Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Acupuncture

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ও স্বল্প খরচের চিকিৎসা আকুপাংচার

ঊর্মি নাথ 
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ০৪:৪১
Share: Save:

আকুপাংচারে সুতোর মতো সরু স্টিলের সুচ শরীরের বিভিন্ন পয়েন্টে ফুটিয়ে নার্ভ উদ্দীপিত করে চিকিৎসা করা হয়। জেনে নিন বিশদে

অস্বীকার করার উপায় নেই, আজ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কম বেশি নানা শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত। বহু মানুষকে আজীবন ওষুধ খেয়ে স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে জীবনের ছন্দ। কিন্তু কখনও কখনও এ ভাবে ভাল থাকায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তাই হয়তো গোটা বিশ্ব ঝুঁকছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে। সেই দলে জায়গা করে নিয়েছে আকুপাংচার।

প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম চিনে, যা আজ বিশ্বের ১২০টি দেশ গ্রহণ করেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে তো মেডিক্যাল ইনশিয়োরেন্স পলিসির মধ্যেও আকুপাংচার অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। ১৯৭৯ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আকুপাংচারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৩ সালে ‘হু’ একটি তালিকা প্রকাশ করে, যাতে উল্লেখ আছে ১০৩টি শারীরিক সমস্যায় আকুপাংচার কার্যকর।

ভারতে আকুপাংচারের প্রবর্তক এ রাজ্যের ইএনটি স্পেশ্যালিস্ট ডা. বিজয়কুমার বসু। চিনে ডাক্তারি করতে গিয়ে সাইনোসাইটিসে আক্রান্ত হন। তখন ডা. বসু চিনা সহকর্মীর পরামর্শে আকুপাংচার করিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তার পরেই নিজে শিখে নেন এই চিকিৎসা পদ্ধতি। ভারতের ‘ফাদার অফ আকুপাংচার’ ডা. বসুর উদ্যোগে আশির দশকের প্রথম দিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সরকারি ভাবে আকুপাংচার-এ প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার আইনের মাধ্যমে এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গড়ে উঠেছে কাউন্সিল অফ আকুপাংচার থেরাপি, যার মাধ্যমে এই চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ৩৩টি সরকারি আকুপাংচার সেন্টার আছে। এই চিকিৎসাবিদ্যার প্রসারের জন্য ডা. বসু তাঁর কলকাতার বাড়িটি রাজ্য সরকারকে দান করেন। বর্তমানে সেটির নাম ডা. বি কে বসু মেমোরিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট অফ আকুপাংচার। সরকারি আকুপাংচার চিকিৎসা ব্যবস্থার এটাই প্রধান কার্যালয়।

কী ভাবে চিকিৎসা করা হয়

আকুপাংচারে সুতোর মতো সরু স্টিলের সুচ শরীরের বিভিন্ন পয়েন্টে ফুটিয়ে নার্ভ স্টিমুলেট করে চিকিৎসা করা হয়। ডা. বি কে বসু মেমোরিয়াল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট অফ আকুপাংচার-এর প্রধান চিকিৎসক হীরালাল সামন্ত এই বিষয়ে বললেন, ‘‘ফিজ়িয়োলজি বলে, মানুষের শরীরের মধ্যেই সমস্ত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে। সেখানে গড়বড় হলেই আমরা আক্রান্ত হই বিভিন্ন রোগে। অ্যালোপ্যাথি বা মডার্ন মেডিসিনের ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর শরীরের ঘাটতিগুলো অনুসন্ধান করে ওষুধ প্রয়োগ করে ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করেন। আকুপাংচারের কাজটাও তাই। পার্থক্য একটাই, এখানে ওষুধ খেতে হয় না। নার্ভ স্টিমুলেট করে শরীরের ভিতরে থাকা কেমিক্যালগুলোর পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে ঠিকমতো কাজ করানোই আকুপাংচারের কাজ। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে, হরমোনের ব্যালান্স ঠিক রেখে, স্নায়ুতন্ত্রকে ঠিক মতো পরিচালিত করে শরীরকে সুস্থ হতে সাহায্য করে আকুপাংচার।’’

যে সমস্যাগুলোর জন্য আকুপাংচার করানো হয়

বিভিন্ন ধরনের বাত, স্পোর্টস ইনজুরি, জয়েন্ট পেন, অ্যাজ়মা, অ্যালার্জি, মাথাযন্ত্রণা, প্রজননে সমস্যা, অনিদ্রা, প্যারালিসিস, ক্রনিক গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস, বিভিন্ন ধরনের ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে আকুপাংচার বিশেষভাবে কার্যকরী। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আকুপাংচার পোস্ট সার্জারি গা গোলানো, বমি এবং কার্ডিয়োমায়োপ্যাথির রোগীদের গা গোলানোর সমস্যা থেকে রেহাই দিয়েছে। প্যারালাইজ়ড রোগীদের সচল করে তুলতেও ক্ষেত্র বিশেষে সফল হয়েছে আকুপাংচার। আজীবন ওষুধ খেয়ে বাত, জয়েন্ট পেনের মতো ক্রনিক সমস্যাগুলোকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। এ সব ক্ষেত্রে আকুপাংচার রোগীকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুস্থ করে তোলে— এমনই দাবি ডা. সামন্তর। ‘‘আমি যেহেতু মডার্ন মেডিসিনেরও চিকিৎসক, তাই পার্থক্যটা আমার কাছে পরিষ্কার। এই শহরের ৩০-৩৫ জন ফুটবলার নিয়মিত আমার কাছে চিকিৎসা করান। খেলতে গিয়ে তাঁরা প্রায়শই চোট পান। আকুপাংচার করে সুস্থ হয়ে খেলার মাঠে ফিরে যান। এই চিকিৎসা যেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন তেমনই খরচও নামমাত্র। সরকারি হাসপাতালে তো চিকিৎসা হয় বিনামূল্যে,’’ বললেন তিনি।

কোন কোন ক্ষেত্রে আকুপাংচার করাবেন না

এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা একাধিক জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। সে ক্ষেত্রে যদি তিনি নির্দিষ্ট একটি রোগের জন্য আকুপাংচারের সাহায্য নিতে চান, সে রাস্তাও খোলা রয়েছে। অর্থাৎ অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি আকুপাংচার করানোয় কোনও বাধা নেই। শুধু মাত্র যাঁরা নিয়মিত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খান, তাঁরা স্টেরয়েডের ডোজ়
শেষ করার পরে চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন। মধুমেহ রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা (পিপি) ২০০-র নীচে নেমে এলে এই চিকিৎসা শুরু করা যায়। তবে ব্লিডিং ডিজ়অর্ডার বা রক্তে প্লেটলেটে সংখ্যা কম থাকলে, এই চিকিৎসা না করানোই ভাল। মনে রাখবেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বা সুপরিচিত সংস্থার অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছেই এই চিকিৎসা করানো উচিত। অনভিজ্ঞর হাতে চিকিৎসা চলাকালীন আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

যন্ত্রণাহীন চিকিৎসা

সুচ ফুটিয়ে যেহেতু এই চিকিৎসা করা হয়, তাই নিশ্চয়ই যন্ত্রণাও হয়? ডা. সামন্ত বললেন, ‘‘সুতোর মতো সুরু সুচে ব্যথা অনুভূত হয় না। বরং দেখেছি, অনেকে আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।’’ রোগীকে ক’টা সিটিং নিতে হবে সেটা নির্ভর করে রোগের উপরে। যদিও চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও মাসে একটা বা দুটো সিটিং নিলে সুস্থ থাকার মেয়াদ অনেকটাই বেড়ে যায়। চিকিৎসা চলাকালীন স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনও বাধা নেই। রোগ অনুযায়ী ব্যালান্স ডায়েটের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

মনে রাখা জরুরি

অনেকেই আকুপাংচারের সঙ্গে আকুপ্রেশারকে গুলিয়ে ফেলেন। আকুপ্রেশার সুচের মাধ্যমে নয়, শরীরের বিভিন্ন আকু পয়েন্টগুলোয় আঙুলের চাপ দিয়ে রোগ সারানোর পদ্ধতি। যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আকুপ্রেশারকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি।

কম খরচে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে এখন বহু মানুষই ঝুঁকছেন। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে যদিও কিছু দ্বিমত রয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Acupuncture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy