Advertisement
E-Paper

রক্তাল্পতা এক ভয়ঙ্কর সমস্যা

সারা দেশে মহিলাদের মধ্যে উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে রক্তাল্পতার সমস্যা। পুরুষেরাও কম-বেশি এই রোগের শিকার হন। ডাক্তারি পরিভাষায় একে অ্যানিমিয়া বলে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৫৫
Share
Save

সারা দেশে মহিলাদের মধ্যে উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে রক্তাল্পতার সমস্যা। পুরুষেরাও কম-বেশি এই রোগের শিকার হন। ডাক্তারি পরিভাষায় একে অ্যানিমিয়া বলে। এই রোগ কেন হয়, এর সমস্যা সম্পর্কে জানালেন রামপুরহাট ২ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক চিকিৎসক অভিজিৎ রায় চৌধুরী।

প্রশ্ন: রক্তাল্পতা কী?

উত্তর: রক্তে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে তাকেই মূলত অ্যানিমিয়া বলা হয়। হিমোগ্লোবিন হল লোহিত রক্তকণিকায় অবস্থিত একপ্রকার প্রোটিন যার মধ্যে আয়রন এবং ট্রান্সপোর্টস অক্সিজেন বর্তমান। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই ব্যাধির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলারা অপুষ্টির কারণে এই রোগে আক্রান্ত হন। আবার অনেকে নানা গোর ভোগের ফলেও অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হন। রক্তের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে নীচে নেমে গেলে সেটাই রক্তাল্পতা। ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হলেও শরীরে স্বাভাবিকভাবে রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ হল— পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৩.৮ থেকে ১৭.২ গ্রাম/ ডেসিলিটার। মহিলাদের ১২.১ থেকে ১৫.১ গ্রাম/ ডেসিলিটার।

প্রশ্ন: রক্তাল্পতার লক্ষণ কি?

উত্তর: ক্লান্তি বা দুর্বলতা হল রক্তাল্পতার সাধারণ লক্ষণ। অন্যান্য লক্ষণগুলি হল শ্বাসপ্রশ্বাসের স্বল্পতা, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। ফ্যাকাসে চামড়া, বুকে ব্যথাও রক্তাল্পতা র উপসর্গ। রক্তপরীক্ষা করলে এই রোগ নির্ণয় করা একেবারেই সহজ। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে লোহিত রক্তকণিকার গণনা ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরিমাপ সম্ভব।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

প্রশ্ন: রক্তাল্পতা কেন হয়?

উত্তর: রক্তাল্পতা মূলত তিনটি কারণে হয়। সেগুলি হল রক্তক্ষয়, লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদন কমে যাওয়া এবং লোহিত রক্তকণিকা নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই তিন কারণে রক্তের মধ্যে আয়রণের পরিমাণ কমে যায়। খাদ্যে পুষ্টির অভাবে রক্তাল্পতা হয়। যে মহিলাদের ঋতুস্রাবের পরিমাণ অতিরিক্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা খুব বেশি। দীর্ঘমেয়াদি কোনও অসুখের ফলেও রক্তাল্পতা হতে পারে। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে অর্ষে ভুগছেন, যাঁরা আবার বহুদিন ধরে ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি বৃক্কীয় কার্য্যহীনতায় ভুগছেন তাঁদেরও অ্যানিমিয়া হতে পারে। আবার কখনও নিজেই একটা রোগ হতে পারে যেমন সমস্ত রক্তকণিকা তৈরির অভাবে রক্তাল্পতা হয়। আবার কিছু রোগের জন্য হয় যেমন ম্যলেরিয়া, কালাজ্বর, যক্ষা, যকৃৎ সংক্রান্ত সমস্যা, কিডনি সমস্যা, ম্যাল অ্যাবসরপশান সিমব্রম বা পুষ্টির পচন এবং শোষণ এর প্রক্রিয়ায় কোনও কারণে অসুবিধা হলে রক্তাল্পতা হতে পারে। আবার দুর্ঘটনা জনিত কারণে রক্তক্ষরণ, রক্ত বমি, দীর্ঘদিন ক্যানসার রোগে ভুগলে, কৃমি সংক্রান্ত রোগে ভুগলে, গর্ভাবস্থার কারণে রক্তাল্পতা হয়। আবার কিছু ওষুধ সেবনে যেমনে অ্যান্টি ক্যানসার চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু ওষুধ সেবনে আবার খিঁচুনি রোগের কিছু ওষুধ সেবনে রক্তাল্পতা হয়। ভিটামিন সি এবং ফলিক অ্যাসিডের অভাব আবার বি ১২ এর অভাবেও হাইপোথাইরয়েড অ্যানিমিয়া হয়।

প্রশ্ন: রক্তাল্পতা ক’ধরনের হয়? কেন হয়?

উত্তর: রক্তাল্পতা বিভিন্ন ধরনের হয়।

অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া

অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প পরিমাণে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন হয়। এটা অর্জিত বংশগত হতে পারে। অর্জিত বলতে যে এই রোগটি নিয়ে জন্মায়নি পরে কোনও এক সময় রোগটি দেখা দিয়েছে। তাকে বলে অর্জিত। আবার কোনও ব্যক্তি বাবা মায়ের বা পরিবারের কারুর থেকে এই রোগ পেয়েছেন তখন সেটি জন্মগত হয়। অর্জিত অবস্থায় বিভিন্ন কারণে হতে পারে যেমন অপুষ্ট আহার, হরমোনের অস্বাভাবিক স্তর বা পরিমাণ, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, গর্ভাবস্থা। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া বা মজ্জাজনিত রক্তাল্পতায় যথেষ্ট পরিমাণ লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন হয় না। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে রক্তের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে রক্তের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাইরে থেকে অণুচক্রিকা এবং লোহিত রক্তকণিকা প্রবেশ করিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংক্রামক নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই ধরনের অ্যানিমিয়ায় ফলে বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

হিমোলাইটিক অ্যানেমিয়া

জন্মগত কারণে এই ধরনের অ্যানিমিয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে জন্মগত সেরোসাইটোসিস এবং হিমোগ্লোবিনওপ্যাথিজ রোগও হতে পারে। লোহিত রক্তকণিকার ক্ষেত্রে অনেকক্ষেত্রে ভুল গ্রুপের রক্ত শরীরে প্রবেশ করলে এই ধরনের রক্তাল্পতা হয়। আবার শরীরে সংক্রামক এবং টক্সিড ফ্যাক্টরোও এই রোগ হয়। আবার ম্যালেরিয়া, ব্ল্যাক ওয়াটার ফিভার, জলের মধ্যে আর্সেনিক, সিসার পরিমাণ বেশি হলে হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া হয়।

থ্যালাসেমিয়া

থ্যালাসেমিয়াও জন্মগত। হিমোগ্লোবিন রক্তের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন বহন করি হিমোগ্লোবিনের কাজ হল তা শরীরের সমস্ত অংশে বহন করে নিয়ে যাওয়া। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তরা হিমোগ্লোবিন তৈরিতে অক্ষম। হিমোগ্লোবিন দুটি আলফা প্রোটিন এবং দুটি বিটা প্রোটিন দিয়ে তৈরি হয়। শরীরের মধ্যে এই প্রোটিন গুলোর উৎপাদন কমে গেলে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনও কমে যাবে। এই ধরনের রোগীরা গ্লোবিন চেন তৈরি করতে সম্পূর্ণভাবে এবং আংশিকভাবে অক্ষম থাকেন। থ্যালাসেমায় রকমফেরে আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া দুই ধরনের হয়।

সিকেল সেল অ্যানিমিয়া

এটি সিকেল সেল ডিজঅর্ডার নামেও পরিচিত। এটি এক ধরনের বংশগত অ্যানিমিয়া। সাধারণত লোহিতকণিকা দেখতে গোলাকার এবং নমনীয়। লোহিতকণিকা সহজেই রক্তনালীতে সঞ্চালিত হতে পারে। সিকেল সেল অ্যানিমিয়া হলে লোহিত রক্তকণিকা অনমনীয় এবং আঠাল হয়ে যায়। এবং সিকেল বা অর্ধচন্দ্রের মতো বা কাস্তের মতো আকার ধারণ করে। এই অস্বাভাবিক কণিকাগুলো ছোট রক্তনালীতে আটকে যায়। যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত এবং অক্সিজেন সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রোগ সম্পূর্ণ রুপে ভালো হয় না। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে বিভিন্ন জটিলতা এবং ব্যথা দূর করা সম্ভব হয়।

পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া

ভিটামিন বি ১২ এর অভাবে এই অ্যানিমিয়া হয়। এই ধরনের আনেমিয়া ক্ষতিকারক। এই রোগ এমন একটি রোগ যেখানে বড় এবং অপরিনত, নিউক্লিষ্ট কোষ (মেগালোব্লাস্টস, যা লাল রক্ত কোষের পূর্বসূরী হয়) রক্তে সঞ্চালিত হয় অথচ কাজ করে না। গ্যাস্ট্রোইনটেষ্টটাইনাল ট্র্যাক্ট থেকে ভিটামিন বি ১২ শোষণ করতে ব্যর্থতার কারণে পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া হয়। এর ফলে রক্তে লোহিতকণিকার পরিমাণ কমে যায়।

ফ্যানকনি অ্যানেমিয়া

এই ধরনের অ্যানিমিয়া খুব কম দেখা যায়। এই ধরনের অ্যানিমিয়া শরীরের ডি এন এ বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।

প্রশ্ন: রক্তাল্পতার চিকিৎসা কি?

উত্তর: শরীরে আয়রণ ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতা হলে আয়রণ জাতীয় খাবার খেতে হবে। আয়রণ ট্যবলেট চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খেতে হবে। রক্তের সি বি সি পরীক্ষা করে লোহিত রক্তকণিকা এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা দেখে রক্তশূন্যতা আছে কিনা তা জানা সম্ভব। আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য সিরাম আয়রণ এবং সিরাম ফেরিটিন পরীক্ষা করা হয়। যাকে টি আই সি বি বলে। অপুষ্টি জনিত কারণে অ্যানিমিয়া হলে আয়রণ সাপ্লিমেন্ট হিসাবে দেওয়াটাই মূল চিকিৎসা। রক্ত পরীক্ষার সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নির্দেশ মতো চলতে হবে।

প্রশ্ন: এগুলো থেকে পরিত্রানের উপায়?

উত্তর: সঠিক ভাবে রক্ত পরীক্ষা এবং অন্যান্য পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। এবং চিকিৎসকের নির্দেশ মতো খাদ্যাভাস পাল্টাতে হবে। খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ না খেয়েও রক্তাল্পতা দূর করা যায়।

প্রশ্ন: অ্যানিমিয়ার সঙ্গে জীবনযাত্রার ধরনের কোনও সম্পর্ক আছে কি?

উত্তর: অবশ্যই আছে। কারণ কি অ্যানেমিয়া রোগীদের প্রচুর পরিমাণে আয়রণ জনিত খাবার খেতে হয়। জীবনযাত্রার মান পাল্টাতে হয়। তা না হলে অ্যানেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন: শিশুদের অ্যানিমিয়া হলে কী করণীয়?

উত্তর: শিশুদের অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ৬ মাসের পর থেকে বুকের দুধ সেই সঙ্গে স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হয়। গ্রামাঞ্চলে শিশু বয়সে অ্যানিমিয়ার প্রধান কারণ হল ঘন ঘন কৃমির সংক্রমণ। ১০০ বক্র কৃমি প্রতিদিন ৩০ সিসি রক্ত চুষে খায়। সুতরাং নির্দিষ্ট সময় অন্তর কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত। শিশুদের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার দিলে এবং কিছু নিয়ম মানলে সুস্থ রাখা যায়।

অ্যানিমিয়ার জন্য জটিলতা

গর্ভবতী মহিলা যাদের সিভিয়ার অ্যানিমিয়া রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। সাধারনত শিশুর জন্মের সময় ও পরে এই সমস্যা গুরুতর ভাবে দেখা যায়। সাধারনতই শিশুর জন্মের সময় প্রচুর রক্তক্ষয় হয়। অ্যানিমিয়া থাকাকালীন প্রচুর রক্তপাত গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যদি মায়ের শরীরে গুরুতর অ্যানিমিয়া থেকে থাকে তবে শিশু প্রিম্যচিওর এবং অন্ডারওয়েট হতে পারে। এছাড়াও শিশু পরবর্তী কালে অ্যানিমিয়ার শিকারও হতে পারে। অ্যানিমিয়ার ফলে ক্লান্তি রোগীর জীবনের মানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। গুরুতর অ্যানিমিয়ার ফলে রোগী যে কোন কাজেই অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করেন। দীর্ঘদিনের ক্লান্তি মানসিক অবসাদের কারণও হতে পারে। অ্যানিমিয়ার রোগীর দীর্ঘদিন চিকিৎসা না হলে তারা সংক্রমণজনিত কারণে অনেকবেশি পরিমাণে অসুস্থ হন। অ্যানিমিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে অক্সিজেন ও পুষ্টিকর উপাদান উৎপাদনের জন্য হৃদপিন্ডের প্রচুর পরিমাণে রক্তের প্রয়োজন হয়। এতে বেশিভাগ ক্ষেত্রে হার্ট ফেল হওয়ার সম্ভবনাও থাকে। ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতিও অ্যানিমিয়ার একটি কারণ। এর ফলে নার্ভের ক্ষতি হতে পারে।

(সাক্ষাৎকার: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়)

Anemia রক্তাল্পতা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}