সে প্রায় এক যুগ আগের কথা। ২০১৪ সাল। কর্মসূত্রে দু’জনেই তখন কলকাতায়। ফেসবুকে আলাপ। তার পর বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব গড়ায় প্রেমে। কিন্তু পরিণয়ের মাঝে ‘ভিলেন’ হল গিয়ে উচ্চতা!
এক জন ৫ ফুট, অন্য জন ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি! সমাজের চোখে পাত্রী ‘স্বাভাবিক’, পাত্র ‘বামন’। ফলে মানানসই নন। কিন্তু প্রেম কি এতশত বোঝে?
ফলে পাঁচ ফুট উচ্চতার, সব দিক থেকে ‘স্বাভাবিক’ (পড়ুন শারীরিক দিক থেকে), শিক্ষিত, কর্মরতা একটি মেয়ের ‘বামন’ ছেলেকেই মনে ধরল। সুস্মিতার কথায়, “আর পাঁচ জনের থেকে ‘তমো’ আলাদা বলেই বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়েছিলাম। ফেসবুক প্রোফাইলে ওর পূর্ণাবয়বের ছবিই ছিল। ও কিন্তু ছবি এডিট করে রাখেনি।”
সেই থেকে গল্পের শুরু। কাজের সূত্রে শহরের এক ক্যাফেতেই দু’জনের শুভদৃষ্টি। তার পর কলকাতার মতো শহরে ‘পেয়িং গেস্ট’ থাকা নায়িকা সুস্মিতার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া, আর সমাজমাধ্যমের বাইরে এসে নায়িকার দৈনন্দিন জীবনে নায়ক তমোজ্যোতির প্রবেশ। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। আর প্রেমে একটু মান-অভিমান থাকবে না? তমোজ্যোতি কথায়, “হ্যাঁ, অজস্র বার ব্রেকআপ, তার পরের দিনই আবার দেখা করার জন্য আকুল মন হাতে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়োদৌড়ি। সে প্রায় বছর ছয়েকের দীর্ঘ যাত্রাপথ।”

তমোজ্যোতির সঙ্গে সুস্মিতা।
গঙ্গা দিয়ে তত দিনে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আর দেরি করা যাবে না। কিন্তু সম্পর্কের কথা কে আগে বাড়িতে জানাবেন? বর্ধমান থেকে কলকাতায় আসা মেয়েটিই প্রথম সাহস দেখিয়ে ‘বামন’ তমোজ্যোতির কথা তাঁর মাকে জানান। রাজি না হলেও পাত্রটিকে একেবারে বাতিলের তালিকায় ফেলে দেননি সুস্মিতার মা। কিন্তু মেয়ের বিয়ের বিষয়ে বাবার কথাই শিরোধার্য। তাই তাঁকে আগে জানাতে হবে। এ দিকে, সুস্মিতা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। “আসলে আমি খুব জেদি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ফ্যাশন ডিজ়াইন নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েও আমাকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে,” বলে চলেন সুস্মিতা। কিন্তু মা-বাবাদের অমতে কোনও সম্পর্কে যেতে নারাজ তমোজ্যোতি। ‘শাহরুখ’ তাঁর দুলহানিয়া ‘কাজল’কে নিয়ে যাবেন, আর সেখানে ‘অমরীশ পুরী’র মতো এক জন শ্বশুর থাকবেন না, তা কী করে হয়?
তবে নায়ক তমোজ্যোতিকে ‘অমরেশ পুরী’র মন গলাতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এ সব ক্ষেত্রে এক বার যদি মানুষের দুর্বলতম জায়গাটির সন্ধান করে ফেলা যায়, তা হলে কেল্লাফতে! সুস্মিতার বাবার ক্ষেত্রেও তা-ই হল। গানপাগল মানুষটির পছন্দের শিল্পীর রেকর্ড করা সিডি যে কোম্পানি থেকে বেরিয়েছিল, সেটি আসলে তমোজ্যোতির সংস্থা। অদৃষ্টে যে কী খেলা চলে, তা কেউ জানে না! চার বোনের মধ্যে সুস্মিতা মেজো। তত দিনে দিদির সঙ্গে বন্ধুর আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। সুস্মিতার পরিবারের সকলকে নিয়ে তমোজ্যোতির করা ‘ফিল্ড ওয়ার্ক’ তত দিনে কাজ করতে শুরু করেছে। মেয়ের সিদ্ধান্তকে এক রকম মেনেই নিয়েছেন সুস্মিতার মা-বাবা। কিন্তু বেঁকে বসলেন নিকট আত্মীয়েরা। বাড়ির জামাই কেমন হতে চলেছেন, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকে। যৌথ পরিবারে বড় হওয়া সুস্মিতা নিজের জীবনে এমন ‘অস্বাভাবিকতা’ ডেকে আনবেন, তা কেউই ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ, বামন পাত্রের সঙ্গে সুস্মিতার মতো মেয়ের বিয়ে হওয়া সমাজের চোখে অস্বাভাবিক ঘটনাই।

প্রাক্-বিবাহ ফোটোশুটে যুগলে।
বিয়ের দিন মণ্ডপে বরবেশে ‘বামন’ পাত্রকে দেখে আত্মীয়েরা কী বলবেন, সে কথা ভেবে দোলাচলে পড়েছিলেন কনে। তবে সে সব কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সাহায্য করেছে সুস্মিতার মনের জোর। সুস্মিতার কথায়, “আমার গায়ের রং শ্যামলা। একেবারেই বাড়ির আর পাঁচজনের মতো নয়। সেই জন্য ছোট থেকে অনেক কিছু শুনতে হয়েছে। তমোকেও তা-ই। আমাদের গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গিয়েছে।” এ বার অগ্নিপরীক্ষা দিলেন সুস্মিতা। হবু শাশুড়ি দেখেশুনে নিলেন হবু পুত্রবধূকে। জানালেন ছেলের জিনঘটিত বিরল রোগের কথা। সে সব জানানোর পরেও সুস্মিতাকে টলানো গেল না।
মিঞা-বিবি রাজি তো ক্যায়া করেগা কাজি?

বিয়ের দিনে তমোজ্যোতি এবং সুস্মিতা।
২০২১ সাল। ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রেম দিবস। এমন দিনে নিজেদের ভালবাসা উদ্যাপন করতে বিয়ে করেন দু’জনে। অতিমারির আবহে দুই পক্ষ মিলিয়ে নিমন্ত্রিতের তালিকায় সে দিন মোট ১৫০ জন ছিলেন। তমোজ্যোতি এবং সুস্মিতার বিয়ের অনুষ্ঠানে জাঁকজমক খানিকটা কম হয়েছিল কোভিডের কারণে। সুস্মিতা বলেন, “আসলে আমার মনে হয়েছিল শারীরিক কারণেই তমো বিয়ের সব অনুষ্ঠান ওই ভাবে পালন করতে পারবে না। তাই শুধু মালাবদল, সিঁদুরদান আর সই করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।” সময় নষ্ট না করে বিয়ের দু’দিন পরেই মধুচন্দ্রিমা করতে গোয়ায় উড়ে গিয়েছিলেন দু’জনে।

এ বছরের ভ্যালেন্টাইন’স ডে।
ওদের বিয়ে এ বছর চারে পা দিল। রাগারাগি, মান-অভিমান, কথা বন্ধ হলেও তমোজ্যোতিকে নিয়ে সুস্মিতার আসলে কোনও আক্ষেপ নেই। আর পাঁচটা দম্পতির মতোই সাধারণ জীবন কাটান ওঁরা। সকাল থেকে যে যার কাজে নিজেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার পর বাড়ি ফিরে সারা দিন কে কী করলেন, তা নিয়ে চর্চা হয়। দু’জনেই ক্রাইম, থ্রিলারের ভক্ত। মজা করে তমোজ্যোতি বলেন, “এই সব দেখে আর এমন চিৎকার করে যে বাইরে থেকে কেউ শুনলে ভাববে আমি বৌয়ের উপর অত্যাচার করছি।” সুস্মিতা তমোজ্যোতিকে থামিয়ে বলেন, “আমাদের ক্ষেত্রে লোকে উল্টোটাই ভাববে। বৌ বরের উপর অত্যাচার করছে। আর ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য নিজে চিৎকার করছে।” সুস্মিতা দারুণ সব রান্না করে টেবিল সাজিয়ে রাখেন তমোজ্যোতির জন্য। নিজে হাতে পোশাক তৈরি করে দেন। আর সময় পেলেই ঘুরতে চলে যান।
হাঁটু মুড়ে বসে কেউ কাউকে ভালবাসার কথা জানাননি। কিন্তু ছবি তোলার প্রয়োজনে কখনও সুস্মিতা তমোজ্যোতির পাশে তেমন ভাবেই বসে পড়েন। আবার কখনও রাস্তার পাশে উঁচু ঢিবি দেখলে তার উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন তমোজ্যোতি, যাতে সুস্মিতা ওঁর কাঁধে মাথা রেখে ছবি তুলতে পারেন। চুমু খেতে চাইলেও উচ্চতা যে বাদ সাধতে পারে না, তা-ও হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেন যুগল।
(ছবি সৌজন্যে তমোজ্যোতি এবং সুস্মিতা)