Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Dolls

হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ ‘পুতুল’

একরত্তিকে তেল মাখাচ্ছে কোনও পুতুল, তো আবার আরামকেদারায় গা এলিয়ে হুঁকো টানছে কোনও পুতুল... কত রকম পুতুল রয়েছে এ বঙ্গে?

হিঙ্গুল পুতুল

হিঙ্গুল পুতুল Sourced by the ABP

নবনীতা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৮
Share: Save:

ছেলেবেলায় হাঁস-মুরগি আঁকা ফ্রকের কোলে কত পুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিন্তে। আবার একরত্তির এক ধমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে পলকে। কিন্তু অন্য কেউ সেই পুতুলকে বকুনি দিলে বা স্কুল থেকে ফিরে প্রিয় পুতুলটার দেখা না পেলে চোখের কোণে জলও জমেছে। পুতুল যে শুধু পুতুল নয়। বাড়ির খুদে সদস্যদের সব সময়ের সঙ্গী। সেই পুতুলের মধ্যেই তারা খুঁজে নেয় নিজের ইচ্ছেপূরণের এক অবয়ব। কিন্তু সেই অবয়ব তৈরির নেপথ্যে রয়েছেন কিছু শিল্পী। এ বঙ্গে পুতুল শুধু খেলার সামগ্রীই নয়, কোথাও তারা দেবদেবী রূপে পূজিত, কোথাও তারা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আজও।

রাজা শশাঙ্কের সময় থেকে...

মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ব্লকের কাঁঠালিয়ার পুতুল চলে আসছে রাজা শশাঙ্কের সময় থেকে। কর্ণসুবর্ণ ও তার দক্ষিণ লাগোয়া রাঙামাটি অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে মিলেছে এমন অনেক পুতুল। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কর্ণসুবর্ণের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় মাটির কাজ শুরু হয় সেখানে। গঙ্গার পলিমাটিকে আশ্রয় করে সেখানে আস্তানা গড়ে তুলেছিল বারাণসী থেকে আগত কুম্ভকার সম্প্রদায়। মাটির বাসনকোসন তৈরির পাশাপাশি কচিকাঁচাদের জন্য তাঁরা তৈরি করতেন মাটির পুতুলও। সাদা পুতুলের গায়ে লাল-কালো ডোরাকাটা দাগই হল কাঁঠালিয়ার পুতুলের বৈশিষ্ট্য। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই পুতুল তৈরির কাজ হয়ে এলেও বর্তমানে শিল্পী সাধন পালই এই শিল্পের ধারক ও বাহক। শিল্পী বললেন, “রাঙামাটি দিয়েই পুতুল তৈরি হয়। তার পর খড়িমাটি দিয়ে সাদা রং, পলিমাটির সঙ্গে খয়ের মিশিয়ে লাল, ঘুঁটের গুঁড়ো আর পলিমাটি মিশিয়ে কালো রং তৈরি করে পুতুলের গায়ে ডিজ়াইন করা হয়। সব শেষে তুষের আগুনে পুড়িয়ে পুতুলের রং ও গড়ন পাকা হয়। তবে এই পুতুল তৈরির দুটো অংশ। এর মুখের অংশ তৈরি করতে ছাঁচ ব্যবহার হলেও নীচের অংশ তৈরি হয় কুমোরের চাকায়।”

কোথাও সেই ধাইমা পুতুল পা ছড়িয়ে বসে বাচ্চাকে তেল মাখাচ্ছে, কোথাও আবার দুই পুতুল দু’পাশে বসে জাঁতা পিষছে। কর্ণসুবর্ণ অঞ্চলের ধ্বংসস্তূপ থেকে অবশ্য বেশি পাওয়া গিয়েছে বাচ্চা কোলে গোয়ালিনি পুতুল। তৎকালীন সমাজের ছবি স্পষ্ট এই পুতুলের সাজগোজ ও কাজেকর্মে। ঘোড়ার পিঠে লাল টুপি পরা দারোগা পুতুল মনে করিয়ে দেয় ব্রিটিশ রাজের কথা।

বাবু, বিবি ও দেবদেবী

কাঁঠালিয়ার পুতুলে যেমন ব্রিটিশ দারোগা বা গ্রাম্য পরিবেশ, মজিলপুরের পুতুলে ধরা পড়ে পুরনো কলকাতার ‘বাবু’ কালচার। সুন্দরবন অঞ্চলে আদিগঙ্গার মজাগর্ভে গড়ে ওঠা জনবসতি মজিলপুর বিখ্যাত তার বাবু পুতুলের জন্য। প্রায় দু’শতক আগে, যশোরের দত্ত জমিদারদের সঙ্গে এসেছিলেন কালীচরণ পেয়াদা। সেই পেয়াদাদের হাতেই গড়ে উঠতে শুরু করে মাটির পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি। পরে জমিদারি-যুগের অবসান হলে পুতুল তৈরিই পেশা হয়ে যায় পেয়াদাদের। তাঁদেরই বংশধর শম্ভুনাথ দাস এখনও সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছেন। শিল্পীর কথায়, “এখানে যেমন বাবু পুতুল আছে, তেমন আহ্লাদি পুতুল, গণেশজননীও রয়েছে। আবার বনবিবির মতো লোকদেবীও রয়েছে। এই পুতুল তৈরি হয় ধানজমির এঁটেল মাটি দিয়ে। বাপ-ঠাকুরদার আমলে তৈরি পোড়ামাটির ছাঁচ থেকেই পুতুল তৈরি হয়। তাই অবয়ব বা গড়ন সেই একই আছে। তবে আগে এক খোলের ছাঁচ হত, এখন দু’খোলের ছাঁচ হয়। ফলে পুতুলের সামনে-পিছনে দু’দিকই সুন্দর গড়নের হয়। তবে পোড়ামাটির ছাঁচ একশো-দেড়শো বছর হয়ে গিয়েছে বলে নোনা ধরে যাচ্ছে। তাই আমরা প্লাস্টারের ছাঁচ বানিয়ে নিচ্ছি।” কালীঘাটের পটচিত্র যেমন পুরনো কলকাতার ছবি ধরে রেখেছে, এই পুতুলেও ধরা আছে সেই সময়কাল। যেমন কোনও বাবু পুতুল আরামকেদারায় বসে হুঁকো টানছে, তেমন কোথাও বৌয়ের চুল টেনে ধরে আছে কোনও বাবু... এমন কত চিত্র উঠে আসে এই পুতুলের গড়নে।

হিঙ্গুল পুতুল

বাঁকুড়ার টেরা কোটা শিল্পের মতোই নাম রয়েছে বিষ্ণপুরের হিঙ্গুল পুতুলের। শিল্পী শীতল ফৌজদার বললেন, “মূলত বাড়ির মেয়েরাই হাতে তৈরি করেন এই পুতুল। আমার মা-ঠাকুমাকে এই পুতুল বানাতে দেখে শিখেছি। এর ইতিহাস প্রায় দেড়শো-দুশো বছরের পুরনো।” এক আঙুল সমান আকারের এই পুতুল মূলত বাচ্চাদের খেলনা হিসেবেই তৈরি হত। এঁটেল মাটি দিয়ে গড়ে নিয়ে রং দিয়ে জামাকাপড়, চোখ-মুখ আঁকা হয়। এই পুতুলে ভেষজ রঙের পাশাপাশি বাজারচলতি রাসায়নিক রংও ব্যবহার করা হয়। ছেলেমেয়ের জোড়া হিসেবেই এই পুতুল বিক্রি হয়। আগে পুতুলের পোশাকে ফ্রক, টুপি, জ্যাকেটের বাহারে সাহেবি কায়দা ধরা পড়লেও এখন ঘাগড়া, শাড়ির মতো দেশজ পোশাকও গড়ে দেওয়া হচ্ছে মাটি দিয়েই, জানালেন শীতল।

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী

মেদিনীপুরের কাঁসাই নদী থেকে তুলে আনা এঁটেল মাটি দিয়ে আবার তৈরি হয় দিওয়ালি পুতুল। কোমরের নীচের অংশ তৈরি হয় কুমোরের চাকায় আর ঊর্ধ্বাংশ আঙুলের চাপে। সব শেষে ছাঁচে মুখের গড়ন। এই পুতুলের বৈশিষ্ট্য হল এর হাতে, মাথায় প্রদীপ থাকবে। শিল্পী কেশব পাল বললেন, “দিওয়ালির দিন সকালে ফুল-মিষ্টি দিয়ে বাড়ির লক্ষ্মীপ্রতিমার মতোই পুজো করা হয় এই পুতুল। তার পর জ্বেলে দেওয়া হয় পুতুলের প্রদীপ। তার থেকেই এর নাম দিওয়ালি পুতুল।” কিন্তু এই পুতুলের ব্যবসা মরসুমি। প্রত্যেক বছর দীপাবলির আগে এই পুতুল যেটুকু তৈরি ও বিক্রি হয়, সেটুকুই লাভ।

কৃষ্ণনগরেও দেবদেবীর রূপ ধরা পড়ে পুতুলে। তবে ঘূর্ণিতে কামার, জেলে, তাঁতি, কৃষকের মতো বিভিন্ন জীবিকানির্ভর মাটির পুতুল তৈরি করতে দেখা যায়। জলঙ্গী নদীর দোআঁশ মাটিতে যে কোনও মানুষের অবয়ব অনায়াসে ফুটিয়ে তোলেন এখানকার শিল্পীরা। শোনা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পূর্ব বাংলার নাটোর থেকে মৃৎশিল্পীদের আনিয়েছিলেন এখানে। তবে শুধু মানুষের অবয়ব আর দেবদেবী নয়, পশুপাখির অবয়বও ধরা আছে পুতুলে। যেমন গালার পুতুলে গণেশ মূর্তির মতোই জনপ্রিয় গালার হাতি, ঘোড়া।

একা ‘শিল্পী’ রক্ষা করে

মেদিনীপুরে গালার পুতুল শিল্প ধরে রেখেছেন শিল্পী বৃন্দাবন চন্দ্র। তাঁর কথায়, “আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের পাঁচরোলে এই কাজ হত। আমাদের পূর্ব মেদিনীপুরের খড়ই, পশ্চিমশাহিতেও ১৬-১৭ ঘর শিল্পী গালার পুতুল তৈরি করত। এখন কেউ করে না। কারণ যা খরচ হয়, পুতুল বিক্রি করে সেই টাকা ওঠে না। গালার পুতুল তৈরির প্রক্রিয়াও সময়সাপেক্ষ।” পাড়া-গাঁয়ের উইয়ের ঢিবি ভেঙে নিয়ে এসে দু’-তিনদিন ভিজিয়ে রেখে তৈরি হবে মাটি। সেই মাটি হাত দিয়ে মেখে নিয়ে তা দিয়ে তৈরি হবে পুতুলের অবয়ব। তার পর রোদে শুকিয়ে নিয়ে পুতুলের উপরে পড়বে গালার প্রলেপ। আগুনের উপরে গালার স্টিক ধরে রং করার পরে যে সুতো বেরিয়ে আসে, তা দিয়ে গরম পুতুলের হাতে, বুকে দাগ কেটে নকশা ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। কিন্তু তাতেও মিশেল। শিল্পী বললেন, “এখন অনেকে গালার পুতুল বলে যা বিক্রি করে তা রং দিয়ে তৈরি, গালা নয়।” এই পুতুল তৈরি বেশ পরিশ্রমের। সেই শ্রমের দাম তো মেলেই না, শিল্পের কদরও নেই।

তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি...

এই পুতুল তো নিছক খেলনা নয়, বরং বাংলার সমাজ, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ধারক ও বাহক। কিন্তু ক্রমশ সেই ইতিহাস হারিয়ে যেতে বসেছে অবহেলায়। শিল্পী শম্ভুনাথ দাস যেমন বললেন, পুতুল তৈরি এখন কেউ শিখতেই চায় না। কারণ এর বিক্রিও নেই, টাকাও নেই। বরং তার জায়গায় বিদেশি ফাইবার বা প্লাস্টিকের পুতুল এখন জায়গা করে নিচ্ছে ঘরে ঘরে। শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্মও তাই অন্য কিছু করে জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবছেন। তবে এর মধ্যেই আশার আলো দেখায় বৃন্দাবন চন্দ্র। সম্প্রতি কলকাতার একটি নামী স্কুলে ওয়ার্কশপ করছেন তিনি। স্কুলপড়ুয়ারা তাঁর কাছে শিখে নিচ্ছে এই পুতুল তৈরির শিল্প। ক্ষীণ আশা ভেসে আসে শিল্পীর কণ্ঠে, “ভবিষ্যতে অন্য কোনও ভাবে যদি টিকে যায় বাপ-ঠাকুরদার এই ঘরানা!”

তবে এখন মেলাই ভরসা এই পুতুল-শিল্পীদের। শহুরে অন্দরসাজে বিদেশি পুতুলের পাশে তাও ঠাঁই হয় এই পুতুলদের। কিন্তু যে-সব পুতুলের ঠাঁই হয় না? শহরের বুকে মেলাশেষে নিভু আলোয়, আঁধারি ঘেরা মাঠ থেকে গ্রামে ফিরে যায় কত পুতুল। ঝুড়ির কোণ থেকে ডাগর চোখে চেয়ে থাকে, পরের বার ফিরে আসার আশায়। হয়তো সে বার তাকে খুঁজে নেবে অন্য কোনও হাঁস-মুরগি আঁকা ফ্রক থেকে বেরিয়ে আসা কচি দুটো হাত।

অন্য বিষয়গুলি:

Toys childhood Childhood Memories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy