এখন দিন দিন চেহারা নিয়ে যত সচেতনতা বাড়ছে, ঘরে ঘরে ততই জনপ্রিয় হচ্ছে পরচুলার ব্যবহার। এ দেশে শুধু নয়, বিদেশেও। ছবি: পিক্সাবে।
সবই হয়তো গিয়েছে। কিন্তু চুলোচুলি যায়নি। সারা বিশ্বে চুলের জোগানে শীর্ষে ভারত। আর ভারতের মধ্যে শীর্ষে কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম।
নিজের চুল হয়তো নয়। তবু চুল তো!
শোনা যায়, ভগবানের কাছে দান করা চুলেই পেট চলে এই গোটা গ্রামের। শুধু পেট চলে বললে কম বলা হবে। দানের চুলের মহিমায় এখন গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত সে গ্রামের নাম।
‘তন্নু ওয়েডস মন্নু’-তে কঙ্গনা রানাউতের দু’রকমের চুলের সাজ মনে আছে? সে সব তো আর এমনি এমনি হয়নি! তার জন্য পরচুলা লেগেছিল। নানা ধরনের চুলের ছাঁট দেওয়া ‘উইগ’ (পরচুলা) তৈরি হয় অভিনেতা-মডেলদের সাজাতে। তাঁদের দেখে এখন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে পরচুলা পরার চল বেড়েই চলেছে। কেউ টাক ঢাকেন ‘উইগ’ দিয়ে। কেউ অন্য ছাঁটের চুল পরে চেহারায় আনেন নতুনত্বের ছোঁয়া। কেউ বড় চুল ঢাকেন ববছাঁট পরচুলার আড়ালে, কেউ বা ১০ ইঞ্চির চুলের সঙ্গে বেঁধে নেন ১২ ইঞ্চির বেণী। এখন দিন দিন চেহারা নিয়ে যত সচেতনতা বাড়ছে, ঘরে ঘরে ততই জনপ্রিয় হচ্ছে পরচুলার ব্যবহার। এ দেশে শুধু নয়, বিদেশেও।
গোটা বিশ্বে পরচুলার প্রায় ৫৮০ কোটি ডলারের ব্যবসা হয়েছিল ২০২১ সালে। এ বছর তা আরও বাড়বে বলেই ধারণা অনেকের। ‘উইগ’ তৈরি করতে অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম জিনিস ব্যবহার করা হলেও তার এক-তৃতীয়াংশই তৈরি হয় আসল চুল দিয়ে। সেই চুলের অনেকটাই যায় ভারত থেকে। ২০২১ সালে ৭৭ কোটি আমেরিকান ডলারের চুল বিদেশে গিয়েছে এখান থেকে। ২০২০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে সে সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুণ। এমনই হারে বাড়ছে পরচুলার ব্যবসা।
পৃথিবীর সর্বত্র সেই চুলের জোগান দেওয়ার ব্যবসায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে ভারত। এবং তা রয়েছে মূলত বাংলার এক গ্রামের দৌলতে। সেখানে ঘরে ঘরে তৈরি হয় নকল চুল। দেশের নানা প্রান্ত মিলিয়ে যত পরচুলা তৈরি হয়, তার চেয়েও বেশি তৈরি হয় শুধু এই একটি গ্রামেই।
গ্রামের নাম বাণীবন জগদীশপুর। বড় রাস্তা থেকে মন্দির পেরিয়ে গাঁয়ের অলি-গলির ভিতরে ঢোকার আগে পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই যে, এ অঞ্চল হাওড়া জেলার আর পাঁচটি জায়গার চেয়ে আলাদা। গ্রামের ভিতরে ঘরে ঘরে হাতের কাজ হতে দেখা যায় বাংলার নানা প্রান্তেই। এখানেও এক একটি গলির ভিতরে আছে এক একটি কারখানা। গ্রামবাসীদের বাড়ির রোজনামচার মধ্যেও জায়গা করে নিয়েছে পরচুলা। রান্নাবান্না, লেখাপড়ার সঙ্গে সমান তালে চলতে থাকে খোঁপা, বেণী, ববছাঁট চুলের উইগ, লম্বা স্টেপকাট চুলের উইগ তৈরির কাজ!
গ্রামের বধূ থেকে মাঝবয়সি গৃহকর্তা— অধিকাংশেই কোনও না কোনও ভাবে নকল চুল তৈরির এই কাজে যুক্ত। কেউ চুল তৈরির কারখানার রোজের কর্মী, কেউ বা কারখানা চালান। কেউ আবার অন্য কাজ সামলে ফাঁকা সময়ে কিছুটা কাজ হাতে নেন। তবে সে গ্রাম কি বাংলার অন্য সব গ্রামের চেয়ে চেহারায় একেবারে আলাদা? দেখে কি বোঝা যাবে প্যারিস থেকে নিউ ইয়র্ক, সব জায়গার সেরা সুন্দরীদের সাজিয়ে তোলার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত এ সব ঘরের বাসিন্দারা? এ সব চুলের ক্রেতারাও কি আদৌ জানেন যে, কলকাতা শহরের থেকে খানিক দূরে হাওড়ার এক প্রান্তে একটি গাঁয়ে কোনও এক গৃহবধূ সারা দিন ঘরের কাজ সামলে সন্ধ্যায় বসেন তাঁদের সাজের সরঞ্জাম বানাতে? সে গ্রামের অলিগলি ঘুরে তেমন মনে হবে না।
যে মাথায় চুল গজাল, সেখান থেকে তা পরচুলা হয়ে ক্রেতার মাথা পর্যন্ত পৌঁছনোর যাত্রা বেশ লম্বা। পদে পদে রয়েছে নানা গল্প। বাণীবনের প্রায় প্রতিটি ঘরের কেউ না কেউ গল্পের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কেউ কেউ জানেন, কেউ আবার জানেনই না কত দূর পৌঁছয় তাঁদের হাতের কাজ। সেখানকার একটি কারখানার কর্মী হবিবুল মোল্লা যেমন বলেন, ‘‘আমাদের তৈরি চুল মুম্বই, দিল্লি, কানপুরের মতো কিছু শহরে যায়।’’ আবার সে কারখানারই মালিক জানান, প্রতি বছর তাঁদের তৈরি চুল পাড়ি দেয় কানাডা, ফ্রান্স এবং ডেনমার্কে। বিভিন্ন ফ্যাশন শো-তেও তাঁদের হাতে তৈরি পরচুলা ব্যবহার করা হয়েছে বলে শুনেছেন তিনি।
সারা বিশ্বে পরচুলার চাহিদা যতই বাড়ছে, তা তৈরির কাজও বাড়ছে। বড় বড় মন্দিরে অনেকে চুল দান করেন। তিরুপতির মন্দির হোক কিংবা অন্য কোনও মন্দির, সেখানে থাকেন হাজার হাজার নাপিত। আর দানের পর তাঁদের থেকেই চুল জোগাড় করেন পরচুলার ব্যবসায়ীরা। তিরুমালার বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে দিনে অন্তত ৪০ জন চুল দান করেন। এর পর দেবতার কাছে দান হওয়া সেই চুলই সারা বিশ্বে ঘোরে। পশ্চিম ভারতের কোনও গৃহিণীর মাথার চুল দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে কাটা পড়ে নাপিতের হাত ঘুরে, ধোয়া হয়ে পূর্ব ভারতের হাওড়া জেলার এক গ্রামে পরচুলা তৈরির কারখানায় গিয়ে নতুন রূপ নিয়ে শেষে শোভা পায় হয়তো ভিন্দেশি কোনও অভিনেতার মাথায়। বাণীবনের ব্যবসায়ী আর কর্মীদের কাজ এই যাত্রার মাঝপথে। আসল চুলকে নকল চুলে পরিণত করার পথ এতটাই লম্বা।
বাণীবনে গিয়ে দেখা গেল, ছোট ছোট ঘরে চলছে পরচুলা তৈরির নানা রকম কাজ। সেখানকার এক কর্মী মনোহর সাধু জানালেন, ‘কাঁচামাল’ মূলত আসে দক্ষিণ ভারতের কিছু মন্দির আর হাওড়া, কলকাতার আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বিউটি পার্লার থেকে। এক দফা ধুয়ে সাফ করেই আসে সেই চুল। তবে তার পর আবার তা ধোয়া হয় কারখানায় এনে। এর পর দফায় দফায়, নানা হাত ঘুরে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের ‘উইগ’। গোঁফ, দাড়ি, ভুরুও বানানো হয়।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানালেন, একেক জন কর্মীর একেক রকম কাজ রয়েছে। কেউ চুল পরিষ্কার করেন। কেউ আবার চুল কাটেন। সুন্দর আকার দেন। কারও কারও হাত আবার ‘উইগ’ বোনার কাজের জন্যই যেন তৈরি। তাই তা-ও করার নির্দিষ্ট লোক আছেন। কাজ বাড়ছে। তাই কর্মীর চাহিদাও বাড়ছে। ফলে গ্রামের তরুণ-তরুণীরা আরও বেশি করে এই কাজে আসছেন।
সব কর্মী যে এই বাণীবনেরই, এমন নয়। কাজের চাপ যত বাড়ছে, ততই অন্য গ্রামের বাসিন্দারাও এখানে এসে কাজে যোগ দিচ্ছেন। রণজিৎ গড়াই তেমন এক যুবক। সংসারের প্রয়োজনে লেখাপড়া ছেড়ে কাজের খোঁজে বেরিয়ে বাণীবনে এসে পৌঁছেছিলেন। একটি কারখানায় কাজও পেয়ে যান। গত দেড় বছর ধরে বাণীবনের এক কারখানায় উইগ তৈরির কাজ করছেন রণজিৎ। তিনি বলেন, ‘‘সংসার দিব্যি চলে যাচ্ছে। কাজের অভাব হয় না। সারা বছর কাজ থাকে। তাই অন্য কাজ আর খুঁজতে হয়নি।’’ প্রথম থেকেই আয় হতে শুরু করে। যে দেড় মাস কাজ শিখছিলেন, তখন পেতেন দিনে ২০০ টাকা। কাজের দায়িত্ব বাড়তেই দিনে ৪০০ টাকা পাচ্ছেন, জানালেন রণজিৎ। তাঁর কথায়, ‘‘এখনই মাসে হাজার দশেক ঘরে আসে। এত কম সময়ে এ রকম টাকা কোথায় পেতাম?’’
ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ২০টি কারখানা রয়েছে এই এলাকায়। স্থানীয়েরা জানান, ব্যবসা বাড়তে থাকায় আশপাশের গ্রামগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ছে এই শিল্প। কাঁটাবেড়িয়া, মল্লিকপাড়া, বড়গ্রাম, ওয়ালবেড়ে গ্রামেও এখন তৈরি হচ্ছে পরচুলার কারখানা। এক একটি কারখানায় অন্তত ১৫-২০ জন কর্মী তো থাকেনই, কোথাও থাকেন তার চেয়েও বেশি।
এক দিনে এত বড় হয়নি ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বছর ৭০ আগে গ্রামের এক বাসিন্দা চেন্নাই গিয়েছিলেন। তখন সেখানকার মন্দির থেকে যে সব চুল সংগ্রহ করা হত, তা দিয়ে পরচুলা তৈরি করার কাজ হত সেখানে কিছু কিছু কারখানায়। তেমনই একটি কারখানা থেকে পরচুলা তৈরির কাজ শিখেছিলেন। তার পর বাড়ি ফিরে সেই কাজ করতে থাকেন ক্রমশ ছড়িয়ে যায় পরচুলা বানানোর কাজ। ধীরে ধীরে এই গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়ে। গত ১৫ বছর ধরে তেমনই একটি কারখানা চালাচ্ছেন নেহরাজুল মোল্লা। তিনি বলেন, ‘‘এখন আরও নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে। কাজ বাড়ছে।’’
হাবিব আলি মোল্লা আবার কাটিংয়ের কাজ করেন। মাস মাইনে ২৫,০০০ টাকা। কাছেই একটি গ্রামে হাবিবের বাড়ি। দাদা কাজের খোঁজে হায়দরাবাদ গিয়েছিলেন। সেখানেই চুল তৈরির কাজে ঢোকেন। হাবিব বলেন, ‘‘হায়দরাবাদে কাজ শিখে এখানে চলে এসেছিল দাদা। টাকা ভালই। তাই আমাকেও নিয়ে আসে। দু’জনের রোজগারে ভালই সংসার চলে যায়।’’ নানা প্রান্ত থেকে যত কাজের বরাত আসছে, তত ব্যস্ততা বাড়ছে হাবিব, নেহরাজুলদের। এক একটি উইগ তৈরি করতে এমনিতে তিন-চার দিন সময় লাগত। কিন্তু এখন সে সময়ও হাতে থাকে না মাঝেমাঝে। রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে কর্মীদের। সমীক্ষা যা বলছে, তত কথা জানেন না বাণীবন জগদীশপুরের উইগ তৈরির কারখানার কর্মীরা। তবে জানেন, এ কাজ ছেড়ে অন্য কাজ খোঁজার এখন প্রশ্নই ওঠে না। পরচুলার চাহিদা বলে দিচ্ছে, তাঁদের রান্নাঘরের চুল্লির আঁচ আরও বাড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy