বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে সব রোগগুলির সূত্রপাত হয়, তার মধ্যে ইউরিনের সমস্যা অন্যতম। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে এই সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রস্রাব পেলে ধরে রাখতে না পারা, হওয়ার সময়ে জ্বালা-যন্ত্রণা, অল্প অল্প করে ইউরিন হওয়া, তলপেটের নীচে ব্যথা... অনেক সময়ে জ্বরও হয়, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বেরোয়, যেটিকে হেমাচুরিয়া বলা হয়— কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা এগুলোকে বয়সজনিত সমস্যা বলে ধরে নিই। মনে করি, জল বেশি করে খেলে ঠিক হয়ে যাবে। এই আপাত গুরুত্বহীনতাই কিন্তু ডেকে আনতে পারে বিপদ।
বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট ডা. পৃথ্বীরাজ ঘোষাল বলছেন, ‘‘আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সচেতনতার মাত্রা এতই কম যে, উপসর্গগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বেশি বয়সে ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডার কমন অসুখ কিন্তু অনেক সময়েই প্রস্টেট ক্যানসার বা ব্লাডার ক্যানসারের উপসর্গগুলো একই ধরনের হয়। তাই কোনও সমস্যা হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করাই একমাত্র উপায়। কয়েকটি টেস্টেই রোগ নির্ধারণ করা সম্ভব।’’
হেমাচুরিয়া
ইউরিন সংক্রান্ত যে সমস্যায় বয়স্ক মানুষেরা ভোগেন তার মধ্যে হেমাচুরিয়া একটি। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত নির্গত হওয়াই হেমাচুরিয়া। ‘‘অনেকে ভাবেন শরীর গরম হয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, তা নয়। এটি সিরিয়াস সমস্যা। ব্লাডার ক্যানসারের কারণেও রক্ত বেরোতে পারে,’’ বলছেন ডা. ঘোষাল।
নানা কারণে প্রস্রাবে রক্ত বেরোয়। তার সঙ্গে ব্যথা, যন্ত্রণা, জ্বালাও হতে পারে। ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশনও এর কারণ হতে পারে। ডায়াবেটিক পেশেন্টদের এই ধরনের ইনফেকশনের সম্ভাবনা বেশি। ইউরিন পরীক্ষায় ইনফেকশন ধরা পড়লে, ট্রিটমেন্ট করলে সেরে যায়। কিডনি বা প্রস্রাবের রাস্তায় পাথর জমে থাকলেও রক্ত বেরোতে পারে। এর সঙ্গে ব্যথা-যন্ত্রণা হতে পারে, না-ও পারে।
বিনাইন প্রস্থেটিক হাইপারপ্লেসিয়া, অর্থাৎ বয়সের সঙ্গে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বেড়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রেও গ্ল্যান্ড থেকে রক্ত বেরোতে পারে। এর জন্য ওষুধ আছে। ইউরোলজিস্ট পৃথ্বীরাজ ঘোষাল বলছেন, ‘‘কয়েকটি জিনিস আমরা হেমাচুরিয়া পেশেন্টদের ক্ষেত্রে দেখে থাকি। ইউরিনের সাইটোলজি পরীক্ষা করে প্রস্রাবের ভিতরে কোনও ক্যানসার সেল আছে কি না, সেটা দেখা হয়। সিটি স্ক্যান, ইউএসজি, সিস্টোস্কোপির মাধ্যমেও রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। কী কারণে রক্ত বেরোচ্ছে জানা গেলে, ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারবেন চিকিৎসক।’’
ব্লাডার ক্যানসার
হেমাচুরিয়ার সঙ্গে ব্লাডার ক্যানসারের যোগসূত্র রয়েছে। এই রোগেও ইউরিনের সঙ্গে রক্তপাত হতে পারে। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়ছে কিন্তু ব্যথা, জ্বালা, যন্ত্রণা নেই। এই রকম ক্ষেত্রে মানুষ সেটাকে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু একবার রক্ত বেরোলে বুঝতে হবে, এটা অ্যালার্ম। সে কারণেই চিকিৎসকেরা আগাম সতর্ক হতে বলেন।
দু’ধরনের ব্লাডার ক্যানসার হয়। সুপারফিশিয়াল ব্লাডার ক্যানসার। ব্লাডারের গায়ে নানা জায়গায় টিউমর হওয়া। অনেক সময়ে তা মাইক্রো সার্জারি করে বাদ দিলেও, আবার ফিরে আসে। এটি যাতে বারবার না হয়, তার জন্য প্রস্রাবের থলির ভিতরে কিছু ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম বিসিজি ভ্যাকসিন, যেটি সদ্যোজাত শিশুদের টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত হওয়া আটকানোর জন্য দেওয়া হয়। তাতে টিউমর ফিরে আসার সম্ভাবনা খানিক কমে যায়, তবে একেবারে নির্মূল হয় না। ‘‘এই সুপারফিশিয়াল ক্যানসার হচ্ছে মন্দের ভাল। আর সবচেয়ে খারাপ হল, ব্লাডার ছাড়িয়ে শরীরের অন্যত্র ক্যানসার সেল ছড়িয়ে পড়া। এতে জীবনের আশঙ্কা রয়েছে। চিকিৎসা পদ্ধতিও জটিল হয়ে পড়ে। প্রস্রাবের থলি কেটে বাদ দিয়ে, খাদ্যনালির মধ্য দিয়ে প্রস্রাবের রাস্তা তৈরি করতে হয়। তা ছাড়া কেমোথেরাপি-সহ অন্যান্য ট্রিটমেন্টও রয়েছে,’’ মন্তব্য চিকিৎসক পৃথ্বীরাজ ঘোষালের। এই সমস্যাগুলি মূলত বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
ধূমপানের সঙ্গে প্রস্রাবের অসুখ জড়িত
ধূমপান করলে ফুসফুসের ক্ষতির কথাই সকলে জানেন। কিন্তু এতে কিডনি এবং ব্লাডার ক্যানসারও হতে পারে। এ ধরনের বহু কেস রয়েছে। কিন্তু আমজনতার মধ্যে এ সংক্রান্ত সচেতনতা কম। বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ডা. ঘোষাল— সিগারেটের ধোঁয়ায় কিছু বিষ থাকে, সেই ধোঁয়া ফুসফুস থেকে রক্তে যায়। শরীর এই বিষ রক্ত থেকে ছেঁকে বার করে পাঠিয়ে দেয় কিডনিতে, যাতে তা ইউরিনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ ভাবেই কারসিনোজেন জমা হয় মূত্রথলিতে, যা ব্লাডার ক্যানসারের অন্যতম কারণ।
প্রস্টেট ক্যানসার
পুরুষদের মধ্যে প্রায়ই প্রস্টেট ক্যানসার দেখা যায়। প্রথম দিকে উপসর্গ থাকে না বললেই চলে। থাকলেও তা বিনাইন প্রস্থেটিক হাইপারপ্লেসিয়া উপসর্গের মতোই। তাই একটা বয়সের পরে নিয়মিত চেকআপ জরুরি। বিশেষত যদি পরিবারে প্রস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকে। রক্তে পিএসএ (প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন) পরীক্ষা করা যায়। ইউরোলজিস্টেরা প্রস্টেট গ্ল্যান্ড পরীক্ষা করে বলতে পারেন কোনও টিউমর হচ্ছে কি না। এমআরআই-সহ অন্যান্য পরীক্ষা করেই রোগ নির্ণয় করা যায়। ‘‘আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে হরমোনের ইমব্যালান্সের জন্য প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি কম-বেশি সব পুরুষেরই হয়। কিন্তু একই ধরনের উপসর্গ ক্যানসারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সে কারণেই নিয়মিত চেকআপ করা জরুরি,’’ পরামর্শ ডা. ঘোষালের। অনেক সময়ে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশেও এই রোগ দেখা যায়। তবে মূলত পঞ্চাশ বছরের পরেই এই রোগ বেশি দেখা যায়।
অন্যান্য জটিলতা
ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডার (ওএবি), বয়সের সঙ্গে প্রস্রাবের থলির ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া। বারবার টয়লেট পাওয়া, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, হাঁচি-কাশির সময়ে প্রস্রাব বেরিয়ে আসা... এ ছাড়া ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশনের সমস্যা তো আছেই। এই সমস্যাগুলো আবার মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। পেলভিক মাসলের কিছু ব্যায়াম আছে, সেগুলো করলে উপকার পাওয়া যাবে।
অনেক সময়েই জল বেশি খাওয়াকে চিকিৎসার অঙ্গ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞেরা সমস্যা এবং বয়স বুঝে জল খাওয়ার নিদান দেন। দেখতে হবে রোগীর অন্য কোনও অসুখ আছে কি না। বয়স বেশি হলে ব্লাডারের হোল্ডিং ক্যাপাসিটি কমে যায়। তখন অতিরিক্ত জল, মানেই বারবার প্রস্রাব পাওয়া।
ইউরিন সংক্রান্ত রোগ থেকে মুক্তি পেতে গেলে, সমস্যা অবহেলা না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করাই শ্রেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy