জাটিঙ্গার জঙ্গলে
একটা সুচ আর কিছু রঙিন সুতো দিয়ে কত কী এঁকে ফেলা যায় কাপড়ের উপরে। ফুল, পাতা, ময়ূর, সূর্য থেকে শুরু করে লোকগাথাও ফুটিয়ে তোলা রয়েছে গ্রামবাংলার কত সূচিশিল্পে। বর্গিদের লুঠতরাজ, এমনকি যুদ্ধের গল্পও ফুটে উঠেছে কোনও নকশি কাঁথায়। ঠিক সে ভাবেই নিজের ভিটেমাটির ছবি কাপড়ের উপরে সুচের ফোঁড়ে এঁকে চলেছেন দিতি বড়ুয়া।
কোনও হুপের মধ্যে ফুটে উঠেছে অসমের মাজুলি দ্বীপ, কোনওটায় মণিপুরের লোকতাক হ্রদ তো কোথাও আবার মেঘালয়ের ডাউকি নদী। অসমের মেয়ে দিতি। ব্রহ্মপুত্রের ধার ঘেঁষে, হিমালয়ের পাদদেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ফলে স্থানীয় সবুজাভ প্রকৃতি, নীলরঙা নদীই তাঁর কল্পনা জুড়ে। তাঁর পড়াশোনাও সঙ্গী হয়েছে এই শিল্পসৃষ্টিতে। ‘‘শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে আমি এক জন আর্কিটেক্ট ও সিটি প্ল্যানার। আমার আর্কিটেকচারাল ও প্ল্যানিং ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায়, মানচিত্র ও এরিয়াল ভিউ খুব সহজেই বুঝতে পারি। লকডাউনে সুচ-সুতো হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম, তা দিয়ে বেশ সুন্দর ত্রিমাত্রিক চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারছি কাপড়ের ক্যানভাসে। আর গোড়া থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে, উত্তর পূর্ব ভারতের স্বল্পপরিচিত সুন্দর হেরিটেজ অঞ্চলগুলোই আমার কাজের মাধ্যমে তুলে ধরব। সেটা করতে পেরেছি। সকলে অ্যাকনলেজ করেছে আমার কাজ। তাতেই খুশি,’’ গর্বিত শোনাল দিতিকে।
তবে কোনও দিনই সূচিশিল্পের প্রশিক্ষণ নেননি তিনি। অতিমারির কবলে পড়ে লকডাউনই তাঁর শিল্পীসত্তাকে জাগিয়ে তুলেছে। অতিমারির সময়ে পেশাগত ও ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে প্রথম দিকে ভেঙে পড়েছিলেন। সেই হতাশা কাটাতে হাতে তুলে নেন সুচ, সুতো, রং, হুপ। দিতির কথায়, ‘‘আমি মিশ্র মাধ্যমে কাজ করেছি। কখনও বেসে রং ব্যবহার করেছি। সেলাই তো রয়েছেই। কখনও তুলো, কটন ইয়ার্ন দিয়েও কারুকাজ করেছি। তবে কাজটা বেশ কঠিন আর সময়সাপেক্ষ। একে তো ত্রিমাত্রিক ভিউ প্ল্যান করতে হয়। তার পরে সেই অনুযায়ী রং। কোথায় শেডস ভাল লাগবে, কোথায় সেলাই... সবটাই আগে থেকে পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। আর আমি মূলত ফ্রেঞ্চ নট দিয়েই পুরো কাজটা করেছি। ফলে সময় লেগেছে বেশি।’’
কাঁথা স্টিচে ডাউকি
মেঘালয়ের স্ফটিকস্বচ্ছ ডাউকি নদীর এরিয়াল ভিউ তুলে ধরেছেন একটি হুপে। কাঁথা স্টিচের প্যাটার্নে নদীর তরঙ্গ এঁকেছেন। অন্য দিকে গাছপালা ও ফুলের অবয়ব তৈরিতে ফ্রেঞ্চ নট। হালকা রঙে নদীর বহমানতাও ফুটিয়ে তুলেছেন কাপড়ের ক্যানভাসে। তুলোর মেঘ, কটন ইয়ার্নের বোল্ডারও ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে ছবি জুড়ে।
বুলিয়ন স্টিচে জাটিঙ্গা ফরেস্ট
অসমের গহীন জাটিঙ্গার জঙ্গলকে ধরার চেষ্টা করেছেন হুপ আর্টে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখির আবাসস্থল। বহু দশক ধরেই জাটিঙ্গা রয়ে গিয়েছে অন্তরালে। বুলিয়ন স্টিচে জঙ্গুলে লতাপাতা ধরার চেষ্টা করেছেন শিল্পী। এই সেলাইয়ে সুতোয় একাধিক বার পাক দিয়ে একটু টেনে নিয়ে গিয়ে স্টিচ করা হয়। ফলে সেলাই হওয়ার পরে পাকগুলোও একটু যেন উঠে উঠে থাকে।ব্রহ্মপুত্রের ধার ধরে
অসমের ডিব্রুগড়ের জীবনরেখা বলা যায় ব্রহ্মপুত্র নদকে। প্রত্যেক বছর বন্যায় দু’পাড় ভেসে যায়। কিন্তু এক দিকে যেমন ক্ষয়ক্ষতিও হয়, তেমনই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে সুজলা-সুফলা করে ভরিয়ে রেখেছে এই ব্রহ্মপুত্র নদই। জলের মাছ ও নদের দুই পাড়ের কৃষিক্ষেত্রই স্থানীয়দের জীবিকা। ৫ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের কাঠের ফ্রেমে অসমের জীবন ধরে রাখার চেষ্টা দিতির। জলরঙে বেস এঁকে, সুচের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কৃষিক্ষেত্র। আর্টওয়ার্কটি শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় এক সপ্তাহ।
লিভিং রুট ব্রিজ
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মওলিনঙের লিভিং রুট ব্রিজ ফুটিয়ে তুলতে আবার স্থানীয়দের কাছ থেকে সুতোর গোলা কিনে ব্যবহার করেছেন দিতি। শিল্পীর কথায়, ‘‘নামীদামি ব্র্যান্ডের জিনিস আমি ব্যবহার করি না। তার চেয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে রং, সুতো কিনি। এতে স্থানীয় অঞ্চলের যোগসূত্র রয়েছে। কটন ইয়ার্নে পাক দিয়ে রুট ব্রিজ ফুটিয়ে তুলেছেন। সঙ্গে ফ্রেঞ্চ নটে জঙ্গুলে অঞ্চল।
বিলতে হালিসে ধুনিয়া পদুমি
উত্তর পূর্ব ভারতে বিলের সংখ্যা কম নয়। আর তাতে ফুটে থাকে পদ্ম। নৌকা করে সেই পদ্ম তুলতে যান স্থানীয়রা। সে সব বিলের ছবি, ডিব্রু-সাইখোয়া ন্যাশনাল পার্কের ছবিও ফুটিয়ে তুলেছেন হুপ আর্টে। তার সঙ্গে জোনাকিও তৈরি করেছেন ফ্রেমের মধ্যে, যেগুলো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে। এখন দিতি ব্যস্ত ডুয়ার্সের পার্বত্য অঞ্চলকে ফ্রেমে ধরতে। তবে এ রকম হুপ আর্ট করার আগে একটু প্রস্তুতি প্রয়োজন। জেনে নিন, কী ভাবে করবেন—
শিল্পকর্মের পথনির্দেশ
হুপের মধ্যে কাপড় রেখেই সেলাই করার চল। এতে কাপড় টানটান থাকায় সূচিকর্ম নিখুঁত ও সহজে করা যায়। এই হুপ আর্টওয়ার্ক দিয়ে ঘরও সাজাতে পারেন। যা, যা লাগবে, সেগুলোর একটা তালিকা করে নিতে হবে। একটা হুপের সেট, সুচ, নানা রঙের সুতোর বান্ডিল আর রং। এখানে শিল্পী যেমন নানা রঙের কটন ইয়ার্ন ও তুলো ব্যবহার করেছেন, দরকার মতো তা-ও ব্যবহার করতে পারেন।
* প্রথমে কাপড় টানটান করে হুপে আটকে নিন। এ বার রং নিয়ে কাপড়ের বেস তৈরি করে নিতে হবে।
* রান, হেম, হেরিংবোন, ফ্রেঞ্চ নট, চেন, স্যাটিন, বুলিয়ন, ক্রসস্টিচ... সব ধরনের সেলাই-ই ইউটিউব দেখে শিখে নিতে পারেন। একমাত্রিক রেখাঙ্কনের জন্য রান, সেলাইয়ে ভরসা রাখতে পারেন। অবজেক্টের বর্ডারে চেন স্টিচ বেশ ভাল। ত্রিমাত্রিক ভাব ফুটিয়ে তুলতে ফ্রেঞ্চ নট করতে পারেন। ফ্রেঞ্চ নট করে নকশা তুলতে সময় লাগে। কিন্তু দেখতেও বেশি ভাল লাগে। বুলিয়ন স্টিচেও ত্রিমাত্রিক ভাব ফুটিয়ে তোলা যায়।
* বড় ফুল বা বাড়ির চালের মতো অংশের ভিতরের দিক ভরাট করতে স্যাটিন স্টিচ করা যায়। রেশমের সুতোয় এই স্টিচ দেখতে ভাল লাগে।
* সেলাই করার সময়ে ফ্রেমের উল্টো দিকটা খেয়াল রাখবেন। সেলাইয়ের শেষে প্রত্যেক সুতোর শেষ প্রান্তে গিঁট দিয়ে পাশের সুতোর সঙ্গে আর একটা করে গিঁট বেঁধে মজবুত করে দিন। খেয়াল রাখবেন, কাপড়ের সামনের ভাগে যেন সুতোর টান না পড়ে। অন্য দিকে পিছনের সুতোও যেন বেশি ঝুলে না থাকে। তা হলে টান পড়ে সুতো খুলে যেতে পারে।
* হুপ আর্ট যেহেতু কাপড়ের উপরে সুতো দিয়ে তৈরি, তাই তা কেচে নেওয়া যায়। তুলো ব্যবহার করার সময়ে সাবধান। কারণ পরে যদি নোংরা হয়, তখন কাচতে গেলে কিন্তু তুলো ভিজে যাবে। তখন কেচে শুকিয়ে তুলোটা পাল্টে দিতে হবে।
* কাচারও নিয়ম আছে। হুপ থেকে কাপড়ের অংশ খুলে সাবানজলে ভিজিয়ে রাখুন। জল ঝরিয়ে শুকোতে দিন। কাপড় নিংড়ে জল ঝরাতে যাবেন না। এতে সুতোর কাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফ্যাব্রিকটি শুকিেয় গেলে আবার হুপের মধ্যে আটকে নিন।
সূচিশিল্প জারি থাকবে
লকডাউনে সময় কাটাতে এই হুপ আর্ট শুরু করেছিলেন দিতি। তখন এত কিছু জানতেনও না। তবে পরে এই শিল্পকর্মই তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি এনে দিয়েছে। কাজটা শুরু করার সময়েও তিনি ভাবেননি যে, এই কাজই তাঁকে স্বীকৃতি এনে দেবে। ‘‘গত বছর একটি আমেরিকান ক্রাফ্ট ম্যাগাজ়িন প্রথমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই শুরু। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল আর্ট এগজ়িবিশনেও আমার আর্টওয়ার্ক প্রদর্শিত হয়েছে,’’ সন্তুষ্টি দিতির গলায়। নিজের জন্মস্থানকে নিজের হস্তশিল্পের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পেরে ভীষণ খুশি।
তবে মনের খোরাক যখন পেয়েছেন, তাই এখানেই থেমে যেতে চান না। দিতির ইচ্ছে, তাঁকে দেখে স্থানীয়রাও এগিয়ে আসুক। একসঙ্গে তাঁদের ঐতিহ্যের জন্মভূমিকে সকলের সামনে তুলে ধরুক। শিল্পই তাঁদের পরিচয়— এই বিশ্বাসে রং, নতুন সুতো নিয়ে স্বপ্ন এঁকে চলেছেন দিতি, অসম, মণিপুর বা মেঘালয়ের কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy