পরিস্থিতি গুরুতর হলে সার্জারি একমাত্র উপায়।
বছর ষোলোর মেয়েটার শিরদাঁড়ার আকৃতি অনেকটা ফার্স্ট ব্র্যাকেটের মতো। ঠিক মতো ঘুমনো তো দূর অস্ত, পোশাক পর্যন্ত পরতে পারে না সে। কারও আবার জন্ম থেকে শিরদাঁড়া ‘এস’-এর মতো। বাঁকা পিঠের কারণে একটা শিশুর স্বাভাবিক জীবন থেকে সে বঞ্চিত। শিরদাঁড়ার সমস্যা যে শুধু বড়দের রোগ, এমন নয়। ছোটদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে এ সমস্যা। পরিস্থিতি গুরুতর হলে সার্জারি একমাত্র উপায়। শুরুর দিকে যদি এই রোগ ধরা পড়ে, তা হলে বিনা সার্জারিতেই নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়। স্পাইন সার্জন ডা. অনিন্দ্য বসু ব্যাখ্যা করে বললেন, “ছোটদের মধ্যে শিরদাঁড়ার যে-যে ধরনের সমস্যা দেখা যায়, সেগুলো হল— স্কোলিয়োসিস, স্পন্ডাইলোলিসথেসিস এবং শিরদাঁড়ার সংক্রমণ।’’ এর মধ্যে স্কোলিয়োসিস নিয়েই চিকিৎসকেরা বেশি চিন্তিত।
স্কোলিয়োসিস
কোনও শিশু জন্মগত ভাবে স্কোলিয়োসিসে আক্রান্ত হতে পারে। এটাকে বলা হয় কনজেনিটাল স্কোলিয়োসিস। জন্মানোর পর থেকেই শিরদাঁড়া বেঁকে যায়। এ ক্ষেত্রে অবস্থা বুঝে সার্জারি বা অন্য পদ্ধতি ঠিক করা হয়।
আবার বয়ঃসন্ধিতে হঠাৎ করে শিরদাঁড়া বাঁকতে শুরু করে। ‘‘সাধারণত মেয়েদের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা যায়। এটিকে ইডিয়োপ্যাথিক স্কোলিয়োসিস বলা হয়। সাধারণত ১১-১৮ বছর বয়সের মেয়েরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়। ‘‘মেয়েরা যখন গ্রোথ পর্বের মধ্য দিয়ে যায়, তখনই শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এই রোগের নির্দিষ্ট কোনও কারণ নেই বলেই একে ইডিয়োপ্যাথিক স্কোলিয়োসিস বলা হয়। তবে জেনেটিক অ্যাসোসিয়েশনও পাওয়া গিয়েছে। জিনের মিউটেশনের সঙ্গে রোগটির সম্পর্ক রয়েছে। কেউ তার মা বা দিদিমার কাছ থেকে রোগটা পেতে পারে বা একই পরিবারের দুই বোনের হল, এমনটাও দেখা যায়। সমস্যা হল, এই রোগে আগাম সাবধানতা নেওয়ার কোনও উপায় নেই,’’ বললেন ডা. অনিন্দ্য বসু।
রোগ ধরা পড়ার পরে নজর রাখা হয়, তা বাড়ছে কি না। বেশি বাড়লে সার্জারি করাতে হয়। নয়তো কারেকটিভ ব্রেস, ফিজ়িয়োথেরাপি করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়। বিদেশে ছোটদের স্কুলের শিক্ষকদের স্কোলিয়োসিস স্ক্রিনিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কেউ এই রোগে আক্রান্ত কি না, তা সহজেই নির্ণয় করা যায়। একটি বাচ্চাকে সামনের দিকে ঝুঁকতে বলা হল। যদি দেখা যায় তার পিঠ বা কোমরের একটা অংশ উঁচু হয়ে আছে, তা হলে বুঝতে হবে, এটি স্কোলিয়োসিসের প্রাথমিক লক্ষণ। স্পাইন সার্জন ডা. বসু বলছিলেন, ‘‘এই রোগ নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমাদের কাছে বাচ্চারা খুব অ্যাডভান্স স্টেজে আসে। তখন শিরদাঁড়া এতটাই বেঁকে যায়, যে সার্জারি করাও জটিল হয়ে পড়ে। তবে সার্জারির মাধ্যমে সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব। এখন কলকাতাতেও আধুনিক পদ্ধতিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।’’ সার্জারির পরে কিছু দিন ফিজ়িয়োথেরাপি করা দরকার। এক বছর পর থেকে খেলাধুলো, নাচ... সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবে করা সম্ভব। ১৮-২০ বছর বয়স পর্যন্ত স্কোলিয়োসিস সার্জারি করা যায়। তার পরে শিরদাঁড়ার নমনীয়তা কমে যায়। সেই কারণে সার্জারির ফল তেমন ভাল হয় না।
আর এক ধরনের স্কোলিয়োসিস হল, নিউরো মাসকুলার স্কোলিয়োসিস। যে সব বাচ্চা সেরিব্রাল পলসি, স্পাইনার মাসকুলার অ্যাট্রফির মতো রোগে আক্রান্ত, তাদের এই ধরনের স্কোলিয়োসিস দেখা যায়। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের নিউরো মাসকুলার স্কোলিয়োসিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
স্পন্ডাইলোলিসথেসিস
যে শিশুরা নিয়মিত খেলাধুলো করে, যেমন ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, অ্যাথলেটিক্স, জিমন্যাস্টিক্স শেখে... এদের স্পন্ডাইলোলিসথেসিসের সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টা ব্যাখ্যা করে অনিন্দ্য বসু বললেন, ‘‘এদের শিরদাঁড়ার নীচের দিকে হাড়ের মধ্যে ছোট চিড় ধরতে পারে। সেই চিড়ের জন্য একটা হাড় অন্য হাড়ের উপর উঠতে শুরু করে। এটাকেই স্পন্ডাইলোলিসথেসিস বলা হয়।’’ ছোটরা যদি কখনও বলে, পিঠে-কোমরে যন্ত্রণা হচ্ছে, তারা ঘুমোতে পারছে না এবং এটা নিয়মিত হচ্ছে, তখন দেখতে হবে শিরদাঁড়া ও কোমরের হাড়ে কোনও চিড় ধরেছে কি না। এক্স-রে, সিটি স্ক্যানে এটা ধরা পড়বে। স্পন্ডাইলোলিসথেসিস হলে কিছু দিন বাচ্চাটির খেলাধুলো বন্ধ করতে হবে। বিশেষ ধরনের বেল্ট পরা, ফিজ়িয়োথেরাপি করা জরুরি। ধীরে ধীরে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে সার্জারির দরকার পড়ে না।
শিরদাঁড়ার ইনফেকশন
অন্য কোনও অসুখ থেকেও স্পাইনে ইনফেকশন ছড়াতে পারে। বাচ্চাদের স্পাইনে টিউবারকুলোসিস হয়। বা বাড়িতে কারও টিবি হলে, সেখান থেকেও সংক্রমিত হতে পারে শিশুরা। স্পাইনে টিউমর হওয়ার ঘটনাও দেখা যায়। ওষুধের মাধ্যমেই এই রোগের চিকিৎসা করা হয়।
পিঠে ভারী ব্যাগ, শারীরচর্চা না করা,পুষ্টির অভাব...
ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সুরজিৎ রায় জোর দিলেন, বাচ্চাদের পশ্চার কারেকশনের উপরে। ‘‘স্কুলের ভারী ব্যাগ, দীর্ঘ সময়ে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, ওবেসিটি... এগুলো ভবিষ্যতে জটিল রোগের জন্ম দিতে পারে। টেবিল-চেয়ারে বসে পড়াশোনার পদ্ধতি আছে, সেটাও মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ়, সাঁতার, যোগব্যায়াম করা জরুরি।’’ পাশাপাশি দেখতে হবে শিশুর শরীর যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি পাচ্ছে কি না, ভিটামিন ডি-র মাত্রা যেন ঠিক থাকে। মায়ের পুষ্টি ঠিক মতো না হলে বাচ্চাদের স্পাইনা বাইফিডার মতো অসুস্থতা দেখা যায়। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় শিশুর শিরদাঁড়া ঠিক মতো তৈরি হয় না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্পাইনে অস্টিয়োপোরোসিসের ঘটনাও ক্রমশ বাড়ছে।
বাচ্চা যদি ঘাড়ে-পিঠে ব্যথার কথা নিয়মিত বলে কিংবা এর সঙ্গে মাথা ঘোরা, হাত পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরার মতো উপসর্গ দেখা যায়, তখন তা অবহেলা না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy