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রত্যয়। চলে শিল্প প্রদর্শনীও। সেরামিক ওয়ার্কশপ গত বছর থেকেই শুরু হয়েছে। শিল্পী অনিন্দ্য হাজরা, কল্লোল দত্তরা হাত মিলিয়ে এগিয়ে এসেছেন ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকদের নিয়ে কাজ করতে। মূলত সেরামিকের কাজ, ব্লক প্রিন্টের কাজ শেখান তাঁরা। অনিন্দ্যর কথায়, “আমাদের মতো ক্যুয়র শিল্পীরা সমাজের সঙ্গে এক সরলরেখায় চলে না। এই জ্যামিতিক নকশা খুবই জটিল, অনেকগুলি স্তরে বিভক্ত। সেখানে কখনও আমরা নিজেদের খুঁজে পাই, আবার কখনও নয়। শহরের এই যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, তার ভিতরে ও বাইরে আমাদের জায়গা ও গ্রহণযোগ্যতা কতটা, সেটা বোঝা খুবই দরকার ছিল। নানা ধরনের আইন ও নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল পেরিয়ে সমাজের মূলধারায় মিশে যাওয়ার পথটা সহজ নয়। সেখানেই সমাজের এই প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে আমরা নিজেদের মিল খুঁজে পাই। তারাও এই সমাজে ব্রাত্য, আবার আমাদের মতো রূপান্তরকামী মানুষজনদেরও সমাজ সেই ভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই দু’দিকেই চলছে। আর সেখানেই মিলে গিয়েছে দুই পথ। আর সে থেকেই একসঙ্গে পথ চলার শুরু। নিজেদের প্রান্তিক অবস্থানের অভিজ্ঞতাকেই শৈল্পিক ভাবনায় ফুটিয়ে তুলছি আমরা।”
সমাজের চেনা পরিসরগুলির বাইরেও অন্য পরিসর রয়েছে। সমাজ সেই সত্তাকে সাবলীল ভাবে গ্রহণ করতে চায় না অনেক ক্ষেত্রেই। অনিন্দ্যর বক্তব্য, সেই পরিসরের বাসিন্দারা তখনই পরিচিত অভ্যাসের অন্দরে আসবেন, যখন দরজা খুলে দেওয়া হবে। আর এই কাজ করতে গেলে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান দিলেই হবে না, সহনাগরিকদের মনকেও সেই ভাবে তৈরি করতে হবে। তা হলেই বিভাজন ঘুচবে। প্রত্যয়ের অন্দরে নিরন্তর সেই চেষ্টাই চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy