বাড়ির বৃদ্ধ সদস্য হঠাৎ কি একটু বেশি ভুলে যাচ্ছেন? সকালে কী খেয়েছেন জিজ্ঞেস করলে বলছেন, ‘খেতেই তো দাওনি তোমরা...’ বা বাজারে যা আনতে পাঠানো হয়েছিল, সেটি না নিয়েই ফিরে আসছেন? উপসর্গগুলি নজর করার মতো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ব্যক্তির স্মৃতির সমস্যা বাড়ে। কিন্তু ষাটের ঊর্ধ্বে যাঁদের বয়স, তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যার শুরু হয় এ ভাবেই।
অ্যালজ়াইমার্স এক ধরনের ডিমেনশিয়া। বলা যায়, ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে চেনা রূপ এই রোগ। যার শুরু হয় স্মৃতির সমস্যা দিয়ে। ধাপে ধাপে রোগটি জাঁকিয়ে বসে ও রোগীর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাই রোগের লক্ষণ চিনে নেওয়া প্রয়োজন। এর একটি দিক কগনিটিভ ডিক্লাইন, অন্যটি আচরণগত সমস্যা।
কগনিটিভ ডিক্লাইন
প্রথম পর্যায়: ফোন নাম্বার মনে রাখতে না পারা, জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা, দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধে।
দ্বিতীয় পর্যায়: বাজার করতে অসুবিধে, অফিসের কাজকর্মে সমস্যা। অবসরের পরে হয়তো দেখা যেতে পারে, অফিসে কর্তাব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সাধারণ হিসেবনিকেশে সমস্যা হচ্ছে তাঁর। খেয়াল করার বিষয়, এই কাজগুলির কোনওটিই তাঁর কাছে নতুন নয়।
তৃতীয় পর্যায়: কোনও কাজ নিয়ে বেরিয়ে, সেটি না করে ফিরে আসা। তাঁকে যদি বলাও হয়, বিষয়টি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হন না রোগী। বরং ‘তাঁর কোনও সমস্যা নেই’, সেটা বোঝাতেই মরিয়া হয়ে ওঠেন।
রোগ অনেকটা বেড়ে গেলে: বাড়ি থেকে বেরিয়ে না ফেরা। শার্টের বোতাম আটকাতে, চুল আঁচড়াতে সমস্যা হওয়া। ঘড়ি-পেন জাতীয় বস্তুগুলির নাম না বলতে পারা।
মানুষ চিনতে না পারা: রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রথমে আত্মীয়স্বজন ও পরে পরিবারের সদস্যদের চিনতে পারেন না রোগী।
এই ধরনের উপসর্গগুলি রোগীর বাড়ির লোক বা তাঁদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কেয়ার-গিভাররা অনেক সময়ে হয়তো বুঝতে পারেন না। ফলে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়ে যায়। পরে রোগীর আচরণগত সমস্যা দেখে পরিবার সজাগ হয় ও বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে আসে।
আচরণগত সমস্যা
বহিরঙ্গে পরিবর্তন: কথাবার্তা না শোনা, ভায়োলেন্ট হয়ে যাওয়া, খামখেয়ালিপনা বেড়ে যাওয়া, রাতে না ঘুমোনো।
অন্তরঙ্গে পরিবর্তন: নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, গুমরে থাকা, চনমনে ব্যক্তির হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া। এই ধরনের উপসর্গের সঙ্গে ডিপ্রেশন অনেক সময়ে গুলিয়ে যায়। তবে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিলে তাঁরা এই পার্থক্যটা বুঝতে পারেন।
স্মৃতিলোপের ধরন: রোগী সাম্প্রতিক অতীত থেকে ভুলতে শুরু করেন। সকালে কী খেয়েছেন বা আগের দিন কী করেছেন, তা মনে থাকবে না। তবে চাকরিতে কবে যোগ দিয়েছেন, প্রথম সন্তান কবে হয়েছে, এই ধরনের সুদূর অতীতের গুরুত্বপূর্ণ দিনের কথা তাঁর মনে থাকবে।
জিনের ভূমিকা: পরিবারে অ্যালজ়াইমার্সের ধারা থাকলে, সেই পরিবারের সদস্যদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
অ্যালকোহল ও ড্রাগজনিত ডিমেনশিয়া: দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল পান করলে ডিমেনশিয়া হতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোগীর আগের স্মৃতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না। স্ট্রোক, পারকিনসন্স ডিসিজ় থেকেও ডিমেনশিয়া হতে পারে। তবে এগুলি অ্যালজ়াইমার্স নয়।
মস্তিষ্কের যে ভেন্ট্রিকল দিয়ে সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুয়িড প্রবাহিত হয়, সেই ভেন্ট্রিকলের সাইজ় বড় হয়ে গেলে, পাশের টিসুগুলির উপরে চাপ পড়ে। এর ফলে ডিমেনশিয়া হয়। তবে এই ফ্লুয়িড বার করে নিলে রোগী আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন।
কিছু কিছু ওষুধও কগনিটিভ ডিক্লাইনের জন্য দায়ী। সে ক্ষেত্রে ওষুধ বদলে রোগীর অবস্থার পরিবর্তন করা যায়।
অ্যালজ়াইমার্স সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার অভাবে এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় অসুবিধের সৃষ্টি হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় তার একটা রূপরেখা দিলেন—
• কলকাতায় বৃদ্ধ দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের সন্তান বাইরে থাকেন। সে ক্ষেত্রে দম্পতির একজন এই রোগে হয়তো আক্রান্ত হলে, অন্য জন ভাবেন তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে আচরণগুলি করছেন। বার্ধক্যের ছেলেমানুষি বলেও এড়িয়ে যেতে পারেন।
• ডিমেনশিয়ার পুরোপুরি নিরাময় এখনও অবধি আবিষ্কৃত নয়। ওষুধ দিয়ে রোগীর অবস্থার পরিবর্তনের গতিকে মন্থর করা যায় মাত্র। কখনও আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যায় না। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই রোগের নির্ণয় হওয়া খুব জরুরি।
• বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আচরণগত সমস্যার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করা হয় না। কারণ এতে অন্য সমস্যা বাড়ে। পারিপার্শ্বিক কারণেও আচরণগত সমস্যা বাড়ে। রোগীকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করুন।
• স্মৃতির সমস্যা হয় বলে পুরনো ছবি দেখানো, খবরের কাগজ পড়তে উৎসাহিত করা, মানসিক ব্যায়ামে অভ্যস্ত করালে রোগীর পক্ষে ভাল।
• যে রোগীদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তাঁদের ঘরে তালা দিয়ে রাখলে তাঁরা আরও বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে কম্বিনেশন লক দিয়ে যদি তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হয়, তিনি হয়তো ওতেই ব্যস্ত হয়ে যাবেন। বাইরেও যেতে পারবেন না।
• পেশাদার কেয়ার-গিভারদের এই রোগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা ও রোগীকে সামলানোর প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। সহানুভূতি নয়, চাই সহমর্মিতার হাত। সমালোচনা কম করে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করা জরুরি। এই কাজ নেহাত সহজ নয়।
• রোগীকে বাইরে নিয়ে গেলেই তিনি ভায়োলেন্ট আচরণ করবেন, এটি ভ্রান্ত ধারণা। মাঝেমধ্যে শপিং মলে নিয়ে যাওয়া, হাঁটাতে নিয়ে যাওয়া... এই ধরনের অভ্যেস রোগীদের জন্য উপকারী।
• এই ধরনের রোগীর শারীরিক সমস্যাগুলির প্রতিও ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। হঠাৎ করে আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিলে শারীরিক কারণগুলিও খতিয়ে দেখা উচিত।
• অনেকের ধারণা, নিকোটিন অ্যালজ়াইমার্স নিরাময়ে সাহায্য করে। তবে এটি ভুল।
বলা হয়, সময়ের চেয়ে বড় ওষুধ হয় না। তবে অ্যালজ়াইমার্স রোগীদের চাহিদা বুঝে তাঁদের আলাদা করে বেশি সময় দিতে বোধহয় আমরা সবচেয়ে অবহেলা করি। তাই রোগের ধরন বুঝে রোগীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরুন।
মডেল: ভারতী লাহা, অঙ্কিতা মজুমদার পাল; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল মেকআপ: চয়ন রায়; পোশাক: আনোখি, ফোরাম মল
লোকেশন: লাহাবাড়ি, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy