কলকাতার অফিস পাড়াগুলোর জিভে জল আনা খাবার নিয়ে উৎসবের আসর। —নিজস্ব চিত্র।
কোথাও তারস্বরে চিৎকার, “লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম মাত্র তিরিশ।“ কোথাও লুচির ডেসিবেল ছাপিয়ে প্রচার কলাপাতায় দেওয়া চাউমিনের। পাশ থেকে আবার চাট মশলার ঘরে ভিড় টানতে বিস্তর হাঁকাহাঁকি। ২২ ফেব্রুয়ারি, শনিবার রাতে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স লাগোয়া লয়ন্স রেঞ্জে একটুকরো অফিস পাড়ার দুপুর চেখে এল শহরবাসী। সৌজন্যে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স (বিসিসি)।
দুপুর হলেই অদৃশ্য অ্যালার্ম বেজে ওঠে কলকাতার নানা এলাকায়। হাঁড়ি-কড়া-খুন্তির ব্যস্তবাগীশ শব্দের সঙ্গে যোগ হয় লোকজনের ভিড়, হাঁকডাক, হাতা-চামচের ঠোকাঠুকি, তেল-মশলার অনুপান। পরিচিত নাম কলকাতার অফিস পাড়া। এ বার এই অফিস পাড়ার খাবারদাবারের ঐতিহ্য তুলে ধরতেই এগিয়ে এল বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স। লয়ন্স রেঞ্জ— অর্থাৎ স্টক এক্সচেঞ্জের রাস্তা থেকে বেঙ্গল চেম্বারে যাওয়ার রাস্তায় এই অফিস পাড়ার খাবারদাবার নিয়েই শনিবার একটি গালা স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করল তারা। শুধু ওটুকুই নয়, ১৫০ জন খাদ্যবিক্রেতাকে নিয়ে গত চার দিন ধরে চলল রান্নার নানা কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ।
পুরুলিয়ার ছৌ নাচ, বাউল গান ও রূপঙ্করের একক অনুষ্ঠান ছিল শনিবারের উৎসবের উপরি পাওনা। এ দিন ফুড ফেস্টিভ্যালের সূচনা করেন বিসিসি-র মিউজিক-মিডিয়া কমিটির প্রধান অরিন্দম শীল এবং সিএসআর কমিটির প্রধান জিতেন্দ্র কুমার।
আরও পড়ুন: মিষ্টি একেবারে বাদ নয়, বরং এ সব উপায়ে খেয়ে ওজন রাখুন বশে
এই উপলক্ষে শনিবার সন্ধেয় পথেও নামলেন বিসিসি-র কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত শিল্পী ও খাদ্যব্যবসায়ীরা। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স থেকে ‘ক্যালকাটা গ্যালারি’ ছুঁয়ে জিপিও হয়ে লয়ন্স রেঞ্জ পর্যন্ত চলল এই ‘হেরিটেজ মার্চ’। ফেস্টিভ্যালের শেষে বিক্রি, পরিচ্ছন্নতা, স্বাদ-সহ নানা বিভাগে পুরস্কৃতও হলেন খাদ্যব্যবসায়ীরা।
আসলে কলকাতার অফিস পাড়াগুলো দুপুরে একটা নিজস্ব স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বাঁচে। ডাল-ভাত-ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন-লিট্টি-পাওভাজি-খিচুড়ি-বেগুনিকে মিশিয়ে দেওয়ার চরিত্র। সারা দেশকে এক জায়গায়, থুড়ি, একথালায় হাজির করার স্বভাব। মন্টুদার চা, দিলীপদার মোগলাই, পুরনো রাইটার্সের গলির দিনুদার লিট্টি-আলুচোখার হাতছানিতে যেন নতুন করে চাগিয়ে ওঠে খিদে। স্বাদ ও দামে পুরোটাই সাম্যবাদ। উপরতলার বাবু থেকে নিচুতলার কেরানি— সকলের জন্যই এক স্বাদ, এক পকেটসই দাম।
আরও পড়ুন: ঘন ঘন মাথা ধরে? এই সব ঘরোয়া উপায়েই ব্যথাকে করুন জব্দ
তবে এই ফুড ফেস্টিভ্যালে চেনা দিনের খাবারগুলোকেই একটু অন্য ভাবে রাঁধলেন খাদ্যবিক্রেতারা। না, রেসিপিতে কোনও পরিবর্তন নেই, বদল কেবল রান্নার মাধ্যমে। কয়লার উনুন নয়, পরিবেশ বাঁচাতে বরং ইন্ডাকশন আভেনেই রাঁধলেন সকলে। সাজপোশাকও ছিল অন্য রকম, শেফ ক্যাপ, অ্যাপ্রনে কে বলবে লালবাজারের গলির দিনুদা কোনও নামী রেস্তরাঁর শেফ নন! লম্বা টেবিলে সার দিয়ে সাজানো অফিস পাড়ার হরেক খাবার। ফিশ ফ্রাই থেকে লিট্টি-চোখা, চাউমিন থেকে ধোসা সকলেই তৈরি। দামও একেবারে রোজের মতোই। ১০ টাকার জিলিপি থেকে ১০০ টাকার বিরিয়ানি— ভিড় কিন্তু সব স্টলেই! চেটেপুটে খেয়ে পেট ভরাতে ব্যস্ত বহু মানুষ। শনিবারের সন্ধের টিফিন অনেকেই সারলেন এখানে। ‘‘খাদ্যরসিক বাঙালিকে অফিস পাড়ার খাবার বললেই, যে সব পদের কথা মনে আসলে তারা সবাই দেখছি এক ছাদের তলায় হাজির! তাই এ সুযোগ আর ছাড়িনি।’’ —ঝালমুড়ির ঠোঙার শেষ বাদামটুকু খুঁজতে খুঁজতে জানালেন গড়িয়াহাট থেকে আসা সৌমাভ সেন।
“ফুচকা আর বিরিয়ানি, কলকাতায় সকলের আগে শেষ হবেই। এখানে এসেও দেখছি একই ব্যাপার!”— মোবাইলে সহকারীকে আরও এক হাঁড়ি বিরিয়ানি দ্রুত স্টলে দিয়ে যাওয়ার নির্দেশের মাঝেই কথাগুলো বলে হেসে উঠলেন লালবাজার এলাকায় ৩৫ বছর ধরে বিরিয়ানি বিক্রি করে আসা শম্ভু দাস।
উপরতলার বাবু থেকে নিচুতলার কেরানি— সকলের জন্যই এক স্বাদ, এক পকেটসই দাম। —নিজস্ব চিত্র।
কর্পোরেট দুনিয়ায় কাজ করতেন আগে।কিন্তু অফিস পাড়ার খাবার চেখেছেন নাকি তখন? “আরে হ্যাঁ, সে কত! অফিস পাড়ার খাবার মানেই নস্টালজিয়া। সেই জন্যই তো সাবেক রেস্তোরাঁ ছেড় আমরা অফিস পাড়ার খাবার নিয়ে এত কিছু ভাবলাম।’’ —সহাস্য স্বীকারোক্তি অরিন্দম শীলের।
তবে চেম্বার অব কমার্সের এই উদ্যোগে কলকাতার সব অফিস পাড়াকে জোড়া সম্ভব হয়নি। বরং আদি অফিস পাড়া হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ডালহৌসিকে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি বা সিএসআর উদ্যোগে এই খাদ্য উৎসব ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি কলকাতা কর্পোরেশনের সাহায্যে কলকাতার সব রকম অফিস পাড়ার খাবারেই আরও পরিচ্ছন্নতা, উন্নত রান্নার পদ্ধতি যোগ করতে চাইছেন বিসিসি-র কর্মকর্তারা। পরিবেশ বাঁচাতে কয়লার উনুন বাদ দিয়ে কোনও ভাবে ইন্ডাকশনের জোগান দেওয়া যায় কি না, তেল-মশলাগুলো ব্যবহারে আরও একটু সচেতনতা বাড়ানো যায় কি না ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই অদূর ভবিষ্যতে ভাবা হবে বলে জানালেন বিসিসি-র ডিরেক্টর জেনারেল শুভদীপ ঘোষ। তাঁর মতে, ‘‘যাঁদের হাতে এত সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতার অফিস পাড়ায়, তাঁদের সুরক্ষা, তাঁদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার জন্য আমরা আরও নানা পদক্ষেপ করব। কী ভাবে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাদের আরও উন্নতি সাধন করা যায় এবং আমাদের প্রিয় শহরকেও দূষণমুক্ত রাখা যায় তা আমাদের ভাবনায় রয়েছে।’’
শুধু স্বাদ ও পরিবেশের কথাই তাঁরা ভেবেছেন এমন নয়। অফিস পাড়ার খাবারে য়ে সব মহিলারা অংশ নেন, কেউ সব্জি কাটেন, কেউ তা ধুয়ে দেন, কেউ আবার হাত পুড়িয়ে রাঁধেনও। তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভেবেছে বিসিসি। সিএসআর কমিটির প্রধান জিতেন্দ্রবাবুর মতে, ‘‘মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে আমরা অনেক কথাই বলি। লিখি। কিন্তু সমাজে খেটে খাওয়া শ্রমিক মহিলারাও যে তার মধ্যে পড়েন তা অনেক সময়ই ভুলে যাই। ক্ষমতায়ন মানে কিন্তু শুধুই ব্যাগ কাঁধে অফিস নয়। তাই অফিস পাড়ার খাবারে যুক্ত মহিলাদের নিয়েও আমরা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করব।’’
তত ক্ষণে অবশ্য পেঁয়াজির অর্ডার সামলাতে মাথায় শেফের টুপি এঁটে, আরেক দফা বেসনে পেঁয়াজ মেশাচ্ছেন টি বোর্ডের সামনে চপের দোকানের মালকিন সোনারপুরের মানদা হাজরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy