Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
বেরিয়ে আসুন অসুস্থ সম্পর্ক থেকে। এ জন্য দরকার সচেতনতা
Toxic Relationship

গ্যাসলাইটিং: সতর্ক হন মানসিক নির্যাতন থেকে

অনেক সময় একের অন্যকে অহেতুক দোষারোপ করার অভ্যেস অথবা নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়ে অন্যের আত্মবিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা।

An image of Depression

—প্রতীকী চিত্র।

ঐশী চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ০৮:২৫
Share: Save:

‘বলেছিলাম, তুমি বাজার করতে পারবে না। সেই হিসেবে গরমিল করলে!’ বরের এমন কথা রোজ শুনতে শুনতে রিমা বিশ্বাসও করলেন, তিনি হিসেবে ভুল করেন। অথচ, তিনি অঙ্কের শিক্ষিকা!

আবার, বিশ্বাসের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে সাগ্নিকের। কলকাতার নামী কলেজে বরাবর প্রথম হয়ে এসেছে মেধাবী ছেলেটি। চেয়েছিল, কলেজ-শেষে ভাল চাকরিতে ঢুকবে। কিন্তু তার প্রিয় বন্ধুর মতে, সাগ্নিক কখনও ভাল চাকরি পাবেন না। ভাল ইংরেজি বলতে না পারলে চলে না কি! বন্ধুর কথা শুনে তার মনোবল ভেঙে যায়। অন্যরা বোঝালেও সে ভাবে, বন্ধু-ই ঠিক বলছে।

সমস্যা যেখানে

এই ধরনের ঘটনা আপাত ভাবে আমাদের সকলের খুবই পরিচিত। রাস্তা-ঘাটে, ট্রামে-বাসে আমরা দেখি, যে কোনও সম্পর্কেই কারণে-অকারণে খিটিমিটি লেগে থাকে। অনেক সময় সেটির কারণ, একের অন্যকে অহেতুক দোষারোপ করার অভ্যেস অথবা নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়ে অন্যের আত্মবিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। অন্যকে দমিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টাটির মধ্যে আদতে লুকিয়ে থাকে নিছক ক্ষমতা জাহির করার অভিপ্রায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন সম্পর্কে কোনও এক জনকে প্রতিনিয়ত কটু কথা শোনানো, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা তাঁর মানসিক ভারসাম্য নিয়ে তাঁকে সংশয় প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়, তখন সেই মানসিক নির্যাতনকে ‘গ্যাসলাইটিং’ বলা হয়।

বস্তুত, ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডে মঞ্চস্থ ‘গ্যাস লাইট’ নামে একটি নাটক ও ১৯৪৪-এ একই নামে একটি আমেরিকান চলচ্চিত্র থেকে আসে এই শব্দটি। দৈনন্দিনের প্রতি পদক্ষেপে ভালবাসার মানুষটির দ্বারা কী ভাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এক মহিলা, কী ভাবে শুধু কথার প্যাঁচে পড়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার আত্মবিশ্বাস, এমনটাই দেখানো হয়েছিল নাটক ও চলচ্চিত্রটিতে। কী ভাবে একই কথা নানা ভাবে বলে মহিলা চরিত্রটিকে বিশ্বাস করানো হচ্ছে যে, সে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে, সেটাই দেখানো হচ্ছে চলচ্চিত্রে। গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার ওই মহিলাটিও ক্রমে মেনে নেয়, সে ‘পাগল’ হয়ে যাচ্ছে।

বাস্তবেও গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার যাঁরা, তাঁরা এমনই কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। যেমন—

  • তাঁদের প্রতি পদক্ষেপে নজরদারি চালানো হয়।
  • ছলে-বলে-কৌশলে নির্যাতিতের সব কাছের মানুষদের থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা হতে পারে।
  • জনসমক্ষে ‘মজার ছলে’ তাঁর চরিত্র বা অভ্যাসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও যেন অস্বাভাবিক নয়!
  • প্রতিনিয়ত নির্যাতিতের ভাবনাকে ভুল বা কাল্পনিক বলে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
  • কথা না মানলে সম্পর্ক ভাঙার ভয় দেখানো।

এই সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন যাঁরা হচ্ছেন, তাঁরা হয়তো নিজেরা বুঝতেই পারেন না এগুলি আসলে গ্যাসলাইটিং। আর এই নির্যাতন কোনও বয়স বা লিঙ্গ বিশেষ মেনে হয় না। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, অভিভাবক-সন্তান, ঊর্ধ্বতন-অধস্তন কর্মী, এমনকি বন্ধুদের মধ্যেও এই ধরনের সমস্যা থাকতে পারে।

শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করা গেলেও, মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। ফলে, তা যে ঘটছে, এ কথা মানতে সময় ও শ্রম বেশি লাগে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম ও আবীর মুখোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছেন, বহু সময় নির্যাতিতের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলেও বিষয়টি তিনি মানতে চান না। এর নেপথ্যে থাকে তথাকথিত কাছের মানুষটির প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বাস। নির্যাতিত গোড়াতেই মেনে নেন, ভালবাসার মানুষটি তাঁর ভালর জন্যই সব বলছেন। উল্টে, তাঁর মনে হতে থাকে, সমস্যাটা নিজেরই। বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে বছর ৩৫-এর মিতার সঙ্গে কথা বলে। তিনি জানাচ্ছেন, একটা সময়ে মেনে নিয়েছিলেন তাঁর চাকরির জন্যই মেয়ে নাকি পরীক্ষায় কম নম্বর পাচ্ছে। শ্বশুর, শাশুড়ি এমনটা বললেও মিতা তা প্রথমে মানেননি। কিন্তু বরও যখন একই কথা নির্জনে, পরিবার ও বন্ধুদের সামনে বলতে থাকেন, তখন ক্রমাগত গুটিয়ে যান মিতা। সন্তানের মুখ চেয়ে কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু এতে মেয়ের নম্বর তো বাড়লই না, উল্টে তিনি ক্রমশ দৈনন্দিন কাজে উৎসাহ হারাতে থাকলেন। তলানিতে ঠেকল আত্মবিশ্বাস। চেপে ধরল মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ। এক সময় তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করলেন। অবশেষে, মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্যে কিছুটা নিস্তার পান এই সমস্যা থেকে।

সমাধান কোথায়

গ্যাসলাইটিংয়ের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ হল ‘টক্সিক’ সম্পর্কটির থেকে বেরিয়ে আসা, মত বিশেষজ্ঞদের। আবীর জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালবাসার, ভরসার মানুষটির উপরেই আঙুল ওঠে, যা প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করে মেনে নেওয়াটা খুব কঠিন। জয়রঞ্জনের পর্যবেক্ষণ, বহু ক্ষেত্রে নতুন করে সম্পর্কটিকে ‘টেকানোর’ বা ‘গোছানোর’ প্রবণতাও দেখা যায় নির্যাতিতের মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কিছু বিষয়ে সচেতন হলে এই ধরনের মানসিক নির্যাতনের বিষয়ে নিজেকে সতর্ক রাখা যেতে পারে। কোনও ভাবে এর শিকার হলে সময়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসাও সম্ভব হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে:

  • মেলামেশা করতে হবে সকলের সঙ্গে। যত বেশি ধরনের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে যোগাযোগ থাকবে, তত বেশি মানব-চরিত্র বোঝা সহজ হবে।
  • ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে বন্ধুবৃত্তটি পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেওয়া দরকার। তাতে খারাপ সময়ে প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী চিনে নেওয়াও সহজ হয়ে উঠবে।
  • যদি কেউ সব সময় আপনাকে ছোট করেন, আপনার প্রতি পদক্ষেপে বাধা দেন আপনার ‘ভাল’ চেয়ে, তবে অবশ্যই তলিয়ে ভাবতে হবে।
  • ‘আমি কিছু পারি না’ ভেবে প্রিয়জনকে নিজের কাজের উপরে প্রতিনিয়ত নজরদারি চালাতে দেওয়াও পরবর্তীতে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
  • যদি প্রিয়জনের আচরণে মনে কোনও রকমের সংশয় জন্মায়, মনে হয় নিজের উপরে বিশ্বাস কমে যাচ্ছে, তবে তা নিয়ে অন্যের মতামত নেওয়াও জরুরি। এই অন্যটি হতে পারেন কোনও কাছের মানুষ।

পরিশেষে খেয়াল রাখা জরুরি, যদি মনে হয় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছেন, বা অবসাদ, উদ্বেগের মতো চিন্তাধারা ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে, তবে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Toxic Relationship Depression
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy