ব্রায়ান অ্যাডাম্সের ভক্ত-শ্রোতাদের ভিড়ে মিশে থাকবেন অনুপম রায়ও। ছবি: সংগৃহীত।
ভারত এখন বিদেশি সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য এক আশ্চর্য বাজার। প্রতি মাসে দু’-তিন জন করে খুব বড় মাপের শিল্পী এসে গান শুনিয়ে যাচ্ছেন এ দেশে। তর্ক উঠতেই পারে, মাত্র দু’-তিন জন নন, প্রায় ১০ থেকে ১২ জন এ রকম শিল্পী আসছেন প্রতি মাসে। আসলে আমার শ্রোতা হিসেবে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেটা শুরুতেই বলে নেওয়া উচিত।
সঙ্গীত তো বিশাল সমুদ্র! কেউ জ্যাজ়, কেউ টেকনো, কেউ ইডিএম, কেউ ক্লাসিক্যাল, কেউ ওয়ার্ল্ড মিউজ়িক, কেউ হিপহপ— এ ছাড়াও আরও ২০-৩০ ধরনের গানবাজনার চর্চা করেন এবং খবর রাখেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীত আমার প্রিয় হলেও আমি মূলত পপুলার এবং রক মিউজ়িকেরই চর্চা করি। আমার এক জীবনে এর বেশি কিছুতে মনোনিবেশ করার সময় হয়ে ওঠেনি। আর হয়তো তেমন টানও অনুভব করিনি।
অতএব আমি খবর রেখেছি, এই নভেম্বরেই মুম্বইয়ে গান গেয়ে গেলেন ডুয়া লিপা, মেরুন ফাইভ এবং বেঙ্গালুরুতে এক্সট্রিম। কী হয়ে গেল দেশের? কেন আসছেন এঁরা হঠাৎ ভারতে? নিশ্চয়ই চ্যারিটি করতে নয়। তার মানে, ব্যবসা হচ্ছে। টিকিট নিশ্চয়ই বিক্রি হচ্ছে। এড শিরান ২০২৪-এর মার্চে কনসার্ট করে গিয়ে আবার ২০২৫-এ ভারতে আসছেন! ছ’টা শহরে বাজাবেন। কিন্তু কলকাতা নেই লিস্টে। আমি ভুল হতে পারি, কিন্তু যা খবর পেয়েছি, শুধুমাত্র ভেন্যুর কারণে বাতিল হয়ে যায় কলকাতা। এই ধরনের কনসার্ট করার জন্য প্রয়োজন বিশাল খোলা জায়গা, যেখানে অন্তত কুড়ি হাজার মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখতে পারে। কলকাতায় এমন আদর্শ জায়গার অভাব রয়েছে। জানি না, কেন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন খুলে দেওয়া হয় না (নিশ্চয়ই কোনও কারণ থাকবে)। আর যে হেতু এই প্রত্যেক শিল্পীর কনসার্ট করাতে গিয়ে খরচ হয়ে যায় কোটি কোটি টাকা, তাই কুড়ি হাজার মতো লোক জড়ো করতে না পারলে শুধুমাত্র স্পনসরের উপর নির্ভর করা মনে হয় মুশকিলের। যা-ই হোক, যা বোঝা যাচ্ছে, দেশের একটা শ্রেণির কাছে বিনোদনের জন্য খরচ করার মতো অঢেল টাকা রয়েছে। কলকাতাতেও নিশ্চয়ই আছে। না হলে বিয়ের অনুষ্ঠানের যে বিরাট ইন্ডাস্ট্রি ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠেছে, তা দেখে অবাকই লাগে। বিয়ের মাসগুলোতে কয়েকশো কোটি টাকা এই কলকাতাতেই ওড়ে। দুঃখের বিষয়, সেই টাকা মনে হয় বাঙালির কাছে নেই। আর যে বাঙালির কাছে সেই টাকা আছে, তাঁরা কেউ কলকাতায় নেই। এ আমার অনুমান মাত্র। তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে আমি পারব না। আমরা নিজেরা অনুষ্ঠান করতে গিয়েই দেখি, আমাদের চারপাশের বাঙালি শ্রোতারা স্রেফ ফ্রি পাস চেয়ে চেয়ে উন্মাদ করে দেন। তার মানে, বাঙালির সত্যিই টাকা নেই কিংবা স্বভাবটাই খারাপ। আমার বিশ্বাস, বহু বাঙালি ব্রায়ান অ্যাডাম্সের কনসার্টেরও ফ্রি পাস জোগাড় করার চেষ্টা করেছেন। আয়োজকেরা ভাল বলতে পারবেন।
বন্ধুদের সঙ্গে গান, শিল্প, সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখি, বার বার আমি অর্থনীতি বা রাজনীতি নিয়ে তর্কে ফেঁসে যাই। আসলে আমি বিশ্বাস করি যে, কোনও জায়গার অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পরিবেশ যদি সুস্থ না হয়, তা হলে সেখান থেকে দারুণ কিছু বেরিয়ে আশা মুশকিল। সেখানে মানুষ দুর্বল, শিল্পও দুর্বল। কিছু বুদ্ধিমান এবং যথার্থ গুণী ব্যক্তি নিশ্চয়ই পাওয়া যায় থেকে থেকে, কিন্তু তাঁদের ধরে রাখাটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। আর রাজনীতির প্রসঙ্গে যদি আসি, তা হলে এই আলোচনায় গরিব মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে ভোটের রাজনীতির প্রসঙ্গ বাদ রেখে আমরা ভাষার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পারি। প্রশ্ন, ব্রায়ান অ্যাডাম্স যদি বাংলায় গান করতেন তা হলে কী হত? উত্তর, জোর বেঁচে গিয়েছেন। এক, গানগুলো বাঙালি ছাড়া আর কেউ শুনত না। আর দুই, বাঙালি মনে করত গানগুলো সব একঘেয়ে আর ব্রায়ানের গলাটাও কেমন ভাঙা মতো। অথচ পাশ্চাত্যে কেউ এই শিল্পীর থেকে জ্যাজ় বা ল্যাটিন শুনতে চাইছে না। বাঙালি হলে কিন্তু শ্রোতার মনে মনে আশা থাকত, এক দিন একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিশ্চয়ই শোনাবেন বা একটা সেমি-ক্লাসিক্যাল। নিদেনপক্ষে একটা বাউল! যাকগে, যেটা বলছিলাম, ভাষার রাজনীতি এমন একটা খেলা, যাতে ইংরেজরা জিতে বসে আছে আর আমরা কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছি না। ব্রায়ান অ্যাডাম্স ভাগ্যিস কানাডায় জন্মেছেন, ইংরেজিতে গান লিখেছেন এবং গেয়েছেন!
গান লেখার কথায় যখন এলাম, তখন একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, অ্যাডাম্সের বেশির ভাগ বিখ্যাত গানই পার্টনারশিপে লেখা। ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’, ‘রান টু ইউ’, ‘হেভেন’, ‘কাটস্ লাইক আ নাইফ’— এগুলো সব জিম ভ্যালেন্সের সঙ্গে লেখা। অর্থাৎ, দু’জন মিলে গান লেখেন আর অ্যাডাম্স নিজের কণ্ঠে সেগুলো রেকর্ড করেন। কে লিরিক লিখেছেন বা কে সুর করেছেন, এই ভাবে কিন্তু ওঁরা ক্রেডিটস লেখেন না। গোটা গানটা, অর্থাৎ সুর-কথা মিলিয়ে যে বস্তুটি প্রস্তুত হচ্ছে, তার কৃতিত্ব দু’জনে ভাগ করে নেন।
ব্রায়ান অ্যাডাম্স মূলত প্রেমের গান লেখেন এবং গান। তিনি তাঁর কৈশোর থেকেই গান তৈরি করছেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ভীষণ আলাদা রকমের, ‘অদ্বিতীয়’ও বলা যেতে পারে। সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। না হলে তিনি চার দশক ধরে নিজের গান নিয়ে পথ চলতে পারতেন না। গান লিখিয়ে এবং পরিবেশকের পাশাপাশি তিনি একজন পেশাদার চিত্রগ্রাহকও। আমার ভাল লাগে তাঁর এই সৃজনশীল মনটা। নিজেকে প্রকাশ করার একটা তাগিদ এবং সেটা পরিবেশন করার বহুমুখী প্রতিভার নজির আমরা শিল্পীর মধ্যে পাই।
সঙ্গীতের মধ্যে এমন একটা বিমূর্ততা রয়েছে যে, লিখে কোনও দিনই বোঝানো সম্ভব নয়, একটা গান একজন মানুষের কেন ভাল লাগে। এর সঙ্গে একটা বয়সের যোগও থাকে। ব্রায়ান অ্যাডাম্সের বহু গানে আমি বার বার একটা যৌন আবেদন পাই। ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ সম্বন্ধে ব্রায়ান নিজে কিছু জায়গায় বলেছেন, তিনি যৌন অবস্থান ‘সিক্সটি নাইন’কে রেফারেন্স হিসেবে ভেবে লিখেছিলেন। যদিও গানের অপর লেখক জিম ভ্যালেন্স বলেছেন, তিনি সে রকম কিছু ভাবেননি। এমন ভাবে গানটি লেখা যে, গোটা পরিবার একসঙ্গে গাইতে পারে, কিন্তু এক বারও কারও কোনও যৌন অনুষঙ্গ মাথায় আসবে না।
এর পর যদি আমরা ‘রান টু ইউ’ নিয়ে ভাবি, এটি একটি ক্লাসিক পরকীয়ার গান। গোটা গানে যৌন আবেদন এবং অকপট স্বীকারোক্তি যে, সে বার বার তার পার্টনারকে ছেড়ে তার মিস্ট্রেসের কাছে ছুটে ছুটে যাবে। কৈশোরে এত কিছু বুঝতাম না, গানের শুরুতে যে গিটার রিফটা আছে, মূলত ওটা তোলার জন্যই গানটা বার বার শুনতাম। এ ছাড়া বলব ‘লেট্স মেক আ নাইট টু রিমেমবার’ গানটির কথা। এখানে একদম সরাসরি যৌনতার বলা হচ্ছে। সঙ্গীতায়োজন, গায়কি এবং গোটা পরিবেশনার মধ্যে এক আকর্ষণীয় ‘সেক্স অ্যাপিল’ রয়েছে, যেটা আমার ভাল লাগে। এক বারের জন্যও অশ্লীল বা ‘ভালগার’ লাগে না। এখানে কোথায় একটা পার্থক্য হয়ে যায় আমাদের অধিকাংশ হিন্দি ছবির গানের ভাষার সঙ্গে, গায়কির সঙ্গে— যেগুলো স্পষ্টতই আমার ভালগার লাগে। আমাদের বাংলা গানে শিলাজিৎদা মাঝেমাঝে যৌনতাকে ‘এক্সপ্লোর’ করেছে। ‘বসুন্ধরা’ খুবই আধুনিক একটি গান। তবে গান, শিল্প— সব কিছুই যে হেতু ভীষণ সাবজেকটিভ, এই ক্ষেত্রে আমাকে অ্যাডাম্সের গানটি বেশি টানে। গানটিতে কোথাও একটা কোমলতা রয়েছে, তাই হয়তো আমার মধ্যে সেটি অনুরণিত হয়।
ভারতে ব্রায়ান অ্যাডাম্সের তুমুল জনপ্রিয়তা এক আশ্চর্য ব্যাপার। এই চিরগ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের দেশে সবাই কেন যে ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ নিয়ে এত উত্তেজিত, আমরা নিজেরাই জানি না (আসলে হয়তো কামসূত্রের দেশ বলে)। বহু বার এসেছেন এ দেশে, পোড়া কলকাতায় এই প্রথম বার। কিন্তু এখন যখন কলকাতায় আসছেন, তাঁর মূল যে অনুরাগীর দল, তারা কর্মসূত্রে ছড়িয়ে গিয়েছে অন্যান্য দেশে বা শহরে। আমার প্রিয় বন্ধু সন্দীপন চন্দ, যে আসল ব্রায়ান অ্যাডাম্সের ফ্যান, যার কেনা ব্রায়ান অ্যাডামসের তিন-চারটে ক্যাসেট থেকেই মূলত আমার শিল্পীর গান শোনা— সে-ই এখন থাকে লন্ডনে। এই কনসার্টে আমি ওকেই সবচেয়ে বেশি মিস্ করব। ব্রায়ান অ্যাডাম্স নিজের দেশে এবং আমেরিকায় বিখ্যাত হন আশির দশকে। সেই গান ভারতে এসে পৌঁছয় টিভি এবং ক্যাসেটের মাধ্যমে নব্বইয়ের দশকে। অর্থাৎ আমরা যখন উঠতি যুবক-যুবতী। নতুন কিছু (ভাল হোক বা মন্দ) শোনার, দেখার ইচ্ছে থাকে মানুষের যৌবনেই। ব্রায়ান অ্যাডাম্স সেই সময়ে আমাদের যৌবনের সুরটা ধরতে পেরেছিলেন। সেই সময়ে কলকাতায় এলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত!
এখনকার যুবক-যুবতীরা ব্রায়ান অ্যাডাম্স খুব একটা কেউই শোনেন না। তাঁরা এখন কে-পপ শুনছেন, টেলর সুইফ্ট বা এড শিরান শুনছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করা হলে আরও ভাল বলতে পারবেন। যা-ই হোক, ২০২৪-এ কলকাতায় ব্রায়ান অ্যাডাম্স আসছেন, এটা সত্যিই খুব বড় একটা খবর। এই কনসার্টের উদ্যোক্তাদের আমার ভালবাসা। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কিছুটা নস্ট্যালজিয়া কাজ করবে। মনে পড়ে যাবে আমার কৈশোরের গান শোনার দুপুরগুলো। গিটার বাজিয়ে গানগুলো তুলে নিয়ে গাওয়ার দিনগুলো। এই কনসার্টের পর যদি একজন বাঙালি যুবক বা যুবতীও অনুপ্রাণিত হন গান লিখতে বা গাইতে বা গিটার বা ড্রামস বাজাতে, সেটাও আমাদের বড় পাওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy