যে ছবি আসলে কোনও শিল্পী আঁকেননি, তা-ও তৈরি করে দিচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স! এমনই নানা ধরনের ছবি তৈরি হচ্ছে প্রযুক্তির সাহায্যে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছবির জগতেও পড়ছে প্রযুক্তির ছায়া। সেই ছায়ার আড়ালে কি চাপা পড়ে যেতে পারে শিল্প? সৃজনশীল মনের সামনে কি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কম্পিউটারের মাউস?
কলকাতার নানা প্রান্তে সম্প্রতি দেখা গিয়েছে ভ্যান গঘের সূর্যমুখী, তারায় ভরা রাতের ঝলক। তবে যে সব ছবি যাতায়াতের মাঝে চোখে পড়েছে, তার সবটাও ভ্যান গঘের নয়। একঝলক দেখায় মনে হবে অন্যের ছবিতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছে নামী শিল্পীর পরিচিত পেন্টিংয়ের কিছু টুকরো। এবং সেটিই ঘটনা!
সম্প্রতি ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজ়নেস সামিট’-এর হোর্ডিং নজরে নিশ্চয়ই পড়েছে অনেকের। সে সব হোর্ডিংয়েরই ছবির কোথাও আছে ডাচ শিল্পী ভ্যান গঘ বা স্পেনের সালভাদর ডালির ছোঁয়া। কোথাও স্পষ্ট বাংলার পটচিত্রের প্রভাব। তবে সব ছবিই নতুন করে তৈরি। পরিচিত শিল্পীর পুরনো কাজ হুবহু তুলে বসিয়ে দেওয়া হয়নি। দেখেশুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, এ হচ্ছেটা কী!
যে বিস্ময়সূচক প্রশ্নের উত্তর ধাবিত হয় ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে। এ প্রশ্নের সরণিও সেই রোমে গিয়েই মিশেছে। এআই যেমন কঠিন ধাঁধার উত্তর সহজে বলে দিচ্ছে, যে মানুষ আদতে কোথাও নেই, তাকে তৈরি করে টিভিতে খবরও পড়াচ্ছে, তেমনই যে ছবি আসলে কোনও শিল্পী আঁকেননি, তা-ও তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে অনেক সময়ে চেনা ছবিও চেনা থাকছে না আর। আবার নতুন ছবি তৈরি হলেও তাতে থেকে যাচ্ছে পরিচিত শিল্পের ছোঁয়া।
কিন্তু আগে তো শিল্পী বরাত পেতেন। তবে ছবি হত। এখন কি সে সবের বালাই থাকবে না আর? তবে কি শিল্পীদের পেশাগত জীবন বদলে দিচ্ছে এআই? বদল যে ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে তাতে নতুন ধরনের কাজের সুযোগও বাড়ছে বলে অভিমত অনেকের। রং-তুলিতে হয়ত কোনও কোনও কাজের ক্ষেত্রে জোর কমছে। তবে কম্পিউটারে ছবি বানাতে জানলে সে কাজের জোগান বাড়ছে। শহরের এক বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার উজ্জ্বল সিন্হাও সে রকমই বলছেন। তাঁর সংস্থার নানা কাজে ব্যবহার করা হয় এআই-এর তৈরি ছবি। উজ্জ্বলের কথায়, ‘‘প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন ছবি তৈরি করতে পারা হল এক নতুন ক্ষমতা। এর জন্যেও দক্ষতা লাগে। প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, তা কী ভাবে কাজে লাগানো যাবে, তা-ও তো জানার বিষয়।’’ উজ্জ্বলের বক্তব্য স্পষ্ট— শিল্প বদলাচ্ছে না। শিল্পীদের কাজও কমছে না। বরং শিল্পীর কাজের ধারা বদলাচ্ছে। শিল্প পাচ্ছে নতুন মাত্রা।
কিন্তু এমন ব্যবস্থায় কি ‘প্রথাগত’ ধারায় কাজ করা শিল্পীরা সঙ্কটের আভাস দেখছেন? বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং থেকে ছবির পোস্টার, সর্বত্র যে ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রযুক্তির দ্বারা নির্মিত ছবি, তাতে শিল্পীদের নিজের কাজের ধরনও বদলাতে হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। শিল্পী জয়া গঙ্গোপাধ্যায় কার্যত ‘লড়াই’ হিসাবেই দেখছেন বিষয়টিকে। তাঁর কথায়, ‘‘যে থাকবে, সে থাকবে। দেখা যাক না! আমরা কাজ করি। প্রযুক্তিও কাজ করুক।’’
প্রবীণ শিল্পী বিমল কুন্ডু আবার বিষয়টিকে অন্য ভাবে দেখছেন। প্রযুক্তির সঙ্গে কোনও সমরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না তিনি। কারণ, তাঁর বক্তব্য, অন্য লোকে ভ্যান গঘের ছবির কয়েক টুকরো ব্যবহার করলেও সে ছবি ভ্যান গঘেরই থাকে। অন্য কারও হয়ে যায় না। তিনি বলেন, ‘‘যাঁর ছবিতে ভ্যান গঘের সূর্যমুখী ব্যবহার করা হল, সেই শিল্পীর নাম জানেন কি? কিন্তু ভ্যান গঘের নামটাই আসছে তো বার বার? মৌলিক কাজের কোনও বিকল্প হয় না। যামিনী রায়ের ছবি তো এক কালে প্রযুক্তির সাহায্যে শাড়ি থেকে চায়ের কাপ, সবেতেই ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে কি যামিনী রায়ের ছবি অন্য কারও হয়ে গিয়েছে? ছবি তো তাঁরই থেকেছে। ফলে শিল্পীর কদর অত সহজে কমে না।’’ শিল্পী পরেশ মাইতিও এ বিষয়ে খানিকটা একমত। তিনিও ছবি তৈরির মাধ্যম বা পদ্ধতির চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন শিল্পীর ভাবনার দিকে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভাবনাটাই তো আসল। একই বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী দু’জন শিল্পী থাকলেও তাঁদের ভাবনার প্রকাশ আলাদা আলাদা হয়। দু’জন এক জায়গায় থাকছেন, একই খাবার খাচ্ছেন। অথচ যখন পাহাড় আঁকছেন, দু’জনের ছবি একেবারে আলাদা হবে। আর তাতেই প্রত্যেকের কাজ স্বতন্ত্রতা ধারণ করে।’’ ফলে প্রযুক্তির ব্যবহারে ছবি ‘তৈরি’ হোক বা ‘হাতে আঁকা’, পরেশ মনে করেন শিল্পের মাধ্যম সময়ের সঙ্গে বদলালেও শিল্পীর কদর কমার নয়।
ক্যামেরা আবিষ্কারের পরে কি আর হাতে আঁকা ছবির কদর কমে গিয়েছে? প্রশ্ন তুলছেন নবীন শিল্পী সুমন চন্দ্র। বরং ক্যামেরা তৈরির পর থেকে বাস্তবধর্মী ছবি নতুন আঙ্গিক পেয়েছে। সুমনের বক্তব্য, ‘‘এআই তো মানুষেরই তৈরি। তারও সীমাবদ্ধতা থাকবে। তা থেকে বার করতে সেই মানুষের বুদ্ধিই লাগবে। শিল্পীর ভাবনা ছাড়া তো কাজ হবে না।’’ যদি প্রযুক্তির বৃদ্ধি কাজে কোনও বাধা তৈরি করে, তবে তার থেকে বেরোনোর পথও শিল্পীরাই খুঁজে বার করবেন বলে অভিমত তাঁর। অর্থাৎ, প্রযুক্তির কারণে সৃজনশীলতার সংজ্ঞা বদলালেও সৃজনশীল মনের গুরুত্ব কমবে বলে মনে করেন না শিল্পীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy