E-Paper

যার নাম জার্নালিং

কেউ ছবি এঁকে, কেউ স্ট্যাম্প-স্টিকার আঠা দিয়ে সেঁটে, কেউ বা শুধু রঙিন পেনে লিখেই মনের কথা প্রকাশ করছেন জার্নালে। কী এই জার্নালিং?

জার্নাল।

জার্নাল। —ফাইল চিত্র।

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৪৮
Share
Save

“আই হোপ আই উইল বি এবল ইন কনফাইড এভরিথিং টু ইউ, অ্যাজ় আই হ্যাভ নেভার বিন এবল টু কনফাইড ইন এনিওয়ান, অ্যান্ড আই হোপ ইউ উইল বি আ গ্রেট সোর্স অব কমফর্ট অ্যান্ড সাপোর্ট,”

এক কিশোরীর লেখা ডায়েরির শুরুতেই এমন আত্মসমর্পণ স্পষ্ট করে যে, নিজেকে প্রকাশ কতটা সহজ হয় লেখায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দমবন্ধ দিনগুলো জমানো আছে অ্যান ফ্রাঙ্কের এই বিখ্যাত ডায়েরিতে। আবার নানা ডায়াগ্রাম, মানবদেহের অ্যানাটমির স্কেচ ফুটে উঠেছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নোটবুক জার্নালে। অন্য দিকে প্লেগ মহামারি, দ্বিতীয় ডাচ যুদ্ধের মতো ঘটনাক্রম উঠে এসেছে ব্রিটিশ নৌকর্তা স্যামুয়েল পেপিসের দিনলিপিতে। সেখানে তিনি ব্যবহার করেছেন শর্টহ্যান্ড। অন্য দিকে সেল্ফ-পোর্ট্রেট ও নিজের মনন স্পষ্ট ফ্রিদা কাহলোর জার্নালে। এক-একটা খাতার মধ্যে নিজেদের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে রেখেছেন তাঁরা।

এই যে জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তের ছবি আমরা বোঝাই করে রাখছি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে। লাইক, কমেন্টের বন্যায় সেখানে সব সুখী মুহূর্তের ছবি। কিন্তু নিজের মনের গহিন কোণ, গ্লানি, জরুরি তথ্য, অভিজ্ঞতা, সুখস্পর্শ, দুঃখযাপন... সে সব? সেই সবই কি হারিয়ে যাবে? সে সব জমিয়ে রাখা যেতে পারে জার্নালে। সম্প্রতি উনিশ-কুড়িদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে জার্নালিং। প্রত্যেক দিন বা সপ্তাহের কয়েক দিন নিয়মিত জার্নালিং করছে তারা। তবে প্রত্যেকের জার্নাল তার নিজস্ব, তার মনের প্রতিচ্ছবি বলা যায়। তাই কারও জার্নালে যেমন লজ্জা-কষ্ট-ভয় এসে জমা হচ্ছে, কারও জার্নালে ভ্রমণ সংক্রান্ত গল্পকাহিনি উঠে আসছে, কারও জার্নালে আবার দুনিয়ার স্ট্যাম্প, স্টিকার এসে জড়ো হচ্ছে।

কী এই জার্নালিং?

রোজনামচা বা নিজের মনের অনুভূতি লিখে রাখার প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। এক সময়ে ডায়েরি বা নোটবুক ছিল এমন সঙ্গী। কিন্তু দিনবদলে তার রূপ বদলেছে। তা অনেক বিস্তার পেয়েছে। শুধু রোজনামচার বদলে ফুড, ট্রাভেলের মতো বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জার্নালও তৈরি করা যায়। সেখানে শুধু লিখে নয়, তার সঙ্গে এঁকে, স্টিকার জুড়েও জার্নালিং চলছে। অনেকে স্রেফ নিজের মনের কথা লিখে রাখে। রোজ সে যা দেখছে, শুনছে, চারপাশের পৃথিবীতে যা ঘটছে, তার টুকরো ছবি, মুহূর্ত সে জমিয়ে রাখে। অনেক ছাত্রছাত্রী আবার নিজেদের মোটিভেটেড রাখার জন্যও জার্নালিং করে থাকে। সে ক্ষেত্রে হয়তো সে প্রত্যেক দিন ক্লাসে কী পারছে আর কী পারছে না, তার তালিকা তৈরি করে ফেলল। কোন টেস্টে কত মার্কস পেল, সে সব লিপিবদ্ধ করছে। অনেকে আবার সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার করে সপ্তাহের সাত দিন কোথায় গেল, কী করল, কার কথায় দুঃখ পেল, নতুন কী শিখল, কী উপহার পেল... সে সবের তালিকা জমিয়ে ফেলছে।

জার্নাল।

জার্নাল। —ফাইল চিত্র।

জার্নালিংয়ের দুনিয়ায়

শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, যে কোনও বয়সেই শুরু করা যায় জার্নালিং। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, কত রকম জার্নালিং হয়:

  • রিফ্লেক্টিভ: চিন্তা, আবেগ লিপিবদ্ধ করা যায়। রোজকার ঘটনায় আপনার মত লিখে রাখলেন হয়তো।
  • বুলেট জার্নালিং: কোনও কিছুর তালিকা করে বা ডেলি রুটিন বানিয়ে দৈনন্দিন কাজ গোছাতে এই জার্নালিং সহায়ক।
  • আর্ট জার্নালিং: ছবি এঁকে, লাইন করে, কবিতা লিখে সাজানো যায়। অনেকে আবার ফ্যাব্রিকের টুকরো জুড়ে দেন। নানা রকম কালার স্প্রে করে পাতার টেক্সচারেও বদল আনা যায়।
  • নিউজ় জার্নালিং: খবরের কাগজ বা ম্যাগাজ়িন থেকে পছন্দ মতো খবরের অংশ কেটে নিয়ে তার সঙ্গে মানানসই ছবি জুড়ে তৈরি করে ফেলতে পারেন। বড় করে ক্যাপশন বা হেডিংও দিতে পারেন মন থেকে। সেই খবর থেকে নিজে কিছু উপসংহার টানতে পারেন। এতে বিচার করার ক্ষমতাও তৈরি হয়।
  • জাঙ্ক জার্নালিং: হ্যান্ডমেড পেপার, ফ্যাব্রিকের টুকরো, ফেলে দেওয়া কার্ড, রিবন, পোস্টকার্ড, সিডি... এমন নানা স্ক্র্যাপ মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন জাঙ্ক জার্নাল। এই ধরনের জার্নাল জনপ্রিয় হচ্ছে এখন। এই জার্নালে কোলাজও করা যায়।
  • ট্রাভেল জার্নালিং: কোথাও ঘুরতে গেলে সেই জায়গার ছবি, কিছু স্মৃতিকথা লেখা। তার সঙ্গে স্থানীয় ফুল বা পাতা তুলে নিয়েও অনেকে জুড়ে দেন আঠা বা সুচ-সুতো দিয়ে।
  • ফুড জার্নালিং: অনেক ভাবে করা যায়। নিজে রোজ কী খাচ্ছি, কতটা খাচ্ছি... তার একটা হিসেব রাখার মতো। আবার যা খাচ্ছি, তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহের মতো। আবার বিশেষ বিশেষ জায়গার খাবার নিয়েও ট্রাভেল জার্নালিংয়ের মতো ফুড জার্নালিং করা যায়।
  • ফিটনেস জার্নালিং: এ ক্ষেত্রে রোজ কত ঘণ্টা হাঁটলাম, কত ঘণ্টা দৌড়লাম, সাঁতার কাটলাম... তার সঙ্গে কতটা চিনি খেলাম, তেলমশলা খেলাম... সেগুলো লিখে ফেললেও নিজের রুটিন ট্র্যাক করা সোজা হয়।
  • সংগ্রহ ও সংরক্ষণ: গাছের পাতা, ফুল শুকিয়ে সেগুলো জমিয়ে রাখা যায়। এর সঙ্গে গিফট র‌্যাপ, কার্ডস, ছবি, স্ট্যাম্প, টিকিট ইত্যাদি সংগ্রহ করেও রাখা যায়। তবে জার্নালিংয়ের নির্দিষ্ট কোনও গণ্ডি হয় না। এই সবক’টি ধরনও ফিরে ফিরে আসতে পারে আপনার তৈরি জার্নালে।
জার্নাল।

জার্নাল। —ফাইল চিত্র।

জার্নালিং কেন জরুরি

আইআইটি খড়্গপুরের সিনিয়র কাউন্সেলার দেবারতি আচার্য বলছেন, “এক ছাত্রকে দেখেছিলাম, সে তার নিজের ট্রান্সজেন্ডার আইডেন্টিটি প্রকাশ করতে চাইত না। সে সবই সে লিখে রাখত। পরে লেখার সময়ে নিজের সত্তা প্রকাশ করতে করতে তার মাথায় সামাজিক ট্যাবুগুলো ভাঙতে শুরু হয়। নিজেকে সে চিনতে ও গ্রহণ করতে শেখে। আসলে জার্নালিংয়ের সময়ে আমরা মেপে কিছু করছি না। সেখানে কে লাইক করল কী করল না, কী মন্তব্য আসবে... সে সব চিন্তা থাকে না। ফলে মনের আগল খোলা যায়। পজ়িটিভ জার্নালিং খুব জরুরি। ধরুন দিনে দু’টি বা তিনটি ঘটনা, যা আপনার খুব ভাল লাগল, তা ছোট করে লিখে রাখতে পারেন।” এই ইতিবাচক মুহূর্ত জীবনে আশাবাদী হতে শেখায়।

মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার সঙ্গে নিজের সৃজনশীল মনটাকেও বাঁধিয়ে রাখছে জার্নালিং। হয়তো জার্নালিং-এর অভ্যেসে নিজের কোনও বিশেষ গুণ আপনার সামনে চলে এল। সেই শখ নিয়ে আরও এগোতে পারলেন। আর একটি কথাও বললেন দেবারতি, “জার্নালিং কী ভাবে শুরু করবেন, বুঝতে না পারলে প্রম্পটের সাহায্য নেওয়া যায়। কৃতজ্ঞতা স্বীকারমূলক, নিজের যত্ন নেওয়ার, অনুপ্রেরণাদায়ক, ইতিবাচক চিন্তাশক্তির জন্য নানা রকমের প্রম্পটের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।” দৈনন্দিন মর্নিং জার্নাল, মান্থলি জার্নাল প্রম্পট পাওয়া যায়। প্রম্পট মানে কিছু প্রশ্ন আপনাকে লেখার রসদ জোগাবে। সেখানে রোজ সকালে কী লিখবেন বা পছন্দের কোনও ঘটনা কী? এমন প্রশ্ন করে নানা রকমের প্রম্পট দেওয়া হয়। একটু নেট সার্চ করলেও পেয়ে যাবেন।

অভিজ্ঞতা বড় পুঁজি। তা যদি লিখে জমিয়ে রাখা যায়, ক্ষতি কী! জীবনের বিভিন্ন মোড়ে হয়তো বা নিজেরই লেখা পুরনো জার্নাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখা হয়ে গেল ফেলে আসা মুহূর্ত বা নতুন ‘আমি’-র সঙ্গে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Journals

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।