Advertisement
E-Paper

‘কান্ট রিড বাংলা’! গর্বভাষা, লজ্জাভাষা, দাপুটে ভাষা, বাতিল ভাষা!

নগরবৃত্তের জনপরিসরে বাংলা ভাষা নিয়ে এত কুণ্ঠা, এত লজ্জা, এত অপমান, এত সংশয়— সেটা থেকেই বোঝা যায় বাংলাভাষীরাই আজ ভাষা থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ‘বাংলা’, ‘বাঙালি’ উন্মাদনা সে জন্য পীড়া দেয়।

বাংলাভাষীরাই ভাষা থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন!

বাংলাভাষীরাই ভাষা থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন! গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।

অভীক মজুমদার

অভীক মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫৯
Share
Save

মাঝেমাঝে মনে হয় ‘কান্ট রিড বাংলা’ বলে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর দলে ভিড়ে যেতে পারলে ভালই হত। কলকাতা শহরের বিদ্বজ্জন এবং ‘মেধাজীবী’ মহলে সকলে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখত, সেন্টার যাদবপুর কিংবা এলিট জেভিয়ার্সে একটু কল্কে পাওয়া যেত! আজ ২১ ফেব্রুয়ারি, বিভিন্ন চিন্তাচর্চার মোড়ে ধুতি-শাড়ি, হাতপাখা, মোয়া, নলেন গুড়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-সহ ভাষণ-সাক্ষাৎকার হবে। টিভি, রেডিয়ো, সমাজমাধ্যম আলো করে বসবেন মহালেখকেরা, ভাষাচুঞ্চুরা— তার পরে সবাই হাততালি দিতে দিতে বাড়ি ফিরবেন। আর বাড়ি ফিরেই কত দ্রুত এবং কার্যকর পদ্ধতিতে পরের প্রজন্মকে বাংলা ভুলিয়ে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করবেন। জয় গুরু!

এক বার একুশে ফেব্রুয়ারির একটা মিছিলে হাতে হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল বাংলা বর্ণমালা। শেষে বড় একটা ফেস্টুন। লেখা ছিল, ‘বাংলার জীবন, বাঙালির জীবন: বাংলা বর্ণমালা’। হঠাৎ দেখলাম আমাদের এক রসিক বন্ধু, তিনি নামজাদা দারু-শিল্পীও বটে, ‘ম’ আর ‘দ’ বর্ণ দুটিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে পিছনে হাঁটছেন। মুখে বলছেন, ‘‘বাংলা! বাংলা! বাংলা চাই!’’ তা দেখে নীতিবাগীশেরা হুলস্থুল ঘটালেন! মিছিল প্রায় ভেস্তে যায় আর কী!

আমি কিন্তু এ সবে আর— হলফ করেই বলছি— কষ্ট পাই না। মজাই লাগে। কারণ, একটা জাতি কেমন অবলীলায় নিজের ভাষা-হত্যা দেখছে, হাসছে, ঘরে-ঘরে তাতে যোগ দিচ্ছে এবং ফুর্তি বাড়িয়েই চলেছে। এটা দেখে কার না নৃশংস আমোদ হয়? আমার অন্তত হয়। বাবুরা সব একজোট হয়ে কত যুক্তি দিয়ে প্রাইমারি থেকে ইংরেজি তুলে দিলেন। সে বহু যুগ হয়ে গেল। কিন্তু তার পরে ‘কাজের ভাষা’ বাংলা আর করলেন না। সম্ভবত ভুলে গেলেন। সেই থেকে বাংলা ভাষা দুয়োরানি। যত দিন গেল, বাংলা কোণঠাসা হতে লাগল। কেন না রুটি-রুজিতে বাংলা নেই কোথাও!

স্বনামধন্য মৃণাল সেন ‘ইন্টারভিউ’ নামের এক ছায়াছবিতে ব্যঙ্গ-খোঁচায় প্রশ্নটা তুলেছিলেন। শহর থেকে সরকারি উদ্যোগে সাহেব শাসকদের মূর্তি উৎখাত করে গাদা করে ফেলা হচ্ছে। উপনিবেশের প্রভুদের নিশ্চিহ্নকরণ যেন নতুন যুগের সূচনা ঘটাচ্ছে। ডি-কলোনাইজ়েশন। তার পরে চাকরির ইন্টারভিউয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যাওয়ায় বাতিল হচ্ছেন আবেদনকারী যুবক। এই ভণ্ডামির দেশ বাংলা তথা কলকাতা। আজও বহাল আছে সেই ট্র্যাডিশন। বঙ্গবাসী, বঙ্গভাষী মানেই তো ‘নির্জীব’! আবার ইংরেজি ফিরে এল, কিন্তু তত ক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক।

সারা বছর বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমরা থাকি অসাড়, উদাসীন, অনুভূতিহীন!

সারা বছর বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমরা থাকি অসাড়, উদাসীন, অনুভূতিহীন! ছবি: সংগৃহীত।

লক্ষ করবেন, বিমান অথবা ট্রেনের টু-এসি বা ফার্স্ট ক্লাসে কেউ ভুল করেও বাংলা বই খোলেন না। শুনেছি, বাংলা বই হাতে থাকলে নাকি মান-সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায়। ইদানীং দেখছি, বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা জিজ্ঞেস করলে জানান, তাঁদের বিষয় ‘বেঙ্গলি অনার্স’। এই যে নগরবৃত্তের জনপরিসরে বাংলা ভাষা নিয়ে এত কুণ্ঠা, এত লজ্জা, এত অপমান, এত সংশয়— সেটা থেকেই বোঝা যায়, বাংলাভাষীরাই আজ ভাষা থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ‘বাংলা’, ‘বাঙালি’ উন্মাদনা সে জন্য পীড়া দেয়। লক্ষ করবেন, সারা বছর বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমরা থাকি অসাড়, উদাসীন, অনুভূতিহীন— হঠাৎ উদ্‌যাপনের হুল্লোড়ে ওই দিন সক্রিয় হয়ে উঠি। মেট্রোয় অন্য ভাষা ঠিকঠাক, অথচ বাংলায় ভর্তি বানান ভুল, বাক্য ভুল। শহরের হোর্ডিং জুড়ে বানানের গঙ্গাযাত্রা। বইপত্র রাজনৈতিক পুস্তিকা, ইস্তাহার, হ্যান্ডবিল দেখলে বাংলা ভুলে যেতে ইচ্ছে করে। বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাচর্চায় অনীহা এবং অপার অবহেলা। বাংলা বিজ্ঞাপনে বাক্য-বানান-শব্দে অসীম ভ্রান্তিবিলাস!

শহর কলকাতার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ‘সপ্রতিভ’ সাক্ষাৎকারের দিকে তাকালে মনে হবে, বাংলা ভাষা আদতে দু’-একটি ভাঙা ভাঙা বাক্য এবং শব্দ... বাকিটা ইংরেজি! শুনেছি অনেকের বাংলা সংলাপ রোমান হরফে লিখে দিতে হয়। অবশ্য রুপোলি পর্দার দেবদূত-পরীদের একা দোষ দিলে কী হবে, শোনা যায় বাংলা বহু গীতিকার নাকি গান লেখেন ওই রোমান হরফে! ইদানীং মোবাইল, ল্যাপটপ এবং অন্তর্জাল-সমাজমাধ্যমের রমরমা! সেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা বানানের অবিরাম যে ব্যবহার দেখা যায়, তাকে ‘হার্টের জন্য বিপজ্জনক’ বলা ছাড়া গতি নেই! অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রে অবশ্য এতটা হয়নি। এটা বোধ হয় বাঙালির ‘জাতিগত’ বৈশিষ্ট্য। বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষাচর্চা, বাংলা সংস্কৃতি-সবটাকে আমরাই দায়িত্ব নিয়ে মলিন, রক্তাল্পতায় জীর্ণ সারাৎসারহীন, গুরুত্বহীন করে তুলেছি। কোনও সন্দেহ নেই। ইংরেজি, এবং সাম্প্রতিক কালে হিন্দির আগ্রাসন তীব্র, পুঁজি এবং রাজনীতিলালিত, তবু আমাদের প্রতিরোধহীন আত্মসমর্পণ এবং আত্মবিলোপ অসহনীয় হয়ে উঠছে। এই বাংলা ভাষা, এই বাংলাভাষী দেখার জন্য কি সালাম রফিক, বরকত জব্বার আর বরাকের কমলা ভট্টাচার্য প্রমুখ শহিদেরা প্রাণ দিয়েছিলেন?

অথচ ইউনেস্কো যখন ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করল, তাকে বাংলা ভাষাভাষীদের পক্ষ থেকে গভীর ভাবে অনুধাবন করার চেষ্টাই হল না। ভাষিক সংখ্যাগুরু, ভাষিক সংখ্যালঘু, ভাষিক গণতন্ত্র— এই সব শব্দ, ভাষিক সঙ্কট এবং তার মোকাবিলা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করা হল না। এমন সঙ্কটে দল কী ভাবে ভারী করতে হয়, হাত বাড়াতে হয়, একজোট হতে হয়— সে নিয়ে গুরুত্ব সহকারে পথ বা হদিস খোঁজা হল না। কাজের ভাষা, রোজগারের ভাষা, চিন্তাচর্চার ভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার উদ্যোগ নজরে এল না। বাংলা-বাংলা করে নির্বোধ হইহুল্লোড়ে বাস্তব সঙ্গিন হয়ে উঠল। রাজ্যের ভাষাবৈচিত্র সংরক্ষণ বাতাসে উড়ে গেল। ভাষিক সংখ্যালঘুদের উপর বাংলার খবরদারি শুরু হল। শহর এবং শহরতলি ছেড়ে বাংলা ভাষা ক্রমে আশ্রয় নিতে শুরু করল গ্রাম-মফস্‌সল এবং আরও প্রান্তিকতায়! প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ঠোঁটে গাইলাম আর হীনন্মন্যতায় ভুগে সারা জীবন চাইলাম ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতে। বাংলাকে সঙ্গে নিয়ে নয়, বাংলাকে ভুলে আন্তর্জাতিক হতে! গত শতকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘কাজের ভাষা বাংলা’ নিয়ে কত আন্দোলন, মিছিল, চিন্তা চালালেন, একাধিক প্রবন্ধ লিখে টনক নাড়াতে চাইলেন, হায়, বাঙালি জাগল না!

কর্তৃত্ব আর আধিপত্য তো চলবেই। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ তো দুনিয়া জুড়ে চেষ্টা করবে তার ভাষাকে একঢালা চেহারায় নিয়ে যেতে, তারই সুবিধার্থে। ভাষার এই মাৎস্যন্যায়কে রুখে দেওয়ার পরিকল্পনা এবং কৌশল তো জরুরি ছিল। আমি, তুমি, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, সঙ্ঘ, রাষ্ট্র— কে, কবে এ নিয়ে ভেবেছে? বরং উল্টোটা। বাঙালি লেখকেরা বাংলায় লেখেন না। জমায়েত বা আড্ডায় বাংলা বলেন না। বাংলা সিনেমার পাশে তো দূর, দশ মাইলের মধ্যে দাঁড়ান না। আর এক দল ইংরেজি এবং আন্তর্জাতিক ভাষাসাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে এতটাই সন্ত্রস্ত যে, সে তল্লাটে পা-ই ফেলেন না। এখন অনেকেই শুনছি, ‘গ্রাম-মফস্‌সল ঠিক বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে দেবে’ এই আশায় বুক বাঁধছেন। সে পথেও অবশ্য ঢুকে পড়েছে ইংরেজি-হিন্দির দাপট। স্কুলে যে ছেলেটা চমৎকার বাংলা লেখে, প্রচুর বাংলা বই পড়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলায় কবিতা লেখে— তার কোনও কদর নেই। সুকুমার রায়ের ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’ গল্পের ঢঙে বলতে ইচ্ছে করে, বেচারা জানে না বাংলায় কোনও প্রাইজ় নেই। সব প্রাইজ় ইংরেজি আর অঙ্কে!

ওই যে বলছিলাম ‘কান্ট রিড বাংলা’-র দলে ভিড়ে যাওয়াই ভাল! একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটাই কি বেছে নেব?

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক)

21 February International MotherLanguage Day

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।