বিয়ের পিঁড়িতে আলপনা।
নবম-দশম শ্রেণি তখন। স্কুলের সরস্বতী পুজোয় দায়িত্ব পড়ত আলপনা দেওয়ার। ঠাকুরঘরের লাল মেঝের উপরে সাদা খড়িতে ফুটে উঠত পদ্ম কলকা। বর্তুলাকার আলপনা দেওয়া হত ঠিক পুজোর ঘটের চারপাশে। আর তার দু’পাশে ফুটে উঠত রৈখিক আলপনার সর্পিল গতি। একই ভাবে বাড়িতেও লক্ষ্মীপুজোর সময়ে ধানের ছড়ার চিহ্ন ফুটে উঠত সদর দরজা থেকে পুজোর ঘট পর্যন্ত। সেই ধানের ছড়ার মাঝ বরাবর ইংরেজি এস অক্ষরের মাথায় হাতের টানে ফুটে উঠত লক্ষ্মীর পা। স্কুলে হোক বা বাড়িতে তুলির পাট ছিল না। খড়িমাটি জলে ভিজিয়ে একটা ছোট কাপড় বা তুলো তাতে ডুবিয়ে নিতে হত। তার পরে অনামিকা বাইরে রেখে বাকি চার আঙুলে ধরতে হত সেই কাপড়ের টুকরো। আঙুলের চাপে একটু-একটু করে খড়িমাটির সাদা গোলা অনামিকা বেয়ে নেমে আসত একেবারে আঙুলের ডগায়। অনামিকার চলনেই মাটির উপরে ফুটে উঠত আলপনা। ঠাকুরদালানের লাল মেঝের উপরে সেই খড়িমাটি শুকোলে সাদা রেখার বিন্যাসে তৈরি হত এক আশ্চর্য জগৎ।
বিভিন্ন পূজাপার্বণ ও ব্রতর অংশরূপেই আলপনার সূচনা। তারও আগে জাদুবিশ্বাসে ভর করে মনের ইচ্ছে ফুটিয়ে তোলা হত বিভিন্ন চিত্ররূপে। হয়তো খাদ্য আহরণের জন্য শিকারে বেরোবে মানুষ। তখন পশুপাখি শিকারের ছবি আঁকা হল। বিশ্বাস তৈরি হত, ছবি আঁকলে তা সত্যি হবে। এ ভাবেই ব্রতের আচারেও মনোবাঞ্ছা ফুটে উঠতে লাগল আলপনায়। যেমন লক্ষ্মীপুজোয় ধানের ছড়া অর্থাৎ শস্যলাভের আকাঙ্ক্ষা থেকেই ফুটে ওঠে এমন চিত্ররূপ। এ ভাবেই পুণ্যিপুকুর ব্রত, সেঁজুতি ব্রতর আলপনায় মানুষের মনের ইচ্ছেই রূপ পেত হাতের টানে।
প্রকৃতির নির্যাস মিশে গেল আলপনায়
এ চিত্রে বদল এল শান্তিনিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরে। বিশ্বভারতীর শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় বললেন, “মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য পালন ও চর্চার জন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে। উপনয়নের পরে যখন রবীন্দ্রনাথ প্রথম শান্তিনিকেতনে গেলেন ওই নির্জন উন্মুক্ত প্রান্তর তাঁর এত ভাল লেগে যায় যে তিনি সেখানে প্রাচীনকালের তপোবনের আদলে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করতে চাইলেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথও রাজি হয়ে গেলেন। বিদ্যাচর্চার সেই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু হল কলা ও সঙ্গীতচর্চা।” আর আশ্রমের উৎসব-অনুষ্ঠান বলতে শুরু হল বিভিন্ন ঋতু উদ্যাপন— বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব, পৌষ উৎসব ইত্যাদি। এইসব উৎসব-অনুষ্ঠানে আশ্রম সাজানো হত ফুলপাতা ও আলপনা দিয়ে। সব মিলিয়ে একটা নান্দনিক প্রয়োগ যুক্ত হল শান্তিনিকেতনের উৎসবের সঙ্গে।
শান্তিনিকেতনে যে কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানের সূচনা হত নিকোনো মাটিতে আলপনা দিয়ে। আবার সম্মানিত অতিথিকে আশ্রমে সংবর্ধনা দেওয়ার অনুষ্ঠানেও আলপনা দেওয়া হত। যেমন ১৯১৪ সালে নন্দলাল বসুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং গুরুদেব। “তার আগে ১৯১১-এ কবিগুরুর জন্মদিনে খোলা আকাশের নীচে গাছের তলায় তেমনই আলপনা দেওয়া হয়েছিল বৈদিক আদর্শ মেনে। বৈদিক যুগে আলপনা দেওয়া হত পঞ্চগুঁড়ি দিয়ে। পরবর্তী কালে চালবাটা বা পিটুলিগোলার ব্যবহার শুরু হল। তারও পরে এল খড়িমাটি, এলা মাটি, গেরিমাটি। প্রকৃতির রং মিশে গেল আলপনার প্রাকৃতিক মোটিফে। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের সময়ে বৈদিক যুগের আলপনার নকশার আদর্শে শান্তিনিকেতনের আলপনা শুরু হয়। তাঁর স্ত্রী কিরণবালা দেবীও সুন্দর আলপনা দিতেন,” বলে জানালেন সুধীরঞ্জন।
তবে বৈদিক আলপনার চলন ছিল জ্যামিতিক। সেই চলনে লাবণ্য আনলেন সুকুমারী দেবী। ১৯২৪-এ পূর্ব বাংলা থেকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসা হল গ্রামীণ আলপনায় দক্ষ সুকুমারীকে। তিনি এসে বাংলার আলপনার সহজ চলন ও নকশা প্রয়োগ করলেন। শান্তিনিকেতনের বৈদিক আলপনার জ্যামিতি ক্রমশ লাবণ্যময় হয়ে উঠল। পাশাপাশি নন্দলালের কাছে আঁকাও শিখতে শুরু করলেন সুকুমারী। সে সময়ে ঠিক হল আশ্রমেও আলপনার ক্লাস হবে। সেই ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব বর্তাল সুকুমারীর উপরে। শান্তিনিকেতনের গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে-বৌরা দুপুরের ক্লাসে সুকুমারীর কাছে আলপনা শিখতে আসতেন। বিভিন্ন লতাপাতার পাশাপাশি আলপনায় ঠাঁই পেল ফুল, পাখি, প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ। বিবিধ মোটিফ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, আলপনায় স্থানীয় প্রভাব রয়েছে। যুগে-যুগে যে কোনও শিল্পের মতোই আলপনাও সমৃদ্ধ হয়েছে। যেমন মোগলযুগে ডালিম ফুল ও আনারসের লতাবিতান, বৌদ্ধযুগে আবার পদ্মের মোটিফ।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মন্দির ভাস্কর্য ও মন্দিরগাত্রের চিত্রিত অলঙ্করণও ক্রমশ উঠে আসতে লাগল আলপনার নকশায়। ১৯০৮ সাল নাগাদ উত্তর ভারত, ওড়িশা ও দক্ষিণ ভারতের মন্দির ভাস্কর্য ঘুরে দেখেন নন্দলাল। তার পরে ১৯০৯ সালে তিনি যান অজন্তায়। সেখানে গুহাচিত্র কপির কাজ করতে গিয়ে সেই অলঙ্করণ হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেন শিল্পী। পরে তিনি শান্তিনিকেতনে এলে স্থাপিত হয় কলাভবন। ক্রমশ দেশের বিভিন্ন মন্দির-ভাস্কর্যের এই অলঙ্করণ স্থান করে নেয় আলপনার সুচারু জমিতে।
দড়ি-খড়ির আলপনা
নন্দলালের দুই কন্যা গৌরী ভঞ্জ ও যমুনা সেনও ছিলেন আলপনায় সুদক্ষ। তাঁদের সময়ে আলপনায় জ্যামিতিক রেখাবিন্যাসের জন্য দড়ি-খড়ি ব্যবহারের চল ছিল বেশি। তার উল্লেখ পাওয়া যায় ছোট একটি গল্পে। একবার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। উপাসনামন্দিরে গেলেন আলপনা দেখতে। সেখানে তখন আলপনার দায়িত্বে রয়েছেন গৌরী ভঞ্জ। তাঁকে দেখে অবনীন্দ্রনাথ বললেন, “তোদের আলপনা মানে তো সেই দড়ি-খড়ির আলপনা।” এই দড়ি-খড়ির আলপনাই ছিল জ্যামিতিক রেখাপাতের পরিচায়ক। ধরা যাক একটা ত্রিভুজ বা সরলরেখা আঁকা হবে, কিন্তু ওই প্রাঙ্গণ জুড়ে সরলরেখা টানা বা বৃহৎ বৃত্ত নির্মাণ তো সহজ নয়। তখন দড়ির গায়ে খড়ি বুলিয়ে তা লম্বায় টানটান করে মাটির উপরে রেখাপাত করা হত। সে ভাবেই আঁকা হত ত্রিভুজ। আবার বৃত্ত আঁকার সময়ে দড়ির এক দিক কেন্দ্রে ধরে অন্য দিকে খড়ি নিয়ে বর্তুলাকারে ঘুরিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যেত বৃত্ত। গৌরী ভঞ্জ ও যমুনা সেনের পরে ননীগোপাল ঘোষ ও প্রণব রায়ও নিষ্ঠার সঙ্গে আশ্রমের আলপনার ধারা বজায় রেখেছিলেন।
পুষ্পপল্লব ও প্রকৃতি-কবিতা
তার পরে ১৯৭৫-এ প্রথম জাতীয় বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনে এলেন সুধীরঞ্জন। মূলত পেন্টিং নিয়েই তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। কিন্তু শান্তিনিকেতনে আসার পরে আশ্রমের আলপনা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তার সঙ্গে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি তৈরি করে ফেলেন নিত্যনতুন নকশা। সুধীরঞ্জনের আলপনায় ভারতীয় স্থাপত্য নকশা, ভাস্কর্য-অলঙ্করণ, অজন্তা, জাভা ও তিব্বতি নকশার প্রভাব লক্ষিত হয়। ক্রমশ রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রকৃতির যে প্রকাশ তা আলপনায় প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি। আলপনায় ফুটিয়ে তোলেন ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’। ছড়া ও কবিতাও রূপ পেয়েছে তাঁর আলপনার আঙ্গিকে। কোথাও আলপনায় ফুটে উঠেছে ‘তিনটি শালিক ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে’, কোথাও আবার ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’র চিত্ররূপ তৈরি হয়েছে আলপনায়। এক দিকে যেমন দেশজ লোকসাহিত্য ও অন্যান্য প্রভাব এসে মিশেছে আলপনায়, তেমনই আশ্রমের আলপনায় নন্দলাল, গৌরী ভঞ্জের পরিশীলিত ধারা রক্ষা করা হয়েছে। তবে আলপনার ক্যানভাসের তো সীমা নেই, তাই নব-নব সংযোজনেরও শেষ নেই।
শুধুমাত্র সৃষ্টিসুখের উল্লাসেই আয়ত্ত করা যায় এই শিল্প। কথায় বলে, গান শোনার চেয়েও শুনে-শুনে সেই গান তুলে গাওয়ায় বেশি সুখ। তেমনই সুদৃশ্য আলপনা দেখে তা মাটিতে ফুটিয়ে তোলার মতো শান্তি বুঝি আর কিছুতে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy