ঘরভর্তি পড়ুয়াদের সকলেই আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ, স্বাভাবিক। কিন্তু কে জানে, কার মনে কোন গভীর ক্ষত দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রণা দিচ্ছে? কোন বিষয়টি তাঁদের সব চেয়ে বেশি আনন্দ দেয়? কারও হাতের লেখা হয়তো বলে দিতে পারে তাঁর মানসিক পরিস্থিতি কেমন। কিন্তু এর আগে মনের দরজায় কড়া নাড়াই হয়নি হয়তো। তবে শিল্পের মাধ্যমে তাঁরা নিজেকে চেনা-জানার সুযোগ পেলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পারফর্মিং আর্টস থেরাপি সেন্টার’-এ। সোম ও মঙ্গলবার তাদের আয়োজিত দু’দিনের আলোচনাসভায় বিভিন্ন শিল্পকলার মাধ্যমে শারীরিক-সহ মানসিক অসুখ নিরাময়, অথবা জীবনের প্রতিবন্ধকতাগুলি পার করার নানা উপায় তুলে ধরা হয়।
আলোচনাসভার প্রথম দিনে ‘মিউজ়িক থেরাপি’ নিয়ে আলোচনা করেন আধ্যাত্মিক সঙ্গীতজ্ঞ কুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, সঙ্গীত মানসিক ও শারীরিক রোগের প্রতিকার করতে পারে। গলা ছেড়ে শুধু গাইতে হবে। আলাদা করে প্রশিক্ষণ বা চর্চার প্রয়োজন নেই। পছন্দের গানের মাধ্যমেই প্রকাশ করা যায় মনের সুপ্ত আবেগ, যা এত দিন অধরা ছিল নিজের কাছেও। বিভিন্ন গান মস্তিষ্কে ডোপামিন, অক্সিটোসিনের মতো ‘হ্যাপি হরমোন’ ক্ষরণে সাহায্য করে। তিনি বলেন, “গলা ছেড়ে গাইলে শুধু যে নানা রোগের নিরাময় হয়, তা-ই নয়, এর ফলে আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।”
আলোচনাসভার দ্বিতীয় দিনে শুধু অঙ্গভঙ্গি, অভিব্যক্তির মাধ্যমে গল্প বলার পদ্ধতি শেখান রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তনী তথা থিয়েটারশিল্পী কিংশুক দাস। পড়ুয়াদের হাতে দুর্ভিক্ষ, নারী নির্যাতন, চাষাবাদের মতো কিছু ছবি দিয়ে অঙ্গভঙ্গি ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে তার ভাবটি প্রকাশ করতে বলেন তিনি। পড়ুয়ারাও নিজের মতো করে গল্প ফুটিয়ে তোলেন। কিংশুক জানান, গ্রাম ও শহরে মানুষের ভাবনার ভিন্ন রূপ দেখেছেন তিনি। যেমন, খুশির দিনের ছবি আঁকতে গিয়ে শহুরে খুদে এঁকেছে ভিডিয়ো গেমের ছবি, আর গ্রাম্য শিশু এঁকেছে খোলা আকাশ, গাছপালা, ছোট্ট বাড়ির ছবি। তাই তাদের চাহিদা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বুঝে নাটকের মাধ্যমে মনের গভীরে ঢোকার চেষ্টা করেন তিনি।
সেন্টারের সমন্বয়ক রেমন্তী মতিলালের মতে, পারফর্মিং আর্ট থেরাপি শুধুই শিল্পকলার চর্চা নয়। বরং সেই শিল্পের মাধ্যমে বাঁচার রসদ খুঁজে নেওয়া। এখনও পর্যন্ত এই থেরাপির সঠিক সংজ্ঞা অজানা রয়ে গিয়েছে বৃহৎ পরিসরে। তাই এর প্রকৃত কার্যকারিতা মানুষকে জানানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। সেন্টারের অধিকর্তা নূপুর গঙ্গোপাধ্যায় জানান, পরবর্তী কালে অন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও এই থেরাপির ক্লাস করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই অনুষ্ঠানে নাচ-গান-আবৃত্তি পরিবেশন করেন দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিশেষ ভাবে সক্ষম সদস্যরা। তাঁরা সকলেই শিল্পচর্চার মাধ্যমে জীবনের দিশা খুঁজছেন। আর শিল্পের পথে হেঁটে মনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারছেন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)